গাড়ি সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হল। গাড়িতে উঠলে আমার একটা সমস্যা ছিল বমি করা। জায়গা যদি একটু দূর হয় তাহলে আমার বমি স্টার্ট হয়ে যায়। আর এখানে কোনো প্রস্তুতি ছাড়া আসছি। তার উপর এদের সাথে যাচ্ছি। আমার বমি করা নিয়ে ওদের অভিব্যক্তি কেমন হবে তা নিয়ে টেনশনে মরে যাচ্ছিলাম। তার উপর এটা হাইস। এগুলাতে বমি আর বেশি আসে। মনে মনে আল্লাহর কাছে পার্থনা করলাম যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানোর জন্য। পুরা গাড়িতে মারোয়া বক বক করছিল আমার সাথে। বাকি সবাই নিশ্চুপ হয়ে ছিল। মারোয়া কতক্ষণ পরপর আমাকে বলছিলো
----- ম্যাম আপনি শুনতেছেন?
আমি বললাম
----- হ্যাঁ শুনতেছি। তারপর কি হল?
আমার ঝিমুনি আসতে লাগল। টের পেলাম মারোয়া আমাকে শুকতেছে। কতক্ষণ আমার হাত, কতক্ষণ আমার চুল, এমনকি বুকেও শুকতে যাবে আমি ধরে ফেললাম। বললাম
-----মারোয়া তুমি কি করছ?
----- ম্যাম আপনার গায়ে এত মিষ্টি গন্ধ কেন? আমার শুধু শুকতে ইচ্ছা করছে। কোন পারফিউম এটা?
আমার এত হাসি পেল বলার মত না।
-----এটা পারফিউম না। এটা বেলি ফুলের গন্ধ।
-----ওয়াও বেলি ফুল! খুব ভাল।
.
মারোয়া আসলেই খুব কিউট।। আমি মনে মনে হাসলাম।
বেশ কিছুক্ষন পর আমি গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঝাকুনি খেয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ খুলে দেখলাম অচেনা জায়গায় আছি। কোলের উপর ভার অনুভব করলাম। কোলের দিকে তাকাতেই দেখলাম মারোয়া আমার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। মুক্তা এখনো ঘুমে। তবে মারোয়ার আম্মুর ও ঝাকুনি খেয়ে ঘুম ভেঙ্গেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম
-----কি হল?
মামুন এই প্রথম বার আমার সাথে কথা বলল। সে বলল
----- জানিনা। দেখতে হবে।
----- ড্রাইভার কে জিজ্ঞেস করো কি হয়ছে।
----- ড্রাইভার যাচ্ছে দেখতে কি হয়েছে।
আমরা গাড়িতে বসে রইলাম। মামুন আর ড্রাইভার দেখতে গেল কি হয়ছে? মামুন এসে বলল টায়ার পাংচার হয়ে গেছে। কিছুটা সময় লাগবে ঠিক করতে। গাড়ি থেকে বেড়িয়ে সবাই কে একটু হাটাহাটি করতে বলল। মারোয়ার আম্মু বের হয়ে গেলেন। মুক্তা ঘুম থেকে উঠল না। আমাকেও বাইরে যেতে হবে। কিন্তু মারোয়া কে জাগাচ্ছি ও উঠছে না। ঠিক সে সময় মামুন কিছু একটা করতে গাড়িতে আসল। যখন আমাকে দেখল আমি মারোয়া কে জাগাচ্ছি কিন্তু মারোয়া উঠছেনা তখন সে এগিয়ে এলো। নিজে এসে মারোয়া কে জাগাতে লাগল। তখন আমার হার্ট বিট বেড়ে গেল। কারন মারোয়া আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিল। আর মামুন আমার খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে মুর্তির মত বসে রইলাম। ও জাগাতে ব্যর্থ হলে মামুন মারোয়া কে কোলে উঠিয়ে নিয়ে গেল আর যাওয়ার সময় মুক্তা কে শুধু একবার উঠার জন্য ডাক দিয়ে গেল আর তাতেই মুক্তা ধরফরিয়ে ঘুম থেকে উঠে গেল। আমি কিছুটা অবাক হলাম। মুক্তা যথেষ্ট পরিমাণ ভয় পায় তার ভাইকে। এমন ছেলে অকর্মার ঢেকি হয় কিভাবে। আমিও বের হলাম। প্রায় দুপুর হয়ে এসেছে আর খিদায় পেট চো চো করছে।
আমার কিছু বলতে হল না। মারোয়া তার মাকে বলল খিদার কথা। কিন্তু মারোয়ার আম্মু বলল
-----এখানে কিভাবে দিব বল?
