পর্ব ১০

6 0 0
                                    

জিমিন আর লিয়া তাদের প্রধান কাজটা শেষ করে ফেললো, কিন্তু ওদের খোঁজার জন্য সাথে করে যেই দুজনকে নিয়ে এসেছিলাম, মানে ইনহা আর ইউনা- তারা এখন নিঁখোজ। বিয়ে খেতে এসেছি নাকি খোঁজাখুঁজির কাজে, সেটা নিয়েই এখন চিন্তা হচ্ছে আমার। আবারো ঘুরে ঘুরে ঐ দুইজনকে খুঁজতে লাগলাম। স্টেজের আশেপাশে খোঁজার পর ভাবলাম, ওয়াশরুমে গেলো না তো! পা চালিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছি, এমন সময় পাশেই একটা ফাঁকা জায়গা থেকে গোঙানোর আওয়াজ পেয়ে সেখানেই থেমে গেলাম। কমিউনিটি সেন্টারে এমন আওয়াজ তো আসার কথা না! একটু ভয়ও হচ্ছে, তবুও সাহস করে সেদিকে এগিয়ে যেতেই এক ভয়ানক মূহুর্তের সম্মুখীন হলাম। কী চলছে এখানে! এই দিকটায় মানুষের চলাচল নেই বললেই চলে। একটা কোণায় তিনজন অচেনা মেয়ে গোল হয়ে বসে আছে, আর তাদের প্রত্যেকের হাতেই একটা করে জলন্ত মোমবাতি। আর সেই তিনজন মেয়ের মাঝখানে পদ্মাসন ভঙ্গিতে বসে আছে একজন সাধুবাবা। তার কোমড়ের নিচের অংশে অদ্ভুত রঙের এক টুকরো কাপড় পেঁচানো, মাথা টাক। এই জায়গাটায় আলো খুব কম আর মুখটা নিচু করে বসে থাকায় লোকটার চেহারা দেখতে পাচ্ছিনা। মেয়ে তিনজন একটু পরপরই মোমবাতিগুলো নিয়ে মাঝের লোকটার মুখের সামনে আনছে, আর লোকটা বারবার মাথাটা সরিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু এখানে হচ্ছেটা কী? মাঝের লোকটার বেশভূষা আর বসার ধরন দেখে মনে হচ্ছে কোন সাধু ধ্যানে বসেছেন। কিন্তু মেয়েগুলো হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। কমিউনিটি সেন্টারে সাধুবাবার দরবারও বসে, তা আমার জানা ছিলোনা। যখনই মেয়েগুলো মোমবাতি ঐ লোকটার মুখের কাছে নিচ্ছে, তখনই লোকটার মুখ থেকে ঐ গোঙানোর আওয়াজ আসে। ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখেই মেয়েগুলো কোন কথা ছাড়াই একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে টান দিয়ে ওদের সাথে বসালো।
- " আমি কোন সাধু বা পীরের মুরিদ না আপু। আমি এখানে আমার ভাইয়ের বিয়েতে এসেছি। " বললাম আমি। আমার কথা শুনে মেয়ে তিনজন হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি করতে লাগলো। অদ্ভুত তো! পাগল নাকি ওরা!
