ইমোশনাল সব পাঠ চুকিয়ে এখন আমরা দাঁড়িয়ে আছি বড় একটা টেবিলের সামনে সেই ছাদেই। আমরা বলতে আমি, পরী আর বাবা। পরীতো আমাকে ছাড়বেই না আর বাবাকে আমিই ছাড়ছি না। পুরো ছাদ সাজানো হয়েছে রঙ বেরঙ্গের বেলুন আর ফিতা দিয়ে। আমার নামের প্রথম অক্ষরের আকারে বড় একটা কেক বানানো হয়েছে আর তার চারপাশে বেশ কয়েকটা মোমবাতী। আমার পেছনে বড় পর্দার মত করে আমার নাম সহ বেশ কয়েকটা ছবি বসানো হয়েছে আর টেবিলের এক পাশে সবার জন্য চকলেট আছে। বেশি একটা কিছু বোধহয় করে নি কিন্তু যা করেছে তাও কোনদিক দিয়ে কম না। আমি তো এটাও আশা করি নি আর এই জন্যই বোধহয় মা এত তাড়া দিচ্ছিলো আর ছাদে কয়েকজন পাহারা দিচ্ছিলো। শানুটাও আমাকে কিছু বললো না।
কোন রকম আর দেরী না করে বাবা আর পরীর হাত ধরে কেক কেটে নিলাম আর সবাইকে একে একে করে খাইয়ে দিলাম সেই সাথে সবার কাছ থেকে আবার এক দফা আদর জুটলো। বলার প্রয়োজন হয় না, কেউ দেখলেই বুঝে যায় আমি এই বাড়ির সবচেয়ে আদরের। কারণটা কি এত বছর সবার থেকে দূরে থাকার কারণে কিনা জানি না তবে আগেও ভাইয়া আমাকে সবার থেকে বেশি আদর করতো, ভালোবাসতো। আজ ভাইয়া পাশে নেই কিন্তু এই সবার মাঝে আমি আমার ভাইকে ঠিকই খুঁজে পেয়েছি।সবার সাথে পরিচয় হয়ে, কথাবার্তা বলে পরীকে নিয়ে ভাইয়ার ঘরের দিকে যাবো এমন সময় বাবা পেছন থেকে ডাকলেন।
"মা, সায়কা। শোন।"
"জ্বি বাবা।"
"কোথায় যাচ্ছিস? নূরহামের ঘরে?"
আমি শুধু মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালাম। আজ পর্যন্ত ভাইয়ার চলে যাওয়া আমাদের কারো কাছে স্বাভাবিক হয় নি।
"তুই চাইলে পরেও যেতে পারিস, এক্ষুণি যেতে হবে এমন কোন কথা নেই।"
আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম এই কথার পরে আর বললাম,
"ভাইয়ার সাথে আমার এক্ষুণি দেখা করতে হবে।"
পরীর হাত ধরে ভাইয়ার ঘরের দিকে চলে গেলাম।নিচে নামতে নামতে খেয়াল করলাম বাড়িতে নতুন করে রং করানো হয়েছে আবার আর সেই সাথে দেয়ালে আমাদের পারিবারিক অনেক ছবি লাগানো। সিড়ি দিয়ে নেমে সোজা হেঁটে গেলাম ভাইয়ার ঘরের দিকে আর পরীও সাথে আমার, আমার হাত ধরে আমার সাথে হাটছে। কোন কথা বলছে না কিন্তু এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ অদ্ভূত ভাবে! মেয়েটাকে নিজের চেয়েও বেশি আপন মনে হচ্ছে। দেখে বোঝাই যাচ্ছে না আমরা পরস্পরের সাথে জীবনে প্রথমবার দেখা করেছি।
"জানো ইম্মা, আমি কখনো বাপ্পার এই ঘরটায় যাই নি।"
পরীর কথা শুনে এবার বুঝলাম কেন সে এভাবে তাকিয়ে ছিল। সেই আমার মত এই ঘরটায় যাওয়ার জন্য অনেক উত্তেজিত কিন্তু কেউই আমরা দেখাতে পারছি না। তাও একটু খটকা লাগলো, বাপ্পার এই ঘর মানে কি?
"কেন মামণি?"
"কারণ তুমি ছিলে না তাই। আমাদের ঘর আরেকটা আছে যেখানে আমি এখন থাকি কিন্তু এটা নাকি বাপ্পার ব্যক্তিগত ঘর ছিল আর এখানে তুমি ছাড়া আর কারো যাওয়ার অনুমতি নেই। তাই এখন তোমার সাথে যাচ্ছি। তুমি আমাকে নিবে তো নাকি শুধু একা যাবে? আমি বাপ্পাকে আরো দেখতে চাই, বুঝতে চাই, জানতে চাই সে কেমন ছিল। আমাকে প্লীজ সাথে করে নিয়ে যাও।"
এতটুকু একটা বাচ্চার গলায় এরকম কাঁকুতি মিনতি শুনে আমার আত্মা কেঁপে উঠলো। পরীর সাথে এমন আচরণ কেন সবার? তার অপরাধটা কোথায় আর সেটা আমাকে ঘিরেই বা কেন?
আমি পরীর সামনে বসে তার কাধ থেকে ব্যাগ আর গলা থেকে ফ্লাস্ক নিতে নিতে বললাম,
"আমি যেমন ভাইয়ার খুব কাছের, তুমিও তার অনেক কাছের। সেই সাথে ইম্মা আর পরীতো একই, আলাদা কেউ নই। তাই এভাবে বলতে হবে না, মন খারাপ করতে হবে না। এখন আমি চলে এসেছি। তোমার যা করতে ইচ্ছা হবে, বাপ্পাকে নিয়ে যা জানতে ইচ্ছা হবে সব আমাকে বলবে। ইম্মা সব করবে তোমার জন্য। ঠিক আছে?"
পরীর মুখে বিশ্ব জয় করার মত হাসি ফুঁটে উঠলো যেই হাসি হয়তো আমাদের স্বাধীনতা যোদ্ধাদের দেশ স্বাধীন করার খুশিকেও হার মানাবে। পরীকে পাশে পেয়ে মনেই হচ্ছে না এই পৃথিবীতে কেউ একজন খুব আপন আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে দূর দেশে কারণ সে রেখে গিয়েছে অবিকল তার মত একজন।
উঠে দাঁড়িয়ে পরীর হাত ধরে ভাইয়ার ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। নিজের অজান্তেই আমি আর পরী দুইজনই ভাইয়ার নামের উপর হাত বুলালাম কিছুক্ষণ। এরপর জোড়ে একটা নিশ্বাস নিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম।
YOU ARE READING
সুহাসিনী
Mystery / Thrillerভাইয়ের খুনের প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে থাকা এক বোনের গল্প...