ট্রেইনটা বাঁক নিতেই সূর্যের রশ্মি একেবারে মুখে এসে পড়ল জিনিয়ার। অন্যদিন হলে বই থেকে মুখটা তুলে চোখদুটো বুঁজে মিনিটখানেক ভোরের এই নরম সূর্যকিরণ ও উপভোগ করত। কিন্তু এই মুহূর্তে ওর মন-মেজাজ যাকে বলে একেবারে খিঁচড়ে আছে। অথচ ট্রেইন জার্নি জিনিয়ার কাছে পৃথিবীর অন্যতম উপভোগ্য জিনিস। জানালার বাইরে মনোরম প্রকৃতি, ধুলোবালি মুক্ত নির্মল হাওয়া, ট্রেইনের ঝিকঝিক শব্দ, আরামদায়ক দুলুনি আর সেই সাথে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বইয়ের পাতায় হারিয়ে যাওয়া। এ সবকিছু একসাথে আর কোথায় পাবে ও?
তাই কোথাও যাওয়ার হলে সে কমসে কম এক সপ্তাহ আগে বগির মাঝের একটা জানালার সিট বুক করে। কারণ ওর মোটাসোটা বই আর চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে যাত্রা করা অন্য সিটগুলোতে ঠিক আরামের হয়না। বইয়ের সাথে সাথে জিনিয়ার জীবনে আরেক অবিচ্ছেদ্য জিনিস হচ্ছে চা। তাও আবার যে সে চা নয়, ওর নিজের হাতে বানানো চা। যাতে চায়ের লিকার আলাদা করে ফুটিয়ে তারপর তার সাথে গুঁড়ো দুধ আর চিনি মেশাবে সে। তাই ট্রেইন জার্নিতে ওর সাথে লিকারভর্তি চায়ের ফ্লাস্ক, গুঁড়ো দুধ আর চিনির দুটো ছোট ছোট কৌটো থাকবেই থাকবে। কিন্তু আজকে চা বানাতে গিয়ে ব্যাগ খুলে দেখে চিনির কৌটোটা নেই। কেমনটা লাগে? এই সাত ঘন্টার জার্নি ও এখন চা না খেয়ে কীভাবে যাবে?
তার উপর আজকে জীবনে প্রথমবারের মতো ও একা জার্নি করছে। একটু আয়েশি হলে কী হবে, ও ভীষণ মুখচোরা। তাই পাশ দিয়ে “চা-কফি” বলতে বলতে যতবার এটেনডেন্ট যাচ্ছে, ও উশখুশ করে উঠছে। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারছে না। একে তো এদের কাছ থেকে ও নিজে কোনোদিন কিছু কিনেনি, তার উপর ওর দরকার শুধু চিনি। সামনে খুলে রাখা ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের 'শ্রেষ্ঠ উপন্যাস সমগ্র'ও ওর মন ভোলাতে ব্যর্থ হচ্ছে। সতৃষ্ণ দৃষ্টি বারবার চায়ের ফ্লাস্কের দিকে ছুটে যাচ্ছে।
এদিকে ঠিক উল্টোদিকে বসে থাকা একজোড়া চোখের মালিক যে বহুক্ষণ থেকে ওকে নিবিড়ভাবে লক্ষ করছে, সে সম্পর্কে ওর কোন ধারণাই নেই। এবার চা-কফিওয়ালা ওদের পাশ দিয়ে যেতেই তিনি ডাক দিলেন, “আমাকে এক চামচ চিনি দিয়ে একটা আদা চা দেন”।
এটেনডেন্ট অপর সারির সিটের সাথে ব্যালেন্স করে দাঁড়িয়ে চা বানাতে লাগল। জিনিয়া বারবার চোরাচোখে তার সামনে রাখা চিনির পাত্রের দিকে তাকাচ্ছিল। বেয়ারা চা এগিয়ে দিতে গিয়ে জিনিয়ার চোখে চোখ পড়তেই ও চোখ নামিয়ে নিল। ঠিক তখনি সেই ব্যক্তি আবার বলে উঠল, “আরেকটা কাপে শুধু তিন চামচ চিনি দিন। আমি দুকাপ চায়ের দাম দিয়ে দিব”
জিনিয়া চমকে উঠে কন্ঠের মালিকের দিকে তাকায়, আর থমকে যায়। কোঁকড়া মাথার চুল, ফর্সা নিস্পাপ চেহারা আর মোটা কাঁচের চশমা। ঠিক যেন ওর সর্বকালের সেরা ফিকশনাল ক্রাশ, হুমায়ূন আহমেদের 'শুভ্র'। চিনির কাপটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, “আশা করি অন্তত এক কাপ চা এতে হয়ে যাবে”
