পার্ট - ১৪

333 13 0
                                    


আমার কান্না ছাড়া আর গতি রইল না।
রাতে রিফাতের জ্বর সেরে গেলো। আঘাত বেশি হওয়ায় ওর জ্বর এসে গিয়েছিল। আম্মু ওকে নিজের হাতে ভাত খাওয়ায় দিসে। আসছি পযর্ন্ত আম্মু একটু কথা বলেনি। আমি বুঝতে পেরেছি। আগে থেকে কিছু না বলাই আমার ওপর প্রচুন্ড রাগ করে আছেন। তার ওপর আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশি দের এই জ্বালা যন্ত্রনা।রিফাত ছাড়া ঘরে কেউ ভাত খেল না। আব্বু এখনো আসনি। আমি বিছানায় শুয়ে আছি। রাত আনুমানিক কত হবে আমার জানা নেই। কান্নাকাটি আর কিছু রাগারাগি বকা ঝকা করছেন। আব্বু আম্মু কে বকা ঝকা করছেন না তো?? লাফিয়ে উঠলাম। কিন্তু কান্নার শব্দ টা আম্মুর না। তাহলে কে আসল ঘরে??
রুম বেড়িয়ে গেলাম দেখতে কি হচ্ছে।
দেখলাম ফারানের বাবা মা দুজনে আসছে। তার মা খুব কান্না কাটি করতেছেন। আর ফারানের আব্বু উনাকে সান্ত্বনা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু মহিলা খুব নাছোড়বান্দা। তিনি আমার আব্বু কে কিছু একটার জন্য অনেক অনুরোধ করছিলেন। আর আব্বু মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে সম্ভব না বলে উনা দের কে চলে যেতে বলছিলেন। আমার আম্মু এককোনে বসে ফুপিয়ে কান্না করছিলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছিল। তাই আমি রুমে ঢুকলাম। আমাকে দেখে ফারানের আম্মু দৌড়ে আমার কাছে এসে কান্না জড়িত কন্ঠে বলতে লাগলেন
..... ওমা! আমার একটা মাত্র ছেলে ফারান। আমার বুকের ধন। ওর কিছু হলে আমি মরে যাব। আমার ছেলে কে বাচাও তুমি মা।
...... কি হয়ছে ফারানের??
...... ও গাড়ি এক্সিডেন্ট করছে। মাথায় বেশি আঘাত পাইছে। আই সিউ তে রাখা আছে। কিন্তু হুশ আসছে না। ডাক্তার বলতেছে ও নিজে থেকে চেষ্টা করছেনা।
..... কেন??
..... আমি জানি না মা। কিন্তু আমি চাইলে এখনি বিদেশে নামি দামি হসপিটালে নিয়ে যেতে পারা। কিন্তু আমার ছেলের হাতে তত সময় নেই। 
..... তো আমাদের কাছে কেন আসছেন?? আমরা কি করতে পারি?? আমরা তো ডাক্তার না।
..... তুমিই সব কিছু করতে পারো। ডাক্তার বলতেছে আমার ছেলে নিজে থেকে বেচে ফেরার চেষ্টা করছেনা। ও হার মেনে নিচ্ছে। এখন একমাত্র তোমার কথায় আমার ছেলে বাচার চেষ্টা করবে।
...... কিন্তু এখানে আমি কিছু করতে পারি না।
...... এরকম বলিও না। আমি বাচবনা। আমার ছেলেকে বাচাও। আমি সব দেব তোমাকে। গাড়ি, বাড়ি, মান, সম্মান আরো যা চাইবে।
এবার আব্বু কথা বলে উঠল।
..... আপনি চলে যান। আমাদের কিছু করার নেই। হায়াত মউত আল্লার হাতে। তিনি চাইলে আপনার ছেলে বাচবে। আমার মেয়ের দরকার নেই। 
আমার খুব খারাপ লাগছিল ফারানের মায়ের জন্য। বেচারি ছেলের জন্য কি না করতে চাইছেন। কোটি টাকার মালিক হয়েও আমাদের মত গরিব ঘরে ধর্না দিচ্ছিলেন। 
