ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই চারপাশের সব মানুষ সেই একটা মানুষের কথায় আমাদেরকে ঘিড়ে ধরলো। কে কি বলবে, কি করবে কেউ কিছু বুঝতে পারছিল না। সবাই যেন এক দৃষ্টিতে মন ভরে আমাকে দেখছে। পরীও সবাইকে দেখে একটু ভয়ই পেয়ে গিয়েছে তাই আমার হাত আরো জোড়ে চেপে ধরে আমার গা ঘেষে দাঁড়ালো। আমি তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছি আর সবাইকে দেখছি। কাকে কি বলবো, কি করবো আমি নিজেও দিশেহারা। তখন একজন মুখ খুললো,
"তুমিই কি সায়কা? আমাদের সেই ছোট্ট সায়কা?"
চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। আসলেও কি তারা আমাকে চিনতে পারলো নাকি অন্য কাউকে ভেবে ভুল করছে, ব্যপারটা আগে নিশ্চিত করতে হবে।
"আরেহ আকবর সাহেব, আপনি আবার প্রশ্ন করছেন কেন? সেই নাক, সেই চোখ, ঠোঁটের উপরে তিলটা তো আছেই! দেখে বুঝতে পারছেন না যে ওই আমাদের সায়কা মা!"
এই ব্যক্তির কথার সাথে সবাই সম্মতি জানালেন এরপর আরো মুগ্ধতার সাথে আমাকে দেখতে লাগলেন।
এভাবে আরো কিছুক্ষণ পার হলে এরপর আমার হুশ আসে। এভাবে কোন কথাবার্তা ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না, তার উপর পরী আমার সাথে আছে। কি না কি ভাবছে মেয়েটা! এক গাদা বুড়ো বুড়ির মাঝে এনে দাঁড় করিয়ে রেখেছি কোন কথা বার্তা ছাড়াই!
"পরী, ওরা সবাই বাপ্পার বন্ধু আর কলিগ। আমাদের অনেক কাছের তারা সবাই। সালাম দাও সবাইকে মামণি।"
"আসসালামু আলাইকুম।"
"এমা, এটা বুঝি আমাদের নূরহামের মেয়ে?"
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
"এদিকে এসো, এদিকে এসো। আল্লাহ, দেখেছো! বেঁচে থাকো মা।"
শঙ্কর কাকা, যিনি ভাইয়ার সিনিয়র ছিলেন আর এখন রিটায়ারড, পরীকে কাছে ডেকে আদর করলেন। সেই সাথে বাকিরাও সবাই এখন আমাকে ছেড়ে পরীকে নিয়ে মেতে উঠলো। কেমন আছে, দেখতে কেমন হয়েছে, বাড়ির সবার কথা এসব বলে পরীকে পাগল করে দিচ্ছিল। পরী ইতস্তত বোধ করে আমার দিকে তাকালে আমি যখন আশ্বস্ত করলাম যে আমি আছি তখন একটু স্থির হলো সে।"শঙ্কর কাকা, আকবর ভাইয়া, রিতা ম্যাডাম আর বাকি সবাই, কেমন আছেন আপনারা?"
সবার উদ্দেশ্যে প্রশ্নে করতে এবার সবাই আমার দিকে তাকালো। পরী আমার কাছে চলে আসলে আমরা পাশের একটা চেয়ারে বসি।
"ভালো ভালো, বেশ ভালো। তোমাদের সাথে দেখা করে এখন আরো ভালো লাগছে," রিতা ম্যাডাম বললেন।
শঙ্কর কাকা সাথে যোগ করলেন, "কবে ফিরলে তুমি?"
"কিছুদিন আগেই। আসবো আসবো করে আজকে সময় বের করলাম আর ভাবলাম পরীকেও সাথে করে একবারে নিয়ে আসি।"
"ভালোই করেছো। কতদিন ধরে ভাবছিলাম পরীকে একবার দেখতে পারলে অশান্ত মনটা শান্ত হতো। বুঝোই তো, একটা চিন্তা তো লেগেই থাকে।"
তাদের কথা বুঝতে পেরে আমি চুপশে গেলাম। এখানে সবাই ভাইয়াকে খুব ভালো করেই চেনে। নিজের পরিবারের পরে এই মানুষগুলোই ভাইয়ার সার্ভিস জীবন আনন্দময় করে তুলেছিল। ভাইয়ার জন্য তারা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তাদের সবার জন্যেও ভাইয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল আর ভাইয়ার পরে এখন ভাইয়ার সাথে জড়িত আমরা সবাই।
"তোমার বাবাকে একদিন নিয়ে এসো, বন্ধুর সাথে দেখা হয় না কতদিন!"
"জ্বি কাকা, একদিন সময় করে অবশ্যই নিয়ে আসবো।"
"সে আর আসবে," আকবর ভাইয়া বললেন, "চাচা তো আমাদেরকে ভুলেও গেল।" ঠাট্টার সুরে বললেও তারা জানে কারণটা কি তাও মনে তো পরে বাবার কথা।
"আসলে ভাইয়া হয়েছে কি, নূর ভাইয়া যাওয়ার পর থেকে তার সেই জীবনের সাথে জড়িত সবকিছুকে বাবা এড়িয়ে চলে। আমি তার নিজের সন্তান যদি না হতাম, পরীর শরীরে তার রক্ত না বইলে হয়তো আমাদের সাথেও সে ঠিক মত আচরণ করতো না। জানোই তো, আমাদের কারো জন্যই স্বাভাবিক ছিল না কোনকিছু।"
"স্বাভাবিক কি আর আমাদের জন্য ছিল রে সায়কা! আমরাও তো কোন কিছু মেনে নিতে পারলাম না। কি থেকে কি হয়ে গেল রে! সেদিন যদি..."
"না কাকা, আজকে ওইসব না। পুরনো কথা তুলবেন না প্লীজ।"
পরীর কথা ভেবে আমি কথা ঘুরিয়ে ফেললাম। এখনও সময় হয় নি পরীর সবকিছু জানার।
"ইম্মা, এরা কারা? আমরা এখানে কেন?"
"আমরাও তোর বাপ্পার পরিবার রে। আমাদের ছাড়া কিচ্ছু বুঝতো না তোর বাবা। আমাদের সবার আলো ছিল সে আর আজকে তুই। ভয় পাস না, আমরা তোর পর নই। এদিকে আয়।"
রিতা ম্যাডাম পরীকে কাছে ডেকে কিছুক্ষণ কথা বললো, এরপর আমি সায় দিলে তাকে নিয়ে ক্যান্টিন গেল কিছু কিনে দিবে। এর মাঝে আমি আমার জরুরী কথা শুরু করলাম।