সম্বিত ফিরল জিনিয়ার। দ্রুত চোখ নামাতে নামাতে মৃদু অথচ কাঁপা কণ্ঠে “থ্যাংকস” বলল। বুকের ভেতরে হাতুড়ির বাড়ি আর মাথার ভেতরে আবোলতাবোল কীসব যেন ঘুরতে লাগল ওর। প্রতি কাপে এক চা চামচ চিনি খায়, অথচ ভুল করে মগের পুরো চিনি উলটে বসে রইল। তারপর সেই তিনগুণ মিষ্টি চায়ে চুমুক দিতে দিতে চোখ দুটোকে চুম্বকের মতো আটকে দিল বইয়ের পাতায়। কঠোর নির্দেশ দিল তাদের, ভুলেও সামনে তাকাবি না।
এদিকে সামনে বসা ব্যক্তি ওকে এক কাপে তিন চা চামচ চিনি খেতে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছেন। একটু স্বস্তিও পেয়েছেন যে আরও কম চাননি। পরের স্টেশনে ট্রেইন থামলে তিনি উঠে গেলেন আর জিনিয়ার শ্বাসপ্রশ্বাস একেবারে বন্ধ করে দিতেই যেন এক প্যাকেট চিনি এনে ওর সামনে রাখলেন।
“আমার ওয়াইফ ভীষণ চা পাগল ছিল। তাই আমি জানি চায়ের জন্য চিনি না পেলে কেমন লাগে। এমনি নিতে খারাপ লাগলে দাম দিয়ে দিতে পারেন” মৃদু একটা হাসি দিয়ে বলল লোকটা। চশমার মোটা কাঁচের পেছনের বেদনামিশ্রিত চোখজোড়া এই প্রথমবার লক্ষ করল জিনিয়া।
***
দুই বছর পর।
“আরেক কাপ চা বানাও তো” বলল জিনিয়া।
প্রচন্ড গতিতে চলছে ট্রেন। হাওয়ার দাপটে মুখের সামনে এসে পড়া চুলগুলো আরেকদফা কানের পেছনে নিতে নিতে বইয়ের পাতা উল্টাল ও। পাশে বসা মানুষটা চায়ের কাপ এগিয়ে দিলে তাতে চুমুক দিয়ে চেহারা বিকৃত করে ফেলল। চোখ তুলে তাকাল মোটা কাঁচের চশমাধারীর দিকে।
“এত চিনি দিয়েছ কেন?”
“সেদিন তো এই তিন চামচ চিনি দেয়া চা-ই খুব আরাম করে সারা রাস্তায় কয়েক দফা খেয়েছিলেন ম্যাডাম”
গালদুটো ঈষৎ রাঙা হয়ে উঠলেও সামলে নিল জিনিয়া। “তাই বলে তুমি আজকের দিনে আমাকে এই চা খাওয়াবে? আমাদের হানিমুন ট্রিপে?”
“ও! আপনার মনে আছে যে আমরা হানিমুনে যাচ্ছি, শুনে খুউউউউব খুশি হলাম” চোখ ঘুরিয়ে বলল সে।
মুখ টিপে হাসল জিনিয়া। বইটা বন্ধ করে পাশের মানুষটার কাঁধে মাথা দিয়ে চোখ বুজল। অনেক সাধনার পরে আজকের দিনটা ওদের জীবনে এসেছে, এ জার্নিটা অন্তত বইদের না হোক। এই দু বছরে বয়সে দশ বছরের বড়, তার সাথে বিপত্নীক একজন মানুষকে বিয়ে করতে জিনিয়াকে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, সে গল্প বরং থাক। সব ভালো যার শেষ ভালো, তাইনা?(সমাপ্ত)
ESTÁS LEYENDO
ছোট গল্প ও অণুগল্প
Historia Cortaব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় সাহিত্যের গদ্য ধারাগুলোর মধ্যে ছোটগল্প লেখা সবথেকে কঠিন। অল্প পরিসরে দারুণ কিছু করে ফেলেন একজন দক্ষ গল্পকার। সেখানে আমার মত নিতান্তই অপটু এবং শিক্ষানবিশ লেখক পুরোই অকেজো। তারপরও হয়ত কখনো মন চাইলে কিছুমিছু লিখে ফেলতে পারি। স...