১ম পর্ব

2 0 0
                                    

সম্পূর্ণ বাড়ি রঙিন আলোতে ঝকমক করছে। রঙিন পর্দা ও আর্টিফিশিয়াল ফুলে সজ্জিত প্রতিটি কোণা। বাড়ি ভর্তি মেহমানের সমাগম। ছোট বাচ্চারা ছুটোছুটি করে খেলায় ব্যস্ত। কেউ বা খাবারে মগ্ন। সকলের মাঝে এক আনন্দ লক্ষণীয়।
সম্ভ্রান্ত আলম পরিবারের একমাত্র ছেলে আভিয়ান আলমের বিয়ে উপলক্ষে এত আয়োজন। নীলচে সাদা রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত আভিয়ান বন্ধুদের সাথে আলাপচারিতায় ব্যস্ত। কখনোসখনো মুচকি হেসে নিজের ঘাড় হাতাচ্ছে।
মায়া দূর থেকে বড় ভাইকে দেখে মুচকি হাসল। ভাইকে যে আজ ভীষণ খুশি দেখাচ্ছে। খানিকক্ষণ পর বর বেশে নববধূ আনতে যাবে। তার জীবনসঙ্গী। তার অর্ধাঙ্গিনী।
স্বস্তির এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়া জুসের গ্লাসে চুমুক দেয়। এরপর ঘুরে দাঁড়ায়। গল্প করার জন্য পরিচিত কাউকে খুঁজতে হবে৷ এভাবে একা সন্নাসী হয়ে এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা মানায় না।
চলার পথে কারো পিছু ডাকে সেকেন্ডের জন্য মায়া পিছু ফিরে তাকায়। এমন সময় কারো সাথে খুব জোরে ধাক্কা লাগলে হাতের গ্লাস থেকে খানিকটা জুস ব্যক্তিটির নীলচে সাদা শার্টের উপর পড়ে যায় এবং তৎক্ষনাৎ লালচে দাগ লেগে যায়। এক উর্ধ্বশ্বাসে মায়া পাশের টেবিল থেকে টিস্যু নিয়ে তার শার্ট পরিষ্কার করার বৃথা চেষ্টা করল।
“কি করলে এটা? দেখে হাঁটতে পার না? অন্ধ নাকি?” হঠাৎ রাগান্বিত অথচ নিচু কণ্ঠস্বরে মায়া কিছুটা আঁতকে উঠে।
তখনো ব্যক্তির মুখমণ্ডলের দিকে তাকায়নি সে। এক হাত কান অবধি উঠিয়ে আলতোভাবে কানের লতি স্পর্শ করে সে স:দুখে অপরাধ স্বীকার করে বলল‚
“আমি খুব খুব খুব ক্ষমাপ্রার্থী। আমি সত্যি দেখে চলিনি।”
“তোমার ক্ষমা প্রার্থনাতে কি আমার শার্ট পরিষ্কার হবে? দাগমুক্ত হবে? এই শার্টের দাম সম্পর্কে কোন ধারণা আছে তোমার?”
মায়া কান থেকে হাত সরিয়ে বেশ ভালোভাবে ছেলেটির মুখপানে তাকাল। শ্বেতবর্ণের দেহত্বকে কুচকুচে কালো চুল। দারুচিনির মতো চোখজোড়ায় ঘন কালো পাপড়ি এবং উপরে মোটা ভুরু যুগল। ঠোঁটজোড়া ঈষৎ বাদামি। খুব সম্ভবত ধূমপানের অভ্যাস আছে। সুঠাম দেহে সুগঠিত চোয়াল রাগ ও অহংকারে শক্ত হয়ে আছে। বেশভূষায় বুঝা যায় আভিয়ানের কোন বন্ধু।
অলক্ষ্যে মায়ার চোখজোড়া সরু হয়ে আসে। তার বাম হাত কোমড়ে বিশ্রাম নেয়। এক কাঁধে ঘাড় কিঞ্চিৎ কাত করে সেও গম্ভীর কণ্ঠে পালটা প্রশ্ন করে‚
“কত দাম?”
ছেলেটি অপ্রস্তুত হয়। ভুরু যুগল সংকুচিত করে প্রশ্ন করে‚
“মানে?”
মায়া চোখ নামিয়ে ছেলের গায়ে জড়িয়ে থাকা শার্টে ইশারা করে আবারও প্রশ্ন করে‚ “আপনার শার্টটার দাম কত? কোন ব্র্যান্ড? সাইজ কত?”
এ পর্যায়ে ছেলেটা কিছুটা ইতস্ততবোধ করে। সে এমন একটি কঠোর অভিব্যক্তির প্রত্যাশা করেনি। তবুও নিজের দম্ভ বজায় রাখতে সে শার্টের প্রাইজ সহ অন্যান্য প্রশ্নের উত্তর দেয়। কিঞ্চিৎ গম্ভীর অভিব্যক্তিতে মায়া নিজের ফোনে সবটা নোট করে নেয়। মাথা নেড়ে সে আবারও প্রশ্ন করে‚
“এবং আপনার নাম?”
“ফারাজ রিকার্দো গ্রে'সান। তোমার?”
মায়া প্রত্যুত্তর না দিয়ে তাকে পাশ কাটিয়ে ভিড়ের স্রোতে মিশে যায়। রিকার্দো ঘাড় বাঁকিয়ে খানিকক্ষণ তার হাঁটার ভঙ্গি দেখল। কী হলো? সে খানিকটা বিভ্রান্ত।
ঘণ্টাখানেক অতিক্রম হলে মায়া শপিং ব্যাগ হাতে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। এক সহকর্মীর মাধ্যমে সে রিকার্দোর গায়ের শার্টের অবিকল আরেকটি শার্ট আনিয়েছে। ভিড়ের মধ্যে উঁকিঝুঁকি করে খানিকক্ষণ খোঁজার পর সে রিকার্দো এবং আভিয়ানকে একসাথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। রিকার্দোর বারংবার শার্টের দাগের দিকে তাকানোতে সে বুঝতে পারে তাদের মাঝে খানিকক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে আলাপ হচ্ছে।