---- আন্টি গাড়িতে তেরপাল আছে?
----- দাড়াও দেখি।
---- এরকম কিছু পেলে ভাল হবে। এখানে ঘাসের উপর বিছিয়ে নাস্তা খাওয়া যাবে।
----- আচ্ছা ঠিক আছে।
.
অত:পর আন্টি কিছু পেলেন না। কিন্তু মামুন কোথ থেকে একটা প্লাস্টিক নিয়ে আসল। ও বলল ড্রাইভারের কাছ থেকে নাকি এটা পাইছে।
আমি সুন্দর কর ওটা পরিষ্কার জায়গায় বিছিয়ে নিলাম। মারোয়া আমাকে সাহায্য করছিল। এই মেয়েটা এক মুহূর্তের জন্য আমার পাশ থেকে সরছিল না। আর মুক্তা তো লা জবাব। সে শুধু সেলফি আর ভিডিও করছিল।
সবকিছু রেডি হওয়ার বাদে সবাই খেতে বসল। মারোয়া গিয়ে মামুন কে ডেকে নিয়ে আসল। সবাই খেতে বসলে বললাম
----- ড্রাইভার কে ডাকলে ভালো হতো না।। ওনারও নিশ্চই খিদা লাগছে?
----- লাগছে নিশ্চই। তবে আমরা খেয়ে নিই। তারপর দেখা যাবে।
----- খাওয়া শেষ হলে আমি দিয়ে আসব। এখানে বসার দরকার নাই।
আমি ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকালাম। নিরবে শুধু খাচ্ছে ও।
নাস্তা ভালোই ছিল। হাতে বানানো। কিন্তু খাবার তো খেলাম। এবার যদি বমি করি? আসার সময় তো ঘুমাই ছিলাম। মারোয়ার আম্মুকে বললাম এ কথা। মারোয়ার আম্মু মামুন কে ডেকে দোকান থেকে টক জাতীয় কিছু এনে দিতে বলল।
গাড়ি ঠিক হয়ে গেছে। সবাই কে উঠতে বলল গাড়িতে। আর মামুন আচার এনে দিলো আর আমার হাতে একটা পলিথিন দিল। পলিথিন হাতে নিয়ে ওর দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম।
ও বলল
----- বমি আসলে এটাতে করিও। না হলে গাড়ি নোংরা হবে।
লজ্জায় ওর দিকে তাকাতে পারলাম না। পলিথিন টা নিলাম। আর চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলাম। মারোয়া তার স্পেশাল বকবক শুরু করল। এবার আমিও বকবক শুরু করলাম। উদ্দেশ্য বমি না করা। আমাদের সাথে মুক্তা ও যোগ দিল। হাসি আর কলরবে গাড়ি মুখরিত হয়ে উঠল। আমার মাথা ঘুরছিল। বুঝতে পারলাম বমি আসতেছে। অনেক কষ্টে চেপে রাখলাম। যারা গাড়িতে বমি করে শুধু তারাই জানে বমি তে কত কষ্ট। আমি মাথা রেখে ঘুমাতে চাইলাম। কিন্তু মারোয়ার জন্য পারলাম না। আর চেপে রাখতে পারলাম না। গাড়ি থামাতে বললাম। সবাই আমার দিকে তাকায় রইল। এমনকি মামুন ও। আমি বললাম আমার বমি আসছে। গাড়ি একপাশে থামানো হল। আমি গাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি নেমে গেলাম। একপাশে গিয়ে বমি করতে লাগলাম। মারোয়ার আম্মু ও মারোয়া নেমে এলো। এসময়ও মারোয়া বকবক করতে লাগল। মামুন এসে একটা পানির বোতল দিল। আমি হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। এবার ভালো লাগল।
কিছুক্ষন পর গন্তব্যে পৌছলাম। আলিশান বাড়ি। এরকম বাড়ি টিভি সিনেমা তে দেখছি। দরজায় মারোয়ার মামা জনাব মহিবুল ইসলাম আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মারোয়া আর মুক্তা তাদের মামাকে জড়িয়ে ধরলেন। মামুন গিয়ে গিয়ে সালাম করল। মারোয়ার অাম্মু ও। আমিও করলাম সালাম। আমাকে না চেনাই মারোয়ার আম্মু পরিচয় করে দিলেন। পরিচয় জেনে ভদ্রলোক আমার কুশল জিজ্ঞেস করলেন। আর কোন কিছু লাগলে উনাকে জিজ্ঞেস করতে বললেন। আমি উত্তরে শুধু মাথা নাড়ালাম।
.