এবার ফারানের মা আমার আব্বু কে টলাতে না পেরে আমার আব্বুর পা ধরে ফেললেন। আমি নিশ্বাস এক মিনিটের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। আসলে মা জাতি রাই এরকম। নিজের সন্তানের জন্য সৃষ্টিকর্তার সাথে লড়ায়ে যেতে দ্বিধা বোধ করেন না। আমার নিজের চোখে পানি এসে গেল। উনাকে আব্বুর পায়ে পড়তে দেখে ফারানের আব্বু কি করছ, কি করছ বলে টেনে তুললেন। আর আমার আব্বু বেশ ঘাবড়ে গেলেন। আম্মু পিছন থেকে এসে বললেন আমার মেয়ে যাবে আপনাদের সাথে। আপনি আর কান্না করিয়েন না। আব্বু এক মুহুর্তের জন্য আম্মুর দিকে তাকালেন। তারপর নিজের হার মেনে নিয়ে সায় দিলেন। তারপর তিনি বললেন
..... আমার মেয়েকে দিতে পারি এক শর্তে।
..... আমি আপনাদের সব শর্ত মেনে নিতে রাজি। কি চান বলুন।
...... আমাদের কিছু দরকার নাই। ব্যস আমার মেয়ের সাথে আমি যেতে চাই। শুধু মাত্র আধা ঘন্টার জন্য। আপনার ছেলেকে বিশ্বাস করি না। কখন কি থেকে কি করে ফেলে।
..... ঠিক আছে। আমরা রাজি। এবার জলদি চলুন।
আমি আর আব্বু ওদেরই গাড়িতে করে যেতে লাগলাম। বেশি সময় লাগল না। রাত বারোটা অলরেডি বেজে গেছে। রাস্তা ঘাট সুনসান নিরবতা পালন করছে। পৌনে একটা বেজে গেলো হসপিটালে পৌছাতে পৌছাতে। হাসপাতালের ভিতরে ঢুকতে কোন সমস্যা হল না। সবাই মনে হয় ফারানের মা বাবা কে চিনে। সালাম দিচ্ছিল সবাই আর আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি আর আব্বু নিরবে ওদের পিছনে পিছনে চলছিলাম। এরকম কিছুক্ষন হেটে লিফট বেয়ে আই সিউতে প্রবেশ করলাম। ওখানে ফারানের বাবা মা একটা রুমের নিকট নিয়ে গেলেন। রুম টা দেখে বেশ অবাক হলাম। হাসপাতাল বলতে আমি যা বুঝি তা হল একটা অনেক বড় হল। সেখানে অগুনিত বেড। বেডে রোগে কাতরানো মানুষ অার তার কাছের মানুষ রা। তার উপর জায়গা না পাওয়া মানুষ রা এখানে সেখানে নিচের বেডে শুয়ে। কিন্তু এই রুমটা ঠিক তার উল্টা। মাঝারি সাইজের রুম। অনেকটা ফাইবস্টার হোটেল রুমের মত। তাতে নানা ধরনের যন্ত্র পাতি। দুইজন নার্স দাড়িয়ে দেখা শোনা করছে। ডাক্তার ও দাড়িয়ে চেক আপ করতেছে। আমি সবকিছু অবাক চোখে দেখছিলাম।
সবার শেষে আমার নজর পড়ল ফারানের ওপর।
সে বেডে শুয়ে আছে নিশ্চুপ ভাবে।। চেহারা টা পুরো মলিন আর আঘাতের চিহ্নে ভরা। মাথায় ব্যান্ডেজ মোড়ানো। নিশ্চই বড় জখম। কারন ব্যান্ডেজ রক্তে লাল হয়ে আছে। আর কি সব তার তুর পেচানো। স্যালাইন ছাড়া অন্য কিছু চিনি না। জীবনে দেখিও নাই। সেকি নাকের ভিতর দিয়েও একটা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়ছে। নিশ্চই ফারানের খুব কষ্ট হচ্ছে। 
ওদিকে ফারানের আম্মু নিঃশব্দে কান্না করছেন আর ফারানের আব্বু বার বার চোখ মুছছেন। আমার এই মুহুর্তে কি করা উচিত ভেবে বের করতে পারলাম না। তথাপি আমি ফারানের মায়ের পাশে দাড়িয়ে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। উনি ফারানের কাছে গিয়ে বলতে লাগলেন
...... বাবা দেখো তোমার মোহিনী আসছে তোমাকে দেখতে। এবার তো চোখ খুলো। তোমার মায়ের আর সহ্য হচ্ছেনা। ও বাবা উঠোনা। দেখোনা তোমার মোহিনী আসছে।
.
