পর্ব ১০

7 1 0
                                    

শুক্রবারে সাধারণত বাসা বাড়িতে কাজ কর্ম বেড়ে যায়। গোছ-গাছ করা, পয়-পরিষ্কার, নামাজের জন্য প্রস্তুতি এসব নিয়ে আর ছুটির দিন হ‌ওয়াতে সবাই পরিবার আর নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে। তবে পরীকে সকালে উঠিয়ে দেওয়ার পর থেকে সে এক মনে পড়েই যাচ্ছে। সামনে তার পরীক্ষা আর কেমিস্ট্রি তার মাথায় একটু কম‌ই ঢুকে বোঝা যাচ্ছে। একটা বিষয় এই নিয়ে চারবার পড়লো তাও তার চেহারায় শান্তি নেই। বুঝতে না পারলে বেশ কঠিন একটা বিষয় আমি জানি কিন্তু এভাবে সারাক্ষণ বসে পড়তে থাকলেও কোন লাভ হবে কিনা বুঝতে পারছি না। তবে কিছু বললাম না আমি। যার পড়া সেই ভালো বুঝবে কতটুকু পড়তে হবে পরীক্ষায় ভালো করার জন্য। তথ্য অনুযায়ী পরী সবসময়‌ই ক্লাসে প্রথম কাতারের বাচ্চা ছিল আর সেটা এখন তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। পড়ায় মশগুল হয়ে আছে, দিন-দুনিয়ার কোন খবর‌ই নেই।
আমি আমার বেশ কয়েকটা কাপড় ধুতে পাঠালাম, ঘর ঠিকঠাক করে আমার ব‌ই-পত্র তাকের খালি জায়গায় সাজিয়ে রাখলাম। মাঝে দিয়ে পরীকে একটু নাশতা দিয়ে নিজেও একটু পড়তে বসলাম। ডাক্তারদের আসলে পড়াশোনার কোন শেষ হয় না। সারাজীবন নতুন নতুন রোগ নিয়ে পড়তে থাকতে হয়, আইডিয়া রাখতে হয় নাহলে সেরকম রুগী হাতে পরলে ভ্যাবাচ্যাকা খেতে হয়।
আমার আবার খোলা আকাশে পড়ার অভ্যাস তাই ছাদে বসেই পড়ছিলাম যখন পাশের ছাদে সেদিন সকালের বয়স্ক দম্পত্তিকে দেখতে পেলাম। তারা সারাক্ষণ কিসের একটা চিন্তায় যেন থাকে কিন্তু কথা হচ্ছে, এটা তো নাদিমের ছাদ? তারা এখানে কি করছে?
নিজের উশখুশ মনকে ঠান্ডা করতে ভেতরে চলে গেলাম আর পরীকে ডাকলাম। পরী পড়া শেষ করে ব‌ই গোছাচ্ছিল যখন আমি ডাকলাম। আমার কাছে এসে দাঁড়ালে আমি ইশারা করে জিজ্ঞেস করি,
"মামণি, ওনারা কারা? চিনো তাদের?"
পরী একটু সময় তাদেরকে দেখে তারপর বললো,
"ইম্মা, ওনারাই তো শেরিয়ার আঙ্কেলের আব্বু আম্মু। আসো, পরিচয় করিয়ে দেই।"
কোন কিছু বলতে পারার আগেই পরী আমাকে টেনে তাদের কাছাকাছি নিয়ে গেল।
"দাদুভাই, দাদুমণি!"
"পরী মামণি যে, কেমন আছো? কি খবর?"
পরীর এক ডাকে তারা উঠে ছাদের এই কিনারায় চলে আসলো। পরীর সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করে তারা কথা বলতে শুরু করলো কিন্তু এইদিকে আমি ইতস্ততবোধ করতে লাগলাম। আজকে দিনে এখন‌ও গোসল করিনি, ঢিলা ঢালা একটা সাদা টি-শার্টের সাথে প্লাজু পরে আছি, মাথার চুল এলোমেলোভাবে খোপা করা আর এই অবস্থায় তারা আমাকে দেখবে! মানুষ কে কি বললো কখনো পরোয়া করিনি কিন্তু নাদিমের বাবা মা শোনার পর থেকে কি যেন হচ্ছে আমার ভেতর।
ধূর! কি হচ্ছে এসব? দ্রুত মাথা থেকে সব আজে বাজে চিন্তা বের করে দিলাম। এসব ভাবার কোন মানে নেই। অযথা সময় আর মুহূর্ত নষ্ট করা।
"ইম্মা, এই ইম্মা।"
নিজের ভাবনায় কখন হারিয়ে গেলাম টের‌ই পেলাম না। পরীর ডাকে বাস্তবে ফিরে আসলে এবার সে আমাকেও পরিচয় করিয়ে দিলো।
"দাদু, এই হচ্ছে আমার ইম্মা। তোমাদেরকে যার কথা বলেছিলাম সে। ইম্মা, ওনারা শেরিয়ার আঙ্কেলের বাবা মা।"
"আসসালামুআলাইকুম। ভালো আছেন আপনারা?"
নাদিমের বাবা প্রথমে উত্তর দিলেন, "ওলাইকুম আসসালাম মা। আমরা আছি বেশ। তুমি কেমন আছো?"
"জ্বি আলহামদুলিল্লাহ।"
