১৮তম পর্ব

0 0 0
                                    

বিকালবেলা দুই বোনের মাঝে ভিডিও কলের মাধ্যমে আবারও যোগাযোগ হয়। দুই বাহুর উপর থুতনি ঠেকিয়ে বিষন্ন মনে রিদির সাথে কথা বলছে মায়া। ঠোঁটজোড়া খানিকটা ফোলানো।
রিদি খানিকটা চিন্তিত সুরে বলে‚ “হুম। সবটা শোনার পর আমি যা অনুমান করছি তা হচ্ছে‚ লোকটা তোর সাথে ‘হার্ড টু গেট’ খেলা খেলছে।”
কপাল কুঁচকে আসে মায়ার। দুই কনুইতে ভর দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় অবস্থান করে প্রশ্ন করে‚ “হার্ড টু গেট?”
“হ্যাঁ। বাহিরের দেশের ছেলেগুলো বাঙালি ছেলেদের মতো বেহায়া হয় না। ওদের মাঝে অহংকারে ভরপুর। আর রূপবান সুদর্শন হলে তো কথাই নেই। এই-সেই-হ্যান-ত্যান-ভাতের ফেন মার্কা কথাবার্তা বলে তোকে ঘুরাচ্ছে। বুঝলি? তোর দুর্বলতার মজা নিচ্ছে লোকটা।”
“কিন্তু ওর কোন রিয়েকশন কিন্তু সেসব কোন চিহ্ন বহন করেনি।”
“আমি আগেই বলেছি‚ সবটা আমার অনুমান।”
ছোট শব্দে 'হাম্' তুলে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়লো মায়া। কি যেন চিন্তা করে সেকেন্ড পাঁচেক পর হতাশাজনক দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। হতাশ হয়ে আবারও বিছানার উপর উপুড় হয়ে গা এলিয়ে দিল। বাচ্চাসুলভ কণ্ঠে প্রশ্ন করল‚
“আমি এখন কি করব‚ রিদিপু? ফাঁসুড়েটা আমাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রেখেছে। না দিচ্ছে মরতে ‚ না দিচ্ছে বাঁচতে।”
“কি আর করবি? অপেক্ষা কর। যেভাবে চেষ্টা করছিস ‚ তা অব্যাহত রাখ। বরফ মন‚ সঠিক গলনাঙ্কের সংস্পর্শে গলে যাবে।”
“আর যদি মন পাথর হয়ে থাকে?”
বিরক্তির যদৃচ্ছ এক শব্দ উচ্চারণ করল রিদি৷ বিরক্তি চেপে কিঞ্চিৎ কঠিন কণ্ঠে বলল‚ “বড় এক হাতুড়ি নিবি। এরপর ওই পাথর মন ভেঙে দিবি। নাকি পারবি না?”
মায়া জবাব দিতে চাচ্ছিল। কিন্তু বাধা দিল রিদি নিজেই৷ আবারও বলে উঠল‚ “না পারলে নাই। পরবর্তীতে আমার কানের কাছে মশা-মাছির মতো ঘ্যানঘ্যান করলে এক থাপ্পড়ে চুপ করিয়ে দিব।”
বরাবরের মতো এবারও রিদি আকস্মিক উভয়ের যোগাযোগ মাধ্যমের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল। হতাশা‚ বিরক্তি ও ক্ষোভে মায়া দাঁত কিড়মিড় করে শূন্যে হাত উঁচিয়ে আঙ্গুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো। যেন চিকন হাওয়াতে রিদি উপস্থিত এবং সে তার গলা চেপে ধরেছে। পুনরায় হতাশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে সে বিরবির করে বলে উঠল‚
“আজ অবধি যাদের প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি‚ ভাই‚ তোরা এই পাপীকে ক্ষমা করে দিস। তোদের দুঃখ আমি হারে হারে টের পাচ্ছি।” একই ভাবে সে সুর তুলে‚
“প্রেমে পড়িয়া মায়া কান্দেরে…। আম্মু…!”
হাত পা ছুড়ে গুঙিয়ে উঠে মায়া। নিজের মাঝের হতাশা‚ ক্ষোভ এভাবে দূরীভূত করার চেষ্টা।
হঠাৎ কাচ জাতীয় কিছু ভাঙার শব্দে মায়া চমকে উঠে। তার সকল সক্রিয়তা নিষ্ক্রিয় হয়। স্তব্ধ হয় সে। যখন সে শব্দের উৎস বুঝার চেষ্টা করে তখন সে দ্বিতীয় একটি শব্দ শুনতে পায়। কারো দ্রুতগামী পদধ্বনি ‚ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে।  নিঃসন্দেহে ঘরে কারো অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
মায়ার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। হঠাৎ নিজের শরীরে এক শীতল স্রোতের বয়ে যাওয়া অনুভব করলে উপলব্ধি করে সে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার শান্ত থাকা প্রয়োজন।
সে কি ত্রিপল নয় নাম্বারে কল করবে? সাহায্য চাইবে?
কি ভেবে সে সন্তর্পণে বিছানা ছেড়ে উঠে পাশের টেবিল থেকে ফল কাটার ছুরি হাতে উঠিয়ে নেয়। এরপর ধীর ও শব্দহীন কদমে বেডরুম ছেড়ে বসার ঘরটাতে এসে উপস্থিত হয়।