- " আপনারা এখানে বসে ধ্যান করছেন কেন? এটা তো কমিউনিটি সেন্টার। এসবের জন্য সাধুবাবার ডেরায় যেতে পারেন। " এবার মেয়েগুলো হা হা করে হেসে উঠে মাঝে বসা সাধুবাবাকে বললো,
- " তোরে ডেরায় নিয়ে যেতে বললো। যাবি? ঐখানে গেলে তোর হাড়গোড়ও কেউ খুঁজে পাবেনা। " কিহ্! এরা আবার কোনজাতের মুরিদ! সাধুর সাথে এভাবে তুইতোকারি করে কথা বলছে! সামনে বসা লোকটা আবার মাথা ঝাঁকিয়ে অস্পষ্ট একটা আওয়াজ করলো। কাছে এসে বসায় দেখতে পেলাম, লোকটার মুখে কিছু একটা গুঁজে দেয়া হয়েছে, যার কারণে সে কথা বলতে পারছেনা।
- " এখানে কী চলছে সেটা কি আপনারা একটু বলবেন আমাকে?" বেশ অধৈর্য্য হয়েই প্রশ্নটা করলাম আমি। এবার এদের মধ্যে একজন মেয়ে বলে উঠলো,
- " এসব সাধু, ধ্যান -ফ্যান কিছুনা। এখানে শাস্তি দিচ্ছি। " আমি অবাক হয়ে গেলাম। সাধে কী হবি ভাই আমাকে গাধী, বলদি ডাকে! হচ্ছে কী, আর আমি ভাবছিটা কী! আমি জিজ্ঞেস করলাম,
- " তার আগে বলুন আপনারা কে? আর এই লোকই বা কে? আর কোন অপরাধের শাস্তি দিচ্ছেন আপনারা?" এবার ঐ লোকটা মাথা নেড়ে নেড়ে মুখ থেকে অদ্ভুত আওয়াজ বের করে কিছু বলতে চাইলো। একজন মেয়ে বললো,
- " আমরাও বিয়েতেই এসেছিলাম। পাত্রীপক্ষ আমরা। আর এই ইঁদুরের বাচ্চাটা যে কে, তা আমরা জানিনা। " আমি বললাম,
-" আচ্ছা মানলাম। কিন্তু সে কী এমন ভুল করেছে,যার কারণে এমন অদ্ভুত রকম শাস্তি দিচ্ছেন আপনারা?" এবার মেয়েগুলো আমার দিকে ফিরে বসে বললো,
- " আমরা তিনজন এখানে একটা রুমে বসে ড্রেস, মেকাপ ঠিক করছিলাম। মেয়ে মানুষ, কতো কাজই তো থাকে। এর মাঝে হুট করেই দরজা ধাক্কা দিয়ে এই সাধু মহাশয় ঢুকে পড়লো। ভুল হতেই পারে, তাই আমরা বললাম- 'এখানে আমরা রেডি হচ্ছি, একটু পরে আপনি আসতে পারেন। ' বলেই দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। একটুপরে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি, এই বেয়াদবটা উঁকি দিয়ে দেখছে। দরজা লক করতে নিষেধ করে গিয়েছে মা। তাই লক করিনি, কিন্তু এর সুযোগে মেয়েদের ঘরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলো এই শয়তান। পরে আমরা এসে ঢ়খন বললাম, এখানে উঁকি দিচ্ছেন কেন? তখনই এই বেয়াদব কী বললো জানো? " আমার নিজেরও এবার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। এর তো চোখটাই উপড়ে ফেলা উচিৎ ছিলো। তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে বললাম,
- " কী বললো?" মেয়েটা বললো,
- " এই ইঁদুরের বাচ্চাটা এসে বলে- আমার ইচ্ছে হয়েছে, তাই উঁকি দিয়েছি। এতে দোষটা কই!" এবার আমার গা জ্বলে গেলো। কতোবড় খারাপ! দোষ করে আবার বড় বড় কথাও বলে! মেয়েটা বললো,
- " এরপর আমরাও ওকে ঘরে এনে এই সাধুবাবা সাজিয়ে টাক করে দিয়েছি। এখন ওকে মোমবাতির আগুনে পুড়িয়ে মারবো। এমন বদমাশ লোকের বেঁচে থাকার কোন দরকার নেই। " ওদের কথা শুনে বুঝলাম, ওরা সখিনা আন্টির ধরনের মানুষ। যা বলছে, তা করতে ওদের সময় লাগবেনা। ভাইয়ার বিয়েতে এতোবড় ঝামেলা হতে দেয়া যাবেনা। আমি বললাম,
- " তার আগে বলো, কে এই লোক? নিশ্চয়ই আমাদের পরিচিত কেউই হবে। " বলেই আমি ওর মাথা উঁচু করে মোমবাতির আলোটা সামনে নিতেই আৎকে উঠলাম। অরণ্য! এ কী করে সম্ভব! তাড়াতাড়ি করে ওর মুখের কাপড়টা সরিয়ে দিয়ে বললাম,
- " অরণ্য! তুমি! " মুখটা খুলতেই অরণ্য বলতে লাগলো,
