পর্ব ৭

3 0 0
                                    


সখিনা আন্টিকে পেত্নী বলাতে পুরো ছাদজুড়ে একটা গণ্ডগোল বেঁধে গেলো। সখিনা আন্টি গিয়ে দুহাত দিয়ে জরিনার মায়ের চুল টেনে ধরে বলতে লাগলেন,
- " আমারে পেত্নী কইসোস না, দেখ এখন। এই সুন্দরী পেত্নী সখিনা আইজ তোরে টাক কইরা ছাড়বো। হুহ্!" সখিনা আন্টির কথা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই জরিনার মা সখিনা আন্টির চুল টেনে ধরলো। মানে দুজনের হাতই অপরপক্ষের চুলে।
- " আমিও পারি। আমিও তোমারে টাকলু না বানাইয়া ছাড়মু না, বেবারের কসম।" দুঃখের মাঝেও 'বেবার' এর নাম শুনে হেসে দিলাম। মা,বাবা, সুজিন, হানা সবাই মিলে এই দুজন মহিলাকে আলাদা করতে পারছেনা। দুজনই দুজনের চুল ধরে ঝুলে আছে। এমন সময় একটা অদ্ভুত আওয়াজ আসলো নিচ থেকে, আর সাথে সাথেই সব চুপ। বাড়িতে আবার চোর-টোর ঢুকলো নাকি! একদৌঁড়ে সবাই ছুটে নিচে নেমে এলাম।
নিচে এসে সবাই ড্রয়িংরুমে ছড়িয়ে পড়লাম। কোথা থেকে এলো এই অদ্ভত আওয়াজ! সবাই এদিক-ওদিক ঘুরে ঘুরে চোরকে খুঁজছি, কিন্তু কাউকেই দেখতে পাচ্ছিনা। হুট করেই এক ভয়ানক দৃশ্য দেখে বাড়িসুদ্ধ মানুষ একদম তব্দা মেরে গেলো। কী চলছে এসব! দেখলাম- আমার বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে জরিনা, আর তার পাশে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন মানুষ। সে পুরুষ নাকি তৃতীয় লিঙ্গের কেউ, সেটা বুঝার কোনো উপায় নেই। মানুষটার কোমড়ের নিচের অংশে লাল টকটকে আদিকালের একটা বেনারসি কেনরকমে প্যাঁচানো, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, চোখে মোটা করে কাজল দেয়া, আর চেহারায় প্রায় একশোগ্রাম পাউডার মাখানো। জরিনা খুব যত্নের সহিত তার হাত ধরে মুখটায় লজ্জা লজ্জা ভাব এনে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে দাঁড়ানো মানুষটার মতো জরিনাকেও একদম আলাদা দেখাচ্ছে। ভ্রুহীন জরিনাকে দেখেই কেমন যেন সাধু সাধু মনে হয়। কিন্তু পাশের মানুষটা কে! জরিনার মা দৌঁড়ে দরজার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
- " এই সঙ টারে কইত্তে তুইল্লা আনসোস রে জরি?" কথাটা শেষ হতে দেরী, " না আম্মা নাআআ" একদম বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মতো একহাত সামনে বাড়িয়ে চিৎকার করে উঠলো জরিনা। সখিনা আন্টি মুখ কুঁচকে বলে উঠলেন,
- কী না?" জরিনা পাশে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকিয়ে বললো,
- " ওরে সঙ কইবা না আম্মা। আমার ঘরের দিকে উঁকি মারতাসিলো ও। আমিও চোর ভাইব্বা ওর প্যান্ট টাইন্না ছিঁড়া ফালাইসিলাম। পরে কইলো ও নাকি এই বাড়ির পোলা। পরে ওরে আমার মনমতো মেকাপ করাইয়া ইজ্জত ঢাইক্কা আনসি।এই চোররে আমার মনে ধরছে। "  শেষ! এই 'চোর ' শব্দটা শোনার সাথে সাথেই সখিনা আন্টি যেন চিতাবাঘের মানুষ ভার্সন হয়ে গেলেন। একলাফে এসে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। সবাই চুপচাপ উনার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রায় একমিনিট ধরে সখিনা আন্টি সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকিয়ে কী যেন খুব মনোযোগ সহকারে দেখলেন। একটুপরে পেছনে ফিরে বললেন,
- " তোমরা সবাই গিয়া বইসা থাকো। আমি আইতাসি। " বলেই উনি কোথায় যেন চলে গেলেন। আমরা এই ফাঁকা সময়টাতে আবারো সেই রঙিন মানুষটাকে মন ভরে দেখতে লাগলাম। দুমিনিট পরে সখিনা আন্টি ফিরে এলেন। তার হাতে কিছু একটা আছে, কিন্তু সেটা তার আঁচলের নিচে থাকায় দেখা যাচ্ছেনা। সখিনা আন্টির এইরকম শান্ত রূপ যে ঝড়ের পূর্বাভাস, সেটা মোটামুটি আন্দাজ করতে পারছি। কিন্তু উনি কী করতে চলেছেন! সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে সখিনা আন্টির দিকে তাকিয়ে আছি, আর সখিনা আন্টি ঐ রঙচঙে মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ করেই সখিনা আন্টি আঁচলের নিচ থেকে হাতটা বের করে বড় বটিটা ঐ সঙটার গলায় ধরলেন। সবাই সমস্বরে " নাআআআ" বলে চিৎকার করে উঠলাম।