মায়া ভিড় অতিক্রম করে আভিয়ানের নিকটবর্তী হয়। আভিয়ান ছোট বোনকে দেখে মুচকি হাসলেও মায়া তার দিকে মনোযোগ দেয় না। সে রিকার্দোর দিকে শপিং ব্যাগ বাড়িয়ে দেয়। গম্ভীর কণ্ঠে বলে‚
“দেখে নিন। আপনার শার্ট ঠিক আছে কিনা।”
নির্বাক রিকার্দো ব্যাগ থেকে শার্ট বের করে। হুবুহু একই ব্র্যাণ্ডের একই শার্ট দেখে সে নির্বাক তো নির্বাকই থেকে যায়। সেকেন্ড কয়েক অতিক্রম হলে সে মাথা নেড়ে জানায়‚
“হুম‚ ঠিক আছে। কিন্তু তোমার পরিচয়?”
“আপনি আভিয়ানের কেমন আত্মীয়?”
প্রশ্নের জবাবে প্রশ্ন শুনে রিকার্দো কপাল কুঁচকালেও এক গাল হাসে। আভিয়ানের দিকে তাকিয়ে গর্বের সহিত বলে‚
“ওর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ভাই।”
চোখ সরু করে মায়া আভিয়ানের দিকে খানিকটা পিছিয়ে  যায়। ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করে‚
“ভাই‚ আমি তো জানতাম না আব্বু-আম্মুর আরেকটা ছেলে আছে। আমার আরেকটা ভাই আছে। এটা কখন হলো?”
ছোট বোনের কথা শুনে আভিয়ান হেসে উঠে। রিকার্দো যখন তাদের সম্পর্ক উপলব্ধি করল তখন তার চোখজোড়া বিস্ফোরিত। ক্রমাগত দুই ভাই-বোনের দিকে দৃষ্টির স্থানান্তর করছে সে। আভিয়ান মায়ার কাঁধে হাত রেখে পরিচয় করিয়ে বলে‚
“এই মেয়ে আমার ছোট বোন‚ মায়া। যার কথা আমি তোকে সবসময় বলেছি।”
রিকার্দো অবিশ্বাস্য স্বরে প্রশ্ন করে‚ “তোমরা সত্যি… তুমি আভির বোন?”
না বোধক মাথা নাড়ায় মায়া। বলে‚ “না। আমি ওর প্রেমিকা। ওর বিয়ে ভাঙতে এসেছি।”
মায়ার তীব্র ব্যঙ্গপূর্ণ জবাব শুনে আভিয়ান খানিকটা শব্দ করেই হেসে উঠে। হাসি থামানোর চেষ্টা করে প্রশ্ন করে‚
“কী হয়েছে তোদের মাঝে? মায়ার মনে হচ্ছে রিকার্দোর উপর ভীষণ রাগ।”
মায়া এবারও জবাব দেয় না। হাত দুটো একত্রে বেঁধে সে রিকার্দোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রাগান্বিত তার চাহনি। ঘাড়ে হাত বুলিয়ে রিকার্দো আভিয়ানকে তাদের প্রথম সাক্ষাৎ এবং দূর্ঘটনার বিষয়ে জানায়।
“আমি একটু বেশি বেশি করে ফেলেছিলাম।” রিকার্দোর অনুতপ্ত ভঙ্গি। সে আরো বলে‚ “আমায় ক্ষমা করে দাও… মায়া…।”
মায়ার নাম উচ্চারণ করতে রিকার্দোর একটু বেশি সময় প্রয়োজন হয়। মায়া জবাব দেয় না। তাদের পাশ কেটে একজন বয়স্ক লোক যাচ্ছিলেন। হাতে তার রেড ওয়াইনের গ্লাস। মায়া দ্রুত তার হাত থেকে গ্লাসটি নিয়ে হেসে বলে‚
“আঙ্কেল‚ মদ্যপান আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আপনি এটা আমায় দিয়ে জুস পান করুন।”
লোকটি মায়ার দিকে কপাল কুঁচকে তাকায়। এরপর বিড়বিড় করতে থেকে সেই স্থান ত্যাগ করে। একই হাসিতে মায়া রিকার্দোর দিকে তাকায়।
“তো‚ ফারাজ। আপনি ক্ষমাপ্রার্থী?”
রিকার্দো সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। মায়া দেরি করে না। তার মুখে গ্লাসের সম্পূর্ণ ওয়াইন ছুড়ে মারে। তার নীলচে সাদা শার্টে ওয়াইনের দাগ বসে যায়। স্তব্ধ হয় রিকার্দো। ওয়াইনে ভেজা মুখমণ্ডলের চোখজোড়া তার বন্ধ। তাদের আশেপাশে উপস্থিত লোকদের উর্ধ্বশ্বাস শুনতে পাওয়া যায়।
“এটা কোন ধরনের ব্যবহার‚ মায়া?” আভিয়ান ধমকে উঠে।
মায়ার অভিব্যক্তির কোন পরিবর্তন হয় না। সে আভিয়ানকে শান্ত অথচ কঠোর কণ্ঠে জানায়‚ “এটা কিছুই না‚ ভাই। তোর থেকে একটি কথা তোর বন্ধু গোপন করেছে। সে আমাকে টাকার অহংকার দেখিয়েছে।”
দমে যায় আভিয়ান। সে বুঝতে পারে রিকার্দোর এই অহংকারের বিষয়টি মায়ার কাছে তীর বিদ্ধের মতো কাজ করেছে।
দৃষ্টির স্থানান্তর করে মায়া রিকার্দোর দিকে তাকায়। বলে‚ “দ্বিতীয়বার আমাকে টাকার গরম দেখালে আগুনে পুড়িয়ে মারব। প্রথম ও শেষবারের মতো বলছি।”
মায়ার প্রস্থান ঘটলে রিকার্দো দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখমণ্ডলে হাত বুলিয়ে অতিরিক্ত ওয়াইন মুছার বৃথা চেষ্টা করে। চোখ স্থির হয় হাতের নতুন শার্টের দিকে। অন্তত এই দাগযুক্ত শার্টে তাকে সম্পূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠান পার করতে হবে না।