ডাক্তার কে জিজ্ঞেস করলাম
..... ফারান কি সবকথা শুনতেছে??
...... সব না। অল্প কিছু।
.
ফারানের মায়ের এতসব কথায় ফারানের কোন রেসপন্স পাওয়া গেলনা। আমি ফারানের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমি জানি না কেন গেলাম। কিন্তু আমার মনে হল যাওয়া উচিত। আব্বুও বাধা দিল না। আমি ফারানের পাশে গিয়ে ওর সাথে কথা বলতে চেষ্টা করলাম
...... ফারান! আমি মো.. মোহি.. হিনী বলছি।। আমি আমার দূর্ব্যবহারের জন্য মাফ চাচ্ছি। প্লিজ আপনি উঠেন।
নো রেসপন্স!!
আমি আবার বললাম
...... আমি মাফ চাচ্ছি। প্লিজ আপনি উঠেন। আপনার বাবা মায়ের কষ্ট হচ্ছে।
নো রেসপন্স!!
এবার আমি ফারানের হাত ধরে বলতে বলতে লাগলাম
..... আপনার কি একটুও মায়া হচ্ছেনা! আপনার মা বাবা না খেয়ে আপনার জন্য দিন রাত এক করছেন আর আপনি এখানে শুয়ে আছেন?
নো রেসপন্স!!
এবার আমার মাথা খারাপ হয়ে গেলো। আমি বলতে লাগলাম
...... আপনি আসলে অনেক খারাপ মানুষ। আপনার মা বাবা দুনিয়ার মানুষের কাছে আপনার জন্য লড়তে পারে আর ওদের জন্য আপনি নিজের সাথে লড়তে পারেনা!! কাপুরুষ কোথাকার।। আমার এখানে আসা ভুল হয়ছে। 
.
ফারান কে কাপুরুষ ডাকায় ওর বাবা মা আমার দিকে কটমট করে তাকাচ্ছিলেন। আমি ভয় পেয়ে উঠে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পারলাম না। ফারান আমার হাত শক্ত করে ধরে আছে। ডাক্তার লাফিয়ে উঠল। তার সমস্ত যন্ত্র পাতি চেক করতে লাগল। তারপর বলতে লাগল
.... মি ফারান রেসপন্স করতেছে। প্লিজ আপনি আপনার কাজ চালান। 
ফারানের বাবা আমাকে উৎসাহিত করতে লাগলেন। অথচ এক মিনিট আগেও উনি আমার দিকে কটমট করে তাকাচ্ছিলেন। ফারানের মা ও কান্না করতে করতে সায় দিলেন। আমার আব্বু এক কোনে দাড়িয়ে সবকিছু দেখছিলেন। আমি আবার ফারানের দিকে ফিরলাম। দুহাত দিয়ে ওর হাত চেপে ধরলাম। তারপর ওর সাথে নানান ধরনের কথা বলতে লাগলাম। প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেলো। কিন্তু হাত ধরা ছাড়া আর কোনো রেসপন্স পাওয়া গেলোনা। ডাক্তারের মতে ও এখন বিপদ মুক্ত। আমারও খুব ঘুম আসছিল। এবার আব্বু বলে উঠল
.... অনেক ক্ষন হয়ছে। এবার বাড়ি চল। ওদের ছেলে ভালো হয়ে যাবে। 
সাথে সাথে ফারানের বাবা বলে উঠল
...... আরেকটু থাকেন।
...... না। আর থাকা যাবে না। আড়াই ঘন্টা হয়ছে আসছি। চল রেনুমা
আমি আব্বুর কথায় উঠতে চাইলাম। কিন্তু ফারানের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়াতে পারলাম না। আব্বু নিজে এসে ফারানের হাত 
থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন। আর আমি যেতে যেতে ওর দিকে তাকালাম আর মনে মনে দোয়া করলাম আল্লাহ তুমি ওরে ভালো করে দাও।
.
(চলবে)

মোহিনীDonde viven las historias. Descúbrelo ahora