পর্ব-১২

15 2 0
                                    

বিশাল বিশাল ঝামেলার পর ঠিকঠাকমতো নামু ভাইয়ার বিয়েটা শেষে বাড়ি ফিরে আসতেই একদম শরীরটা একদম অস্থির লাগতে শুরু করলো। সবাই নামু ভাইয়ার বাসর ঘরের আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে, আর আমি সোফায় বসে রইলাম। এতো কাহিনীর পরে নামু ভাইয়ার বাসররাতে জ্বালানোর কোন ইচ্ছা আমার নাই। এমনিতেই বেচারা সারাদিন বিয়েটা নিয়েই অনেক টেনশনে ছিলো। কিন্তু তার বন্ধুদের সামলানো সম্ভব না, তারা এখনো বন্ধ দরজার বাইরেই কান পেতে বসে আছে। এর মাঝেই কোত্থেকে যেন ইউনা হাতে করে একটা গ্লাস এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,- " সারাদিন অনেক ঝামেলা গেছে। জুসটা খা, ভালো লাগবে। " ঢকঢক করে জুসটা খেয়ে নিলাম। কিন্তু জুসের ফ্লেভারটা ঠিক সুবিধার লাগলোনা। যাই হোক, এতো গরমের মাঝে ঠাণ্ডা জাতীয় একটা কিছু পেয়েছি, এতেই শান্তি। মাথাটা ঝিমঝিম করছে,তাই চুপ করে সোফাতেই আধশোয়া অবস্থায় পড়ে রইলাম। হবি ভাই গেলো কোথায়! সে যে নামু ভাইয়ার বাসর ঘরের আশেপাশে নেই, তা জানি। উনি জীবনেও ঐসব কাজে যায়না। উল্টা অন্যকেউ উনাকে ঐসবে ডাকতে আসলে কতগুলো বকা শুনে ভদ্রমানুষের মতো পানাহ্ চেয়ে পালায়। এসব ভাবনার মাঝেই চুপচাপ পরিবেশে হঠাৎই এক বিকট চিৎকার শুনে নিজের শরীরের পরোয়া না করেই দিলাম এক দৌঁড়। একদৌঁড়ে নামু ভাইয়ার ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলাম- জিন ভাইয়া, নামু ভাইয়া আর সুহি ভাবী ঘরের বাইরে এককোণায় গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে, আর বাকীরা, মানে জিমিন, জাংকুক, তেয়, লিয়া, হানা,সুজিন ও আরেক কোণায় একজোট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সকলের চেহারাতেই আতঙ্কের ছাপ। সুগা ভাইয়া ঘুমাচ্ছে বোধয়, আর ইনহাও এসবে থাকেনা। কিন্তু বাসররাতে নামু ভাইয়া আর সুহি ভাবী বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছে কেন? আর চিৎকারটাই বা কে দিলো? পেছনে তাকিয়ে দেখলাম- মা, জরিনার মা আর সখিনা আন্টিও এসেছে। আমি নামু ভাইয়ার কাছে গিয়ে বললাম,- " কী হয়েছে ভাইয়া? তোমরা বাইরে এসে এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? " নামু ভাইয়ার মুখ থেকে কোন শব্দ বেরোচ্ছে না। এখনো ও একটা আতঙ্কে আছে। সুহি ভাবীও কিছু বলছেনা। এবার ওদের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা জিন ভাইয়া বলতে শুরু করলো,- " আজ নামুর বাসর রাত। তাই আমরা প্ল্যান করেছিলাম যেকোন একজন আগে থেকেই ওর রুমের খাটের নিচে গিয়ে লুকিয়ে থাকবো। কথা ছিলো জিমিন ঢুকবে খাটের নিচে। শেষে ও বললো, ও নাকি লিয়াকে নিয়ে যাবে, নয়তো না। এখন এটুকু খাটের নিচে দুজন মানুষ কীকরে ঢুকবে! তাই বড়ভাই হিসাবে আমিই দায়িত্বটা নিলাম। নামু আর সুহি রুমে ঢুকার আগেই খাটের নিচে লুকিয়ে পড়লাম। " জিন ভাইয়ার এটুকু কথা শুনেই সখিনা আন্টি বলে উঠলেন,- " তোগরে কী শয়তানে ২৪ঘণ্টা গুঁতাইতে থাকে নাকি? ওরে ইবলিশের সর্দার, দরকার হইলে নিজেও বিয়া কইরালা, আরেক