এরপর আমরা ভিতরে ঢুকলাম। খুব সুন্দর বাড়ি। মিসেস মহিবুল এসে আমাদের রুম দেখিয়ে দিলে। সবার জন্য আলাদা রুম দেওয়া হলেও মারোয়া আলাদা রুম নিতে নারাজ। সে নাকি আমার সাথে থাকবে। আমার অসুবিধা ছিল না। বরং ভালই হল। সবাই রুমে এসে গোসল করতে লাগল। আমিও রুমে এসে শাওয়ারে গোসল করে নিলাম। আসলে শাওয়ার আমি প্রথমবার দেখছি। মারোয়া শিখায় দিল শাওয়ার কিভাবে ব্যবহার করতে হয়।। তারপর মারোয়ার আম্মুর রুমে আমরা খেয়ে নিলাম। মামুন আসেনি। সে নাকি এসেই ঘুমাই পড়ছে। আমাদেরও কোনো কাজ নেই। তাই রুমে এসে ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়লাম। মারোয়া এসে আমার পাশে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম মনে নাই। কে যেন মারোয়া কে ডাকছে আর দরজায় করাঘাত করছে। আমার চোখে প্রচন্ড ঘুম তখন। কিন্তু ঠিকতে না পেরে উঠে গেলাম। টলতে টলতে উঠে গেলাম। ঠিকমত কিছু দেখছি না। কোনো মতে দরজা খুললাম। ঝাপসা চোখে দেখলাম কেউ একজন দরজায় দাড়িয়ে। দু হাত দিয়ে চোখ ঢললাম। এবার স্পষ্ট হল। কালো শার্ট পরিহিত একজন স্বাস্থ্যবান ছেলে দাড়িয়ে আছে। আমার চাইতে অন্তত ৫/৬ বছরের বড় হবে। সেই মুহুর্তে কাল্পনিক আন্দাজ করলাম। দেখতে ভালো। ফরসা তবে মামুনের মত না। খোচা খোচা দাড়ি। কালো শার্ট টা আশ্চর্য্য জনক ভাবে তার শরীরে ফিট হয়ে আছে। যেন উনার জন্যই শার্ট টা তৈরি।
উনি আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকায় ছিলেন। ব্যাপারটা আমার ভাল লাগল না। ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম। আশ্চর্য্য উনি কিছু বলছেন না। শেষে বিরক্ত হয়ে বললাম
.
---- কি চায়?
.
এবার জবাবে শুধু চোখ বন্ধ করে বুক ভরে শুধু একটা নিশ্বাস নিলেন। তারপর চোখ মেলে আমার দিকে তাকালেন। ঠোটের কোনে হালকা মুচকি হাসি ফুটে উঠল। তিনি আমার কথার জবাব দিলেন না। নিজেই দরজা ফাক করে ভেতরে ঢুকলেন। আর ততক্ষণে মারোয়া ঘুম থেকে উঠে বসেছে। তাকে দেখে মারোয়া ফারহান ভাইয়া বলে ঝাপিয়ে পড়ল উনার কোলে। আমি দরজায় দাড়িয়েছিলাম। তখন আমার কাছে আসতে লাগলেন মারোয়া কে কোলে নিয়ে। আমার একদম কাছাকাছি এসে চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস নিলেন আর আমি পিছু হটে গেলাম। আমার পিছু হটা দেখে উনার ঠোটের কোনে মারাত্মক একটা হাসি ফুটে উঠল। তারপর কিছু না বলে বেড়িয়ে গেল। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। ঠিক সে মুহুর্তে আমার চোখের পাতাটা নাচতে শুরু করে দিল।। তাড়াতাড়ি বাম হাতে চোখ চেপে ধরলাম।।(চলবে)