- " সখিনার বইনের বাড়িতে চুরি করতে আইসোস। আইজ আমি তোর বুকটা ফাইড়া কলিজাটা দেখমু। " সখিনা আন্টির এই ভয়ানক ডায়লগ শুনে চোরের মুখ খুলে গেলো।
- " ফুপি, আমি চোর না। আমি কিছু করিনি। " জোরে জোরে কান্না করতে করতে চোরটা বলে উঠলো কথাটা। এবার আমাদের অবাক হওয়ার সীমা ছাড়িয়ে গেলো। অরণ্য! ওর এই অবস্থা হলো কীকরে! সখিনা আন্টির কানে কিছু ঢুকেছে কিনা জানিনা। উনি এখনো বটিটা নিয়ে অরণ্যের বুকে একটু করে গুঁতো দিচ্ছেন। এবার বাবা পেছন থেকে গিয়ে সখিনা আন্টিকে বললেন,
- " আফা, ও তো অরণ্য। মাথা ঠান্ডা করেন! " এই কথাটা শোনার সাথে সাথেই সখিনা আন্টি হাতটা সরিয়ে ফেললেন। অরণ্য জোরে একটা শ্বাস ফেলতেই ঘটলো আরেক কাহিনী। বটিটা এবার ঠেকালেন জরিনার গলায়।
- " আমার ভাইপোরে তুই চোর কইলি! আইজ তোর কলিজা তো আমি বাইর করমুই। " জরিনার মা এতোক্ষণ চুপ করে ছিলো। এবার সে কোথায় যেন চলে গেলো। ফিরে এলো হাতে একটা রামদা নিয়ে। পেছন থেকে সখিনা আন্টির গলায় ঐ রামদা ঠেকিয়ে বললো,
- " আইজ জরি মরুক বা না মরুক, তোমারে আমি মারমুই। " খোদা! কাল নামু ভাইয়ার বিয়ে, আর আজ এসব কী চলছে এ বাড়িতে! মনে হচ্ছে আজ একটা খুনোখুনি হবেই। আমরা সবাই এবার চিৎকার করে কান্না শুরু করলাম, শুধুমাত্র হবি ভাই বাদে। উনি সোফায় বসে পরনের শার্টটার বোতাম খুলে ফুঁ দিয়ে শরীরে বাতাস করতে লাগলেন। এই লোকটা এমন কেন! এদিকে খুনোখুনি হয়ে যাচ্ছে, আর উনি বসে বসে হাওয়া খাচ্ছেন! নামু ভাইয়া এসে সখিনা আন্টিকে বলতে লাগলো,
- " কাল আমার বিয়ে আন্টি। দয়া করে আজ এসব ছেড়ে দিন। বিয়ের পরে আমি নিজে জরিনার কলিজা কেটে আপনার সামনে পেশ করবো। প্লিজ ছেড়ে দিন না!" নামু ভাইয়ার এই কথা শুনে সখিনা আন্টি বললেন,
- " না। পরশু তোর বউভাত। ঐদিন আমি এই জরিনার কলিজা চচ্চরি খাওয়ামু মেহমানরে। আইজই ওর কলিজা লাগবো আমার। " এই কথা শোনার পর কারোর মুখ থেকে আর কোন শব্দ বের হলো না, শুধু মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। আমরা সবাই এবার মায়ের মাথায় পানি ঢালতে লাগলাম, আর সখিনা আন্টি, জরিনার মা এখনো হাতে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হবি ভাই এবার আস্তে করে সোফা ছেড়ে দাঁড়ালো। দুহাত উঁচু করে কিছুক্ষণ ব্যায়ামের মতো এদিকওদিক করতে লাগলো। এখন কী ব্যায়ামের সময়! ভাব দেখানোর একটা সীমা থাকা দরকার।  রেগে-মেগে তার দিকে তেড়ে গিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়ালাম। হবি ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
- " হাবলির মতো আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস কেন! সরে দাঁড়া, লিলিপুট কোথাকার!" বলেই আমার কপালে একটা আঙুল দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে সখিনা আন্টির হাত থেকে বটিটা একটানে নিজের হাতে নিয়ে নিলেন। এরপর বললেন,
- " এখন ঘুমানোর সময়। যদি আপনার কলিজা বের করতে বেশি ইচ্ছে করে, তাহলে বাইরে গিয়ে এই কাজটা সেরে আসতে পারেন। গুড নাইট!" বলে জরিনার মায়ের হাত থেকে রামদা টা নিয়ে সোজা বাইরে রেখে এসে বাড়ির সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
- " সবাই নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমান। " বলে উনি চলে গেলেন। আর উনার পেছনে পেছনে সবাই চলে গেলো। আমি তখনো হাবলির মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি কাহিনী। সখিনা আন্টি জরিনার মাকে বললো,
- " হিসাবটা তুইল্লা রাখলাম। " বলে চলে গেলেন। আমি জরিনার মা আর জরিনাকে বিদায় দিয়ে দরজা বন্ধ করে ধপ করে সোফায় বসে ভাবতে লাগলাম, হবি ভাইয়ের এই একটা কথাতেই পুরো ঝামেলা মুহূর্তের মধ্যে শেষ হয়ে গেলো। তাহলে এর আগে উনি বসে বসে এতোক্ষণ তামাশা দেখলেন কেন! আরো আগেই তো ঝামেলাটা মিটিয়ে দিতে পারতেন! অদ্ভুত লোক একটা!

Secret Admirer 2Where stories live. Discover now