পাশ থেকে নাদিমের মা বলে উঠলেন, "দেখছো শেরুর বাবা, মেয়েটা মাশাল্লাহ কি সুন্দর দেখতে হ‌ইছে। একদম পরীর মত দেখতে! আমাদের ছেলের সাথে কেমন মানাবে?"
"উফফ, রাবেয়া, মেয়েটা কি ভাববে বলো তো? যখন তখন শুরু হয়ে যায়ো না।"
আমি একটু গলা খাকাড়ি দিয়ে আবার তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম আর বললাম,
"আঙ্কেল আন্টি, আমাদের বাড়িতে আসেন একদিন। কথা বার্তা বলি আমরা। অনেকদিন হলো আসলাম, আপনাদের তো দেখিই নি এতদিন।"
"ওমা, শেরু তোমাকে বলে নি কিছু?" নাদিমের মা বললেন, "আমার ডাক্তার নিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলাম সবাই তাই বাড়িতে ছিলাম না বেশি একটা। হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি, মা, তুমি তো বোঝোই ডাক্তার হয়ে।"
আমি ভ্রু কুঁচকে ফেললাম ভেবে আমার কথা তারা কিভাবে জানে আর ঠিক তখন‌ই তিনি বললেন,
"তোমার ব্যাপারে শেরু আমাদের সব বলেছে। কাল তোমার অসুস্থতার সময় তোমাকে যে নিয়ে আসলো! তুমি কিছু মনে করো না মা, আমার ছেলেটা কিচ্ছু ভেবে চিন্তে করে না। হুটহাট এমন সব কাণ্ড করে! এভাবে ছাদ টপকে তোমাকে নিয়ে আসার কি দরকার ছিল? যদি কিছু হয়ে যেতো তোমাদের কারো!"
তার কথা শুনে আমার হাত থেকে ব‌ইগুলো পরে গেল। সত্যিই সে তাহলে ছাদ পারাপার করে আমাকে নিয়ে গিয়েছে! দেখে নেবো ওই নাদিমটাকে আমি! নিজেকে কি ভাবে সে?
"আন্টি, আপনার কি হয়েছে? হাসপাতালে কিসের জন্য গিয়েছেন?"
কথার প্রসঙ্গ ঘুরাতে জিজ্ঞেস করলাম তখন নাদিমের বাবা বললেন,
"জানোই তো মা, বয়স হলে নানান রোগ দেখা দেয়। তোমার আন্টির হার্টের সমস্যা দেখা দিয়েছে, কিন্তু ডাক্তার কোনকিছুই ঠিক ভাবে বলতে পারে না। একবার বলে বাইপাস করতে হবে, আরেকবার বলে রিং বসাতে হবে হার্টে। তাই একেকবার একেক ডাক্তার দেখাতে হচ্ছে।"
"আঙ্কেল, এসব আর করবেন না। বারবার ডাক্তার বদলালে আন্টির ক্ষতি আরো বেশি হবে। একেকজনের একেক কথা শুনে আপনারাও সারাক্ষণ একটা টেনশনে থাকবেন।"
"তাহলে কি করবো মা? আমরা তো আর উপায় দেখি না কোন।"
"চিন্তা করবেন না আঙ্কেল। আমার পরিচিত ভালো ডাক্তার আছে, আমি নাদিমকে বলে আপনাদের সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। চিকিৎসা নিয়ে কোন চিন্তা করতে হবে না। আমি যার কাছে পাঠাচ্ছি তিনি খুব‌ই ভালো একজন ডাক্তার, তার চিকিৎসার কোয়ালিটি খুব‌ই ভালো মাশাল্লাহ। সেই সাথে টেস্ট দিয়ে রুগীর টাকাও নষ্ট করেন না তিনি। সোজাসাপটা কথা বলবে, পুরনো রিপোর্ট দেখবে আর কাজ শুরু করবে দিবে। তার মতে রুগী তার কাছে দুইবারের বেশি আসতে পারবে না। আপনারা শুধু তার উপরে ভরসা রাখবেন, তিনি যা বলবেন সেটা মেনে চলার চেষ্টা করবেন। বাকি আর কিচ্ছু নিয়ে ভাবতে হবে না। বিস্তারিত সব তথ্য আমি নাদিমকে জানিয়ে দিবো।"
"ঠিক আছে মা। তুমি যেহেতু বলছো ভালোই হবে ইনশাল্লাহ।"
মাথা নেড়ে সায় দিলাম আর ঠিক তখন নাদিমকে ছাদে প্রবেশ করতে দেখলাম। অদ্ভূত হলেও সত্যি যে তাকে দেখলেই আমি পালিয়ে বেড়াই। সামনে থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না তাই দূরে দূরে থাকাটাই ভালো। আমিও সময় নষ্ট না করে পরীকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলাম। পরীর তারপর আমার গোসল সেরে বাকি কাজে ব্যস্ত হয়ে পরলাম।

সুহাসিনীWhere stories live. Discover now