- " অ্যালোহা, প্লিজ বাঁচাও! আমি আর কোনদিনও মেয়েদের দিকে তাকাবোনা। প্লিজ! " আমি বললাম,
- " তোমাকে একটা বাচ্চা এসে ডেকে নিয়ে গেলো, কিন্তু তুমি ওদের ঘরে উঁকি দিচ্ছিলে কেন?" অরণ্য বললো,
- " ছাড়ো না ঐসব। আগে আমাকে বাঁচাও। " এবার আমার রাগ আরো বেড়ে গেলো। এই ল্যান্জা এতো খারাপ! এই কারণেই হবি ভাই ওকে দেখতে পারেনা। অসভ্য কোথাকার!আমি বললাম,
- " তোমার এরচেয়েও ভয়ানক দশা হওয়া উচিৎ। ওরা তো কম শাস্তিই দিয়েছে। আমি হলে এতোক্ষণে তোমার চোখ উপড়ে ফেলতাম অরণ্য!" অরণ্য বললো,
- " প্লিজ অ্যালোহা, কিছু একটা করো! বাঁচাও আমাকে!" বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করতে লাগলাম। আমার একমাত্র ভাইয়ের বিয়ে।এমনিতেই সখিনা আন্টি যথেষ্ট ঝামেলা করে ফেলেছেন। এরপরে আরো ঝামেলা হয়ে গেলে বিয়েটাই আর হবেনা। আর সখিনা আন্টি যদি ভুলেও এসব কাহিনীটার কথা জানতে পারেন, তাহলে এখান থেকেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হবে। শুধুমাত্র নামু ভাইয়ার কথা ভেবে মেয়েগুলোকে বললাম,
- " দেখো, আজ একটা ভালো দিন। এমন সময় এসব কাজে পরিবেশ খারাপ হবে। জানি ও যেই কাজ করেছে তা ক্ষমার যোগ্য না। সাধারণ সময় হলে আমি নিজেই ওকে বড় শাস্তি দিতাম। কিন্তু এখন পরিবেশটা নষ্ট করাটা ঠিক হবেনা। প্লিজ আর ঝামেলার দরকার নেই। প্রয়োজন হলে বিয়ের কাজ মিটে গেলে বাইরে ডেকে নিয়ে ওকে শাস্তি দিয়ে দিও। আপাতত ছেড়ে দাও!" মেয়েগুলো প্রথমে একটু না না করলেও পরে ওরাও বিষয়টা বুঝতে পেরেছে। আমি অরণ্যকে বললাম,
- " ক্ষমা চাও ওদের কাছে। " বেয়াদবটা বলে,
- " তুমি আমাদের পক্ষের হয়ে এমনটা করতে বলছো অ্যালোহা?" এবার আমার ধৈর্য্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলো। এতোবড় ভুল করার পরেও ওর মুখে এসব কথা আসে কীকরে! ওকে ধরে গণধোলাই দেয়া উচিৎ। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বললাম,
- " এক থাপ্পর দিয়ে তোমার সবগুলো দাঁত ফেলে দেয়া উচিৎ। তোমার নিজে থেকে ক্ষমা চাওয়ার কথা ছিলো, সেখানে আমাকে বলে দিতে হচ্ছে কেন? তার ওপর আবার পক্ষের কথা তুলছো! " অরণ্য এবার চুপচাপ ওদের কাছ থেকে  ক্ষমা চেয়ে নিলো। মেয়েগুলো চলে যেতেই আমি বললাম,
- "তাড়াতাড়ি গিয়ে নিজের জামাকাপড় পরে নাও। সখিনা আন্টি জানতে পারলে তোমাকে জ্যন্ত মাটিতে পুঁতে ফেলবে। নামু ভাইয়ার বিয়ের উসিলায় এ যাত্রায় বেঁচে গেলে। তবে এর ফল তোমায় ভুগতে হবেই।"  বলে চলে এলাম স্টেজের কাছে।
- " তোর আদরের ল্যান্জার এই মহান কাজে গর্ব হচ্ছে? " হুট করে এই কথা শুনে পাশে তাকিয়ে দেখি হবি ভাই বসে আছেন আমার পাশে। এই লোকটা হুটহাট কোথা থেকে চলে আসে! আর এই কাহিনী উনি জানলেন কীকরে! কী অদ্ভুত ক্ষমতাসম্পন্ন লোকরে বাবা! আমি বললাম,
- " আপনি এই ঘটনা জানলেন কীকরে?" হবি ভাই চেয়ারের পেছন দিয়ে হাত এনে আমার কাঁধে রেখে বললেন,
- " তুই হয়তো ভুলে গিয়েছিস, The Hobi আমি!" আমি বললাম,
- " আজ তো ইচ্ছে করছিলো ওর চোখ দুটো খাবলে তুলে ফেলি। অসভ্য কোথাকার!" হবি ভাই আমার কানের কাছে মুখ এনে বললো,
- " এখনো বলবি সেরাতে তোকে বিয়ে করে ওর হাত থেকে বাঁচিয়ে আমি ভুল করেছি?" চমকে উঠলাম কথাটা শুনে। হবি ভাই আমাকে বাঁচিয়েছেন! তার মানে সেরাতে হবি ভাই অরণ্যকে তাড়িয়েছিলো?
