রাত এগারোটা। ট্রেন ছাড়বে সাড়ে বারোটার দিকে। খাওয়া দাওয়া শেষ করেই আমরা সবাই বাড়ি থেকে বের হয়েছি। এই মুহূর্তে কমলাপুর রেলস্টেশনে বসে আছি। বাবা আর বড় ভাই হালকা খাবার কিনতে গিয়েছে, চাচা ট্রেনের সময় দেখছে, মা ভাবি আর বাচ্চারা আমার সাথে প্ল্যাটফর্মে বসে আছে। পরী গাড়িতেই ঘুমিয়ে পরেছিল তাই তাকে কোলে নিয়ে আমি বসে আছি একটা বেঞ্চে। মিথ্যা বলে লাভ নেই, খুশির চেয়ে আজকে সবার মনটা একটু বেশি খারাপ। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগেই এমন একটা সংবাদ দেখে সবার শরীরে শিহরণ জেগে উঠেছে। আমি এতটুকু বুঝতে পারছি যে আমার মত তারাও একটু হলেও খুশি যে দেশের মাটি থেকে একজন সিস্টেমের ভেতরেই থাকা এক কুখ্যাত সন্ত্রাসী উঠে গিয়েছে কিন্তু একই সাথে একটা ভয় ও কষ্ট কাজ করছে। এত বছর পরে এভাবে রোশানের এমন অবস্থা কেউ করবে তাও আবার অজানা এক কারণে সেটা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। পরী তো তাও কিছু জানে না আর না জেনেই তার মন খারাপ। আমরা যারা সত্যিটা জানি আমাদের তো মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। আমার শুধু রাগ হচ্ছে এটা ভেবে যে সংবাদে খবরটা আসলেও সরাসরি তাদের সবকিছু দেখাতে হবে কেন! সেই সাথে তারা কি আর সময় পেল না এসব দেখানোর! সুসংবাদ হচ্ছে এই খবর সরিয়ে ফেলা হয়েছে সবরকম সংবাদ চ্যানেল ও সামাজিক মাধ্যম থেকে। রনোকে পরে ধন্যবাদ জানিয়ে দিবো। এখন শুধু আমাদের এই যাত্রা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আনন্দময় হলেই হলো কোন রকম বিপদ আপদ ছাড়া। আমি এক হাতে পরীর ভর নিয়ে অন্য হাত দিয়ে কোমরের বাঁ পাশ দেখে নিলাম সব ঠিক মত আছে কিনা।
এতক্ষণ এখানে বসে থাকতেও বিরক্ত লাগছে। রাস্তায় যানজটের কথা ভেবে একটু আগে বের হলাম কিন্তু পুরোটা রাস্তা জুড়ে একটুও গাড়ি ছিল না আমাদের গাড়ি আর এক দুইটা ছাড়া। এখন মাও আমার দিকে কিছুক্ষণ পরপর রাগান্বিত আর বিরক্তিকর দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছে।
"মা, এভাবে তাকাচ্ছো কেন বারবার? আমি কি করেছি এখন?"
"তোর জন্যই তো সব! এত আগে কে আসতে বলেছে তোকে?"
"মা, এসে পরেছি তো ভালোই তো হয়েছে। পরে যদি কোন কারণে দেরী হয়ে যেত তখন তো ট্রেন মিস করতাম।"
"আর এখন যে এভাবে এখানে বসে আছি, লাভ কি হচ্ছে তাতে? আমার কোমরের ব্যথাটাই শুধু বাড়ছে।"
"আগে আসার একটা সুবিধা হলো তুমি এখানে হেটে হেটে পুরো প্ল্যাটফর্ম ঘুরে দেখতে পারবে। ট্রেন যদি একটু আগে চলে আসে আমরা উঠে আমাদের ক্যাবিন ঠিক করে নিতে পারবো কোন রকম তাড়াহুড়ো ছাড়া। আর তুমিই বা বসে আছো কেন? উঠে একটু হাটাহাটি করো। কোমর ব্যাথাটাও তাহলে কমবে। আর..."
"হইছে থাম! আসছে আমার মহারাণি! এই শোন, আর একটা কথা বলবি না আমার সাথে। তোকে আমি কিছু বলছি? কথা বলছিস কেন তুই?"
মাকে বুঝিয়ে আর লাভ হবে না বুঝতে পেরে শানুকে ডাকলাম। এই শানুটা প্রথমবার ট্রেনে উঠবে দেখে অনেক উত্তেজিত হয়ে আছে আর রেললাইনের পাশে গিয়ে বসে আছে। ওকে এনেছি কি ওখানে গিয়ে বসে থাকার জন্য?
"এই ঝন্টু, শোন একটু।"
দৌড়ে আমার কাছে চলে আসলে আমি টাকা বের করে দিয়ে বললাম,
"ওই দোকান থেকে মায়ের জন্য একটা লেবু চা নিয়ে আয় জলদি।"
যেই বলা সেই কাজ। মায়ের জন্য চা এনে দিয়ে আবার রেললাইনের ধারে গিয়ে বসলো। এভাবে বসে অপেক্ষা করে সে যে কি মজা পাচ্ছে আল্লাহই ভালো জানে। আমি আড় চোখে শুধু মাকে লক্ষ্য করলাম। প্রথমে খেতে না চাইলেও পরে চায়ে চুমুক দিতেই তার চেহারা থেকে কালবৈশাখী ঝড় কেটে গেল। আমার মা আর তার লেবু চা! আমি জানতাম যে একে তো চা পছন্দ করে আর সেটা যদি হয় লেবু বা আদা চা তাহলে আর কথাই নেই। বাবাকেও প্রায় দেখতাম মা রেগে গেলেই তার জন্য চা বানিয়ে এনে দিতো আর অমনি সব রাগ হাওয়া হয়ে যেত। আমি আর কোন কথা বললাম না, চারপাশটা দেখতে লাগলাম।
YOU ARE READING
সুহাসিনী
Mystery / Thrillerভাইয়ের খুনের প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে থাকা এক বোনের গল্প...