বেডার খাটের নিচে কী ঘাস কাটতে ঢুকছিলি?" এতোক্ষণে হবি ভাইও এসে দাঁড়িয়েছে এখানে। পান্জাবি পাল্টে গাঢ় নীল রঙের থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর একটা সাদা ফুলহাতা টিশার্ট পরে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাহিনী দেখছেন তিনি। এখানে দাঁড়ানো প্রতিটা মানুষের চেহারায় চিন্তার বা কৌতুহলের ছাপ থাকলেও তার চেহারা একদম স্বাভাবিক। যেনো খুব স্বাভাবিকভাবেই সিনেমা হলে এসে সিনেমা দেখছে। জিন ভাইয়া বললো,- " বাকী কাহিনীটা শুনে নেন না! আসল কাহিনী তো এখনো বাকী। " মা বললো,- " আইচ্ছা, কও। " জিন ভাইয়া বলতে লাগলো,- " তো আমি চুপচাপ নিজের দায়িত্ব পালন করছিলাম খাটের নিচে শুয়ে শুয়ে, এমন সময় শুনলাম- নামু আর সুহি সখিনা আন্টির দেয়া ঐ থালার কাপড় সরাবে। কৌতুহলের বশে নিচ থেকে একটু সামনে এগিয়ে এলাম, যাতে থালায় কী আছে তা জানতে পারি। এর প্রায় দুই সেকেন্ড পরেই নামু আর সুহি এক চিৎকার দিয়ে খাট থেকে লাফিয়ে নেমে গেলো, আর থালাটা নিচে পড়ে গেলো। যখন আমার মুখের সামনে থালাতে থাকা সখিনা আন্টির মূল্যবান জিনিসগুলা পড়লো, তখন আমি মরতে মরতেও কোনরকমে বেঁচে বের হয়ে এসেছি। " মা জিজ্ঞেস করলো,- " কী দেখসোস ঐডা তো ক! সখিনা আফা তো কোন নিয়ম পালনের লাইগা ঐ থালা দিসিলো। কী ছিলো ঐডায়?" নামু ভাইয়া প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,- " এসব কোন নিয়ম - রীতি! আরেকটু হলে বাসর রাতেই আমরা মরে যেতাম ভয়ের চোটে। " এবার আমি বললাম,- " আরে ভাই! কী ছিলো সেটা বলবে তো!" নামু ভাইয়া বললো,- " ঐ বিশাল থালায় মোটা একটা মরা সাপ, একটা বড় মরা কেঁচো আর একটা বড় মরা চিকা ছিলো। " এই কথা শোনার পর আর কোন কথা বলার শক্তি আমার রইলোনা। বাসর রাতে এসব দেয়া কোন রীতিতে পড়ে তা আমার জানা নেই। কিন্তু ভাইয়া, ভাবী আর জিন ভাইয়ার জায়গায় আমি থাকলে ঐখানেই বমি করতে করতে মারা যেতাম, এটা নাম নিশ্চিত। " আমার মা এই প্রথমবারের মতো সখিনা আন্টির করা কোন কাজে এতোটা অবাক হলো। মা বললো,- " এডি কেন দিসেন আফা? কতো ভয় পাইসে ওরা!" সখিনা আন্টি হঠাৎই চিৎকার করে বলে উঠলেন,- " কাম হইসে। আমি সার্থক!" কিহ্! এই মহিলা পুরোপুরি পাগল হয়ে গেলো নাকি! মা বললো,- " কী কাম হইসে আফা?" সখিনা আন্টি বিজ্ঞের মতো বললেন,- " এতো রাইতে গ্রামের রাস্তা দিয়া নতুন বউরে আনসি। কতোডি পেত্নীর নজর লাগসে তুই জানোস? এর লাইগা আমি কালকেই পুকুর থেইকা সাপ মারছি, আর বাকী সব জোগাড় কইরা থালা সাজাইয়া রাখসি। যাতে বউয়ের লগে পেত্নী আইলেও এডি দেইখা বউয়ের দিক থেইকা নজর সরাইয়া লয়। " বলে একটা গর্বের হাসি দিলেন। মা কী যেন একটা বলতে গিয়েছিলো, তাকে বলার সুযোগ না দিয়েই জরিনার মা বললো,- " তাইলে তুমিই গিয়া ঐ সাপ, কেঁচোর দিকে তাকাইয়া থাকো। আমার জানামতে তোমার চেয়ে বড় পেত্নী এই দেশে আর নাই। " জরিনার মায়ের কথা শুনে মনে হলো, আজ আর নামু ভাইয়ার বাসর রাত করা হবেনা। আমার ভাবনার মাঝেই সখিনা আন্টি সোজা নামু ভাইয়ার ঘরে চলে গেলেন। ফিরে এলেন হাতে ঐ থালাটা নিয়ে। এবার বাকীরাও ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। জিমিন লিয়াকে বলতে লাগলো,- " এসব দেখার পর আমার গা গুলাচ্ছে। এদিকে আসো, একটু মনটা ফ্রেশ করি। " বলেই লিয়ার কপালে একটা চুমু খেয়ে নিলো। আর সখিনা আন্টি সেই মোটা মরা সাপটা সোজা এনে জরিনার মায়ের গলায় মালার মতো জড়িয়ে দিয়ে বললেন,- " আইজ পেত্নীর আসল রূপ তোরে দেখামু। " জরিনার মা সাপটাকে গলায় নিয়েই বললো,- " আমি ডরাই না। হুহ্! কতো সাপরে কাইট্টা ভাইজ্জা খাইসি!" এই কথা শোনার পর জিন ভাইয়া একদৌঁড়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো। মা বললো, - " নামু, তুই আর সুহি আমার লগে আয়। অন্য একটা রুম গুছায় দিতাসি। পরে আইসা সখিনা আফা আর জরিনার মারে থামামু। " বলেই ওদের নিয়ে চলে গেলো। আমরা বাকীরা সখিনা আন্টি আর জরিনা মায়ের কাহিনী দেখতে লাগলাম। হঠাৎই মনে হলো, মাথাটা যেন একটু বেশি ঘুরছে। আশেপাশের সবকিছু কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। কোথায় আছি, কী করছি - কোনকিছুই যেন আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। কোনরকমে গিয়ে একটা দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। সাথে সাথেই হবি ভাই আমার কাছে এসে বললেন,- " কীরে! শরীর খারাপ লাগছে?" আমি বললাম,- " জানিনা, কেমন যেন মাথাটা ভনভন করছে গো!" জানিনা কেন, হবি ভাই কেমন যেন অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকালেন, এরপর বললেন,- " ঐ অ্যালো! তুই কী খেয়েছিস?" অদ্ভুত তো! এই ছেলেটা এসব জিজ্ঞেস করছে কেন? আমি বললাম,- " বিরিয়ানি, মুরগী, গরু, ছাগল, মূলা ভাজি আর ইঁদুরের কোরমা। " হবি ভাই আমাকে টেনে নিয়ে এককোণায় এনে দাঁড় করালেন। এরপর বললেন,- " ভালো করে বল, কী খেয়েছিস?" - " উফফ্!ভালো করেই তো বললাম। হবিকে খেয়েছি, জরিনাকে খেয়েছি আর সখিনাকেও খেয়েছি। " হবি ভাই আমাকে ধরে সোজা করে দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেন,কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিনা। হঠাৎই হবি ভাই আমাকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। - " গাড়ির মতো ভুমভুম করে জোরে জোরে হাঁটেন। " হবি ভাই আমার কথা শুনে চোখদুটো গোলগোল করে তাকালেন। এরপর বললেন,- " তুই জুস জাতীয় কিছু খেয়েছিস?" আমি বললাম,- " খেয়েছি তো। করলার জুস,অনেক মজা। আপনি খাবেন? দাঁড়ান, এনে দিচ্ছি। " বলেই নামার জন্য হাতপা ছুঁড়তে শুরু করলাম। হবি ভাই তবুও আমাকে নামালেন না। শক্ত করে ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললেন,- " পাগলামী করছিস কেন!" পাগলামী! আমাকে পাগল বললো! এতো অপমান! আমিও বললাম,- " আপনি পাগল, বুড়া পিশাচ। " হবি ভাই বিরবির করে বললেন,- " তোর মাথাটা পুরো বিগড়ে গেছে। " বললাম,- " আমাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? পার্কে যাবো আমি। " হবি ভাই বললেন,- " এতোরাতে পার্কে ঢুকতে দিবেনা। এখন ঘরে গিয়ে ঘুমা, সকালে নিয়ে যাবো। " চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলাম। হবি ভাই আমাকে নামিয়ে