বাহিরের পরিবেশকে তখন অন্ধকার গিলে ফেলেছে। থেকে থেকে কোথাও বজ্রপাতও হচ্ছে। খুব সম্ভবত আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। অথবা মেঘবিহীন। জানা নেই মায়ার।
তার চঞ্চল ও ভীত চোখজোড়া চারপাশে ঘুরছে। কিন্তু তৃতীয় কোন ব্যক্তির উপস্থিতি সে অনুভব করতে ব্যর্থ। দমকা হাওয়া অনুভব করলে সে পাশ ফিরে জানালার দিকে তাকায়। রিদির সাথে কথা বলতে মগ্ন থাকায় জানালা লাগানোর কথা তার মাথা থেকে সরে গিয়েছিল। বাহিরে ঝড়ো হাওয়া বইছে। পাশেই পড়ে আছে চূর্ণবিচূর্ণ ফুলদানিটি। তাতে কাপড়ের তৈরি কৃত্রিম ফুল ছিল। তবে কি দমকা হাওয়াতে এই ফুলদানি ভাঙার শব্দ হয়েছে? তাহলে সেই পদধ্বনি? সেটা কি তার ভ্রম ছিল?
মনে মনে নিজেকে বুঝায় মায়া‚ ‘হতে পারে। সম্পূর্ণ একটি ফ্ল্যাটে একাকী বাস করা মানুষ ঝড়-বৃষ্টির রাতে এ ধরনের ভ্রমের শিকার হতে পারে।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাবধানে চূর্ণবিচূর্ণ হওয়া ফুলদানির প্রতিটি খণ্ড বেলচাতে তুলে পরিষ্কার করে নেয় মায়া। বেডরুমের দিকে ফিরে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে আশেপাশে কোথাও বিকট শব্দে বাজ পড়লে সে আঁতকে উঠে। সেকেন্ডের ভেতর বিদ্যুৎ সংযোগও বিচ্ছিন্ন হয় এবং সম্পূর্ণ ফ্ল্যাট আঁধার দানব নিজ পেটে গিলে নেয়।
ভয়টা যখন স্বাভাবিক হতে শুরু করে তখন মায়া মোমবাতি জ্বালাতে এগিয়ে যায়। হাতড়ে ড্রয়ার থেকে মোম নিয়ে তা জ্বালানোর চেষ্টা করে সে। কিন্তু তার সমস্ত শরীর কাঁপছে।
দ্বিতীয়বার বাজ পড়ল। আলোর ঝলকানিতে তার সামনের দেয়ালে এক পুরুষ ছায়া স্পষ্ট ভেসে উঠল। আঁতকে ওঠে ভয়ে দুই কদম পিছিয়ে গেল মায়া। বিস্ফোরিত চোখজোড়া অন্ধকারের মাঝে চারপাশে দেখার বৃথা চেষ্টা করছে। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে সে। বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। মাথাটাও কেমন ঝিমঝিম করছে। সেই সাথে সেকেন্ড কয়েক বিরতি নিয়ে শরীরে শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে।
মিনিট দুয়েক অতিক্রম হলে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় পেছনে কারো উপস্থিতি সম্পর্কে জানান দেয়। ভয়ে শরীর যেন তার অসাড় হয়ে গেছে। নড়াচড়ার শক্তি সঞ্চয় করতে পারছে না। পরমুহূর্তে চুলে কারো নিঃশ্বাস অনুভব করতে পারলো। সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল তার। চোখজোড়া দ্রুত বন্ধ করে নিল। যেন সে হাওয়াতে অদৃশ্য হয়ে গেছে‚ এমনটা ভাবতে লাগল।
পেছনের উপস্থিত ব্যক্তিটি হঠাৎ মৃদু শব্দে হেসে উঠল। সেই শব্দে হুমকি নেই৷ আছে ভিন্ন কিছু। মুখ বাড়িয়ে মায়ার কানের নিকটে মুখ নিয়ে নিগূঢ় কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলল‚
“এতটুকুতেই এমন ভয়! সম্পূর্ণ সত্য উদঘাটন করার পর কি দশা হবে তোমার?”
লোকটার কথার আগা-গোড়া কিছুই মায়ার বোধগম্য নয়৷ সে শুকনো এক ঢোক গিললে পেছনে উপস্থিত ব্যক্তির একই মৃদু শব্দের হাসি শুনতে পায়। এই মুহূর্তে কি জবাব দিবে সে? কোন জবাব দেওয়া কি উচিত হবে?
তৃতীয়বারে তুলনামূলক অধিক শব্দ করে বাজ পড়লে মায়া আঁতকে উঠে। শরীরে জোরপূর্বক শক্তি সঞ্চয় করে বন্ধ চোখে অনুমানের উপর ভিত্তি করে একদিকে ছুটে যায় সে। দৌড়ানোর সময় ভুলবশত দরজায় ধাক্কা লাগায় হাতের বাম বাহুতে আঘাত পায় সে। সেই সাথে কাপড় ছেঁড়ার শব্দও হয়। সেদিকে খেয়াল না করে সে দ্রুত ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেয়। দরজা থেকে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে অন্ধকারের মধ্যে সম্মুখে তাকিয়ে থাকে সে। থরথর করে সমস্ত শরীর কাঁপছে তার। ঠান্ডায় অথবা ভয়ে অথবা উভয় কারণেই।

You've reached the end of published parts.

⏰ Last updated: Oct 13 ⏰

Add this story to your Library to get notified about new parts!

সন্ধ্যাবন্দনা Where stories live. Discover now