লোকটার ঘাড়ে তীক্ষ্ণ চারটি দাঁত বিঁধলে তরতাজা রক্ত সরু ছিদ্রপথে গড়িয়ে শ্বেত চামড়া রঞ্জিত করে তুলতে লাগল। লোকটা যন্ত্রণায় ছটফট করছে না। সেই সুযোগ পাচ্ছে না। তাকে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে এক বলিষ্ঠ মানবদেহে বসবাসকারী এক ভয়ঙ্কর রক্তচোষা। বেচারা লোকটির কণ্ঠনালি থেকে শুধুমাত্র গোঙানির আওয়াজ বেরুচ্ছে।
ফ্যাকাশে দেহের অধিকারী রক্তচোষা মন ভরে রক্ত শুষে পান করে লোকটিকে ধাক্কা দিয়ে পিচঢালা নির্জন রাস্তার উপর ফেলে দিল। হাতের আঙুলের সহায়তায় ঠোঁটের আশেপাশে লেগে থাকা রক্ত মুছে এনে চেটে খেলো। তার ফ্যাকাশে দেহ মুহূর্তে সুদর্শন হতে শুরু করল। বাদামি রঙের চুলগুলো উজ্জ্বলতা ফিরে পেয়ে দ্বিগুণ হলো। তার কুচকুচে কালো চক্ষুকোটর ধীরে ধীরে ধূসর হতে লাগল এবং চক্ষুমণি টকটকে লাল। এরপর চোখজোড়া সম্পূর্ণ স্বাভাবিক লালচে বাদামি রঙে ফিরে গেল। সম্পূর্ণ মনুষ্য রূপে ফিরে গেল নিশাচর। সামনে তাকিয়ে একগাল হেসে ডানদিকে নিজের কাঁধ বাঁকিয়ে নিল। চোখের পলকে বৈদ্যুতিক গতিতে একদম সন্নিকটে এসে ফিসফিস করে উচ্চারণ করল‚
“আমার প্রিয় মন-ময়ূরী…!”

চলবে………

সন্ধ্যাবন্দনা Where stories live. Discover now