দিয়ে মুখ চেপে বললেন,- " এবার কিন্তু তোকে চুমু দেবো! চুপ কর!" বাহ্! কতো ভালো! আমিও বললাম,- " তাহলে দিয়ে দেন! "হবি ভাই আমার কথা শুনে যেন আরো ভড়কে গেলো। আমাকে বললো,- " তোকে জুসটা কে দিয়েছিলো?" বললাম,- " চাঁদের বুড়ি দিয়েছিলো। বলেছে আপনাকেও খাইয়ে মাথা ঠান্ডা করতে। আপনি খেলে আপনার ফাটা মাথাটাও ঠান্ডা হয়ে জোড়া লেগে যাবে। " হবি ভাই ফুঁস করে দম ছেড়ে আবার আমাকে কোলে নিয়ে আমার রুমে এনে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। - " এখন চুপ করে ঘুমা। সকালে আমি তোকে নিয়ে পার্কে ঘুরতে যাবো। " জোরে জোরে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,- " না না না! এখনি যাবো। " হবি ভাইয়ের টিশার্টটা টানতে লাগলাম। হবি ভাই দরজাটা লাগিয়ে আমার পাশে এসে বসলেন। এরপর বললেন,- " পাগলামী করছিস কেন! বললাম তো কাল নিয়ে যাবো। " আবারো পাগল বললো! এক খাবলা দিয়ে হবি ভাইয়ের হাতটা টেনে এনে জোরে একটা চিমটি দিলাম। হবি ভাই " আউচচ্" করে উঠলেন। এরপর বললেন,- " আমাকে ব্যথা দিচ্ছিস তুই!" আমি বললাম,- " আপনিও তো দেন! খালি বারবার ডাফার ডাফার বলে আমার হাত চেপে ধরেন! আমিও তো ব্যথা পাই। " হবি ভাইয়ের চেহারাটা মলিন হয়ে গেলো। আমাকে শুইয়ে দিয়ে বললেন,- " প্লিজ অ্যালো, ঘুমিয়ে যা না!" উঠে বসে আবারো তার টিশার্ট টেনে ধরলাম। - " না না না। অ্যালোহা ঘুমাবেনা। এই জামাটা আমাকে দিয়ে দেন। আমি ঘ্রাণ শুঁকবো। " বলেই তার টিশার্টটা ধরে টানাটানি করতে লাগলাম। হবি ভাই এবার শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। এতোকিছুর মাঝে এবারো আমি তার জাদুতে বশীভূত হয়ে গেলাম। একহাতে তার টিশার্টটা খামচে ধরে রেখেই তার বুকে মাথা পেতে রাখলাম।- " নে, ঘ্রাণ শুঁকতে শুঁকতে ঘুমিয়ে পড়। আর পাগলামী করিসনা! " আমি বললাম,- " না না, আমি ঘুমাবোনা। " বলেই মাথা তুলে ফেললাম। হবি ভাই আবারো মাথাটা টেনে এনে বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,- " কপাল ভালো যে সকালে তোর কিছু মনে থাকবেনা। " আমি বললাম,- " আমাকে কী আপনার গাধী মনে হয়! আমার সব মনে থাকবে। " হবি ভাই বললেন,- " মাতাল অবস্থায় তুই এতো ভয়ানক হয়ে যাস! তোকে সামলাতে গিয়ে আমার কী দশা হচ্ছে! " - " আপনি পারফিউম দেয়া বন্ধ করে দেন, আমি আর মাতাল হবোনা। " হবি ভাই এবার হেসে দিলেন। - " তুই চুপ করবি?" চিৎকার করে বলে উঠলাম,- " নাহ্! আপনি খালি আমাকে বকা দেন। " বলেই ভ্যাঁ করে কান্না করে দিলাম। হবি ভাই এবার আমার কপালে গভীর একটা চুমু দিয়ে দিলেন। সাথে সাথেই কান্না থেমে গেলো। এই ভনভন করা মাথা নিয়েও তার হুটহাট স্পর্শের অনুভূতি থেকে বেরোতে পারছিনা। - " আর বকবোনা। তুই শুয়ে পড়, আমি ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি। " বলেই হবি ভাই আমাকে শুইয়ে দিয়ে নিজেও পাশে শুয়ে পড়লেন। তার হাতে মাথা দিয়ে শুয়ে তার সেই ঘ্রাণ নিতে লাগলাম, আর হবি ভাই আরেক হাত দিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ঘুমের মাঝেও মাথাটা যেন ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু চোখ মেলতে পারছিনা ঘুমের চোটে। হঠাৎই মনে হলো, আমার বিছানাটা বারবার উঠানামা করছে। মাথাব্যথার কারণে এমনটা হচ্ছে? ঘুমের মাঝেই এসব ভাবছি। হঠাৎই মনে হলো বিছানাটা একটু বেশিই নড়ছে। আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালাম। এখনো আলো ফোটেনি ভালো করে। পর্দার ফাঁকে হালকা আলো আসছে, আর সেই আলোতেই ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম- আমি হবি ভাইয়ের বুকে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছি। হায় খোদা! এই লোক এখানে কী করছে! কীসের মাথাব্যথা, কীসের কী! একলাফ দিয়ে উঠে বসলাম। হবি ভাই একহাতে টান দিয়ে সোজা তার বুকে এনে ফেলে চোখ বন্ধ রেখেই জড়ানো কণ্ঠে বললেন,- " আমি কোত্থেকে এসেছি, কাল রাতে কী হয়েছে এসব ভুলেও জিজ্ঞেস করিসনা। চুপচাপ ঘুমা। " বলেই আমাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে উনি আবারো ঘুমিয়ে পড়লেন। এদিকে আমারো কিছু মনে পড়ছেনা। উনি কালরাতে কোন ঘটনার কথা বললেন? রাতে সখিনা আন্টির ঝগড়া দেখছিলাম, এরপর আমি ঘুমিয়ে গেলাম কখন? উনার টিশার্টের সবকটা বোতাম ছেঁড়া। দেখে মনে হচ্ছে যেন টিশার্টের ওপর দিয়ে বড়সড় কোন ঝড় গিয়েছে। একটু নড়েচড়ে উনার বুক থেকে মুখটা সরিয়ে নিতেই আবারো তার তপ্ত নিশ্বাসে কেঁপে উঠলাম। ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে আরো বেশি মায়াবী লাগে। বাচ্চাদের মতো ঠোঁটটা উল্টে রেখেছে। সিল্কি চুলগুলো বারবার কপালে এসে পড়ছে, আর বারবারই ঘুমের মাঝেই মুখটা কুঁচকে ফেলছেন। তার গভীর শ্বাসের আওয়াজ যেন আমার শ্বাসকেই আটকে দিচ্ছে। - " না তাকিয়ে থেকে তোকে ঘুমাতে বলেছি ডাফার! এমনিতেই সারারাত ষাঁড়ের মতো আমার বুকে গুঁতোগুঁতি করে ঘুমাতে দিসনি। " আরে! ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও কেউ দেখতে পায় কীকরে! দুঃখে কান্না করে দিতে ইচ্ছে করছে। একলাফ দিয়ে উঠে বসলাম, এরপর বললাম,- " কাল রাতে কী হয়েছিলো আমার? আবারো মাথা ঘুরে পড়েছিলাম নাকি? আপনি এখানে কেন? " হবি ভাই চোখ কঁচলাতে কঁচলাতে উঠে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসলেন। এরপর বললেন,- " তুই কী করেছিস, সেটা তুই জানিস! আমাকে জিজ্ঞেস করিস কেন?" আরে! এভাবে কথা বলছে কেন এই লোক! - " হবি ভাই বলুলননা কী হয়েছিলো?" হবি ভাই বললেন,- " সখিনা আন্টির চুল টেনে ধরেছিলি। সুহিকে পিটিয়েছিস, আর আমাকে বড়সড় একটা চুমু খেয়েছিস। ব্যাস, এটুকুই। " বলেই আবারো বালিশ টেনে শুয়ে পড়লেন। হায় হায়! একি করলাম আমি! সখিনা আন্টি আর সুহি ভাবীর বিষয় তো সামলে নিতে পারবো, কিন্তু চুমু! এই কাজ করার সাহস পেলাম কীকরে! আর আমার এসব কাহিনী মনে নেই কেন! আর হবি ভাইকে ডাকতে ইচ্ছে হলোনা। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। বিছানা থেকে নেমেই মনে হলো,হবি ভাইকে আমার রুমে দেখলে তাণ্ডব শুরু হবে। আবার গিয়ে হবি ভাইকে টানতে লাগলাম। কুম্ভকর্ণের নিউ ভার্সন The Hobiর ঘুম ভাঙাতে গিয়ে আমার হাত খুলে পড়ার জোগাড় হলো, কিন্তু এই লোকের ঘুম ভাঙেনা। উপায় না পেয়ে তার টিশার্ট ধরে জোরে একটান দিতেই সেটা ছিঁড়ে গেলো। আর হবি ভাই একলাফে উঠে বসে বললেন,- " করছিসটা কী! রাতে অর্ধেকটা ছিঁড়েছিস, এখন পুরোটাই ছিঁড়ে দিলি! চাইছিসটা কী? আবারো চুমুটুমু খেতে চাইছিস? সরি, আমি যখনতখন চুমু সহ্য করতে পারিনা। যা সর, ঘুমাতে দে!" ছিহ্! কী পরিমাণ নির্লজ্জ লোক! আমি বললাম,- " আমার রুম থেকে বের হন হবি ভাই। কেউ দেখতে পেলে বিপদে পড়ে যাবো। " হবি ভাই বললেন,- " আমার কী দোষ! আমিও বলবো- তুই আমাকে টেনে এনেছিস!" হায় খোদা! এমন লোকের সাথে কীকরে সারাজীবন কাটাবো আমি! হুট করেই হবি ভাই একটানে ছেঁড়া টিশার্টটা খুলে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,- " রাতে এটার জন্য আমার বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছিস! গলায় ঝুলিয়ে রাখ!" বলেই চলে গেলেন। আমি উনার টিশার্টও চেয়েছি! কী কী করেছি আমি! রুম থেকে বের হয়ে সোজা সখিনা আন্টির কাছে গেলাম। আল্লাহ জানে আজ আমাকে টাক করে দেয় কিনা! কাল নাকি উনার চুল টেনেছি আমি! এতোবড় ভুল করলাম কীকরে! সখিনা আন্টির কাছে যেতেই দেখলাম, উনি খুব স্বাভাবিক ভাবেই আছেন। আমি কোন কথা না ঘুরিয়ে সোজাসাপ্টা বলে দিলাম,- " সরি সরি আন্টি। রাতে কী যে হয়েছিলো আমি জানিনা। আপনার চুল টেনে ফেলেছি! আমাকে মাফ করে দিন প্লিজ!" সখিনা আন্টি আমার কথা শোনার সাথে সাথেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। এরপর বললেন,- " কাইল রাইতে তোর কী হইসে ঐডাতো জানিনা। কিন্তু এহন যে তোর মাথার তার সবডি ছিঁড়ছে, এইডা বুইঝা গেছি। " অদ্ভুত! মাফ চাইলাম, আর সখিনা আন্টি এই কথা বললেন! সখিনা আন্টি বললেন, - " ওরে বলদের রাণী, তুই আমার চুল টানলি কোনকালে? মিছা কথা কইয়া মাফ চাইতাসস কেন!" তার মানে! হবি ভাই মিথ্যা বলেছেন! এই লোককে তো! এবার দৌঁড়ে সুহি ভাবীর কাছে গিয়ে বললাম,- " কাল রাতে তোমার চুল ছিঁড়েছিলাম আমি?" সুহি ভাবী বললেন,- " রাতে ঠিক করে ঘুমাওনি অ্যালোহা?" আর কোনকিছু শোনার দরকার নেই। এই লোক একটার পর একটা মিথ্যা বলেছে আমায়। রেগে মেগে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসতেই ইউনা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। হঠাৎই জাংকুক ভাইয়া বলে উঠলো,- " গাইস! গতকাল রাতে নামু ভাইয়া কী করেছে জানো?" সবাই বলে উঠলো,- " নাতো! কী করেছে? " জাংকুক ভাইয়া বলে উঠলো, - " কাল সারারাত নামু ভাবীকে তার ভয়ঙ্কর কবিতা শুনিয়েছে। ভাবী ঘুমাতে চাচ্ছিলো বারবার, তবুও ঘুমাতে দেয়নি। ঐ দেখ, বেচারী ভাবী ঘুমের চোটে টলমল করে হাঁটছে। " সবাই হা হা করে হেসে উঠলো। নামু ভাইয়া বললো,- " তুই জানলি কীভাবে? " জাংকুক ভাইয়া বললো,- " তোমার রুমে আমার ফোনের রেকর্ড অন করে রেখে এসেছিলাম তো! " নামু ভাইয়া টেবিল থেকে উঠে জাংকুক ভাইয়াকে ধাওয়া করতে লাগলো। সবাই মিলে দৌঁড়াদৌঁড়ি শুরু করলো, এর মাঝেই দরজার বেল বাজলো। আমি গিয়ে দরজাটা খুলতেই হাতে থাকা পাউরুটিটা নিচে পড়ে গেলো। এই মানুষটা এখানে! দেখলাম.....চলবে.....

Secret Admirer 2Donde viven las historias. Descúbrelo ahora