- " আমাকে বাঁচিয়েছেন মানে? সেরাতে অরণ্যকে আপনিই তাড়িয়ে দিয়েছিলেন? " হবি ভাই সামান্য হেসে বললো,
- " সময় হলে সব জানতে পারবি। " আমি বললাম,
- " কবে আসবে আপনার সেই সময়? আরো দুবছর পর?" হবি ভাই এবার এক ভয়ানক কাজ করে বসলেন। আশেপাশে এতো মানুষ থাকার পরেও হবি ভাই আমাকে একটানে তার বুকে জড়িয়ে নিলেন। বরাবরের মতোই কাপঁতে শুরু করলাম। আবারো তার ভেতরের সেই ধুপধাপ শব্দে আমার ধুকপুকুনি তরতর করে বাড়তে লাগলো। চারদিকে এতো শব্দ আমার কর্ণগোচর হচ্ছেনা সেই ধুপধাপ শব্দের দাপটে। কখন যে একহাত দিয়ে তার কালো পান্জাবির পেছন দিকটা খামচে ধরে নিয়েছি, জানিনা।
- " তোর দুঃখরা ডানা মেলতে শিখেছে, কিন্তু আমার কথা কী কেউ জানে? গত দুইটা বছর কীকরে কাটিয়েছি, তা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানেনা অ্যালো। আর সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। প্লিজ, আমাকে ছেড়ে যাসনা! সব বলবো তোকে, শুধু সঠিক সময়টা আসতে দে। " তার কথাগুলো শুনে মনে হলো, আমার ভেতরে কেউ যেন ছুরি চালাচ্ছে। সত্যিই তো! একবারো কী জানতে চেয়েছি, গত দুই বছর তার কীকরে কেটেছে? অভিমানের কারণে তার ভেতরের এই ধুকপুকুনির ভাষা বুঝতেই পারিনি আমি। শক্ত করে দুহাত দিয়ে তাকে ধরে বললাম,
- " সে সময়ের অপেক্ষায় রইলাম। " হঠাৎই,
- " কীরে হবি! তুই কবে এতো রেমান্টিক হয়ে গেলি?" জিমিন ভাইয়ার কণ্ঠ শুনে এক ঝটকায় হবি ভাইয়ের বাহুডোর থেকে ছুটে এলাম। ছি ছি! এই হবি ভাইয়ের পাল্লায় পড়ে নিজের মান সম্মান আর রইলোনা! হবি ভাইয়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম, সে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বসে আছে। এই লোকের লজ্জা, রাগ,  ভালোবাসা - সবই খুব অদ্ভুত ধরনের। তবে লজ্জা বলতে কিছু আছে নাকি সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।
- " কই আর রোমান্টিক হতে পারলাম!  তোর মতো চুমু খাওয়াই তো এখনো শিখতে পারলামনা!" কণ্ঠে একরাশ হতাশার সুর নিয়ে জিমিনকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বললেন হবি ভাই। হায় খোদা! এই লোকের মুখটা কী! যা তা বলে বসে! জিমিন ভাইয়া ধপ করে হবি ভাইয়ের পাশে বসে বলতে লাগলো,
- " তা তো ঠিক বলেছিস। চুমু ছাড়া রোমান্স, নুন ছাড়া তরকারির মতো। " শুরু হলো চুমুর উপকারীতার লেকচার। চুপ করে বেঁচে থাকা সম্মানটা নিয়ে সেখান থেকে উঠে এলাম। পেছন ফিরে দেখলাম, হবি ভাই মুচকি হেসে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন।

Secret Admirer 2Where stories live. Discover now