“আপা‚ মানুষ প্রেমে পড়লে কেমন আচরণ করে?”
বুকের বালিশ চেপে ধরে মায়া প্রায় অস্ফুটস্বরে প্রশ্ন করে। দৃষ্টি তার ল্যাপটপের স্ক্রিনে নিবদ্ধ। রিদি তখন তার সাথে ভিডিও কলে কথা বলতে বলতে কিছু রিপোর্ট ঘাটছিল। তার এমন প্রশ্নে সে সন্দিহান দৃষ্টিতে স্ক্রিনের দিকে ফিরে তাকায়। হাতের কাগজগুলো একপাশে রেখে ল্যাপটপের দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে পালটা প্রশ্ন করে‚
“ছেলেটা কে?”
মায়া কিঞ্চিৎ বিরক্তবোধ করে। প্রত্যুত্তরে কপাল কুঁচকে আবারও প্রশ্ন করে‚
“বলো না‚ মানুষ প্রেমে পড়লে কেমন আচরণ করে?”
“একেকজন একেক আচরণ করে।”
“এটা কোন উত্তর হলো নাকি? তোমার প্রথম প্রেম নিয়ে বলো তো।”
সহাস্যে রিদি প্রশ্ন করে‚ “প্রেমগাঁথা বলব নাকি অনুভূতিগুলো?”
তুড়ি বাজিয়ে মায়া স্বাভাবিক সস্মিত অভিব্যক্তিতে বলে‚ “এবার বলেছ সঠিক শব্দ। অনুভূতি। ওটাই জানতে চাচ্ছি।”
রিদি খানিকক্ষণ চিন্তা করার অভিনয় করে মায়ার বিমর্ষ অভিব্যক্তি দেখার অপেক্ষা করে। আড়চোখে স্ক্রিনে ভেসে থাকা মায়ার ছবির দিকে তাকালে সে আবারও বিরক্তিকর শব্দ করে উঠে। অপ্রসন্ন বাচ্চার মতনই নড়াচড়া করে আহ্লাদী কণ্ঠে বলে উঠে‚
“আপু‚ মজা নিও না। বলো‚ প্লিজ।”
মুক্তকণ্ঠে হেসে উঠে রিদি। “ঠিক এই অনুভূতিগুলোই অনুভব করা হয় যা তুই এই মুহূর্তে করছিস।
প্রেমে পড়লে ধ্যান-জ্ঞান সমস্ত জুড়ে কেবলমাত্র সেই লোকটির বিচরণ ঘটে। আধ্যাত্মিক কাজের ফাঁকেও হুট করে তার মুখমণ্ডল স্মরণ হয়। তখন বেশ বিরক্তবোধ হয়। কিন্তু সহাস্যে বিরক্তবোধ। অদ্ভুত প্রশান্তি মনকে ছেয়ে যায়। অধৈর্য্য মন ছটফট করতে থাকে তাকে আরো একটিবার দেখার আশায়‚ তার মুখনিঃসৃত একটি শব্দ শোনার আশায়। পড়ন্ত বিকেলে অথবা চন্দ্রাকর রাতে একান্তে বসে তার কথা ভাবতে বড় স্বাদ জাগে। নিজের পাশে কল্পনা করতে স্বাদ জাগে। মনে হয় তাকে পেলে বুঝি স্বর্গলাভ হবে।”
রিদি থামল। ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকালে সে দেখতে পেলো তার ছোট বোনটি ল্যাপটপের সামনে বসে থাকলেও তার ধ্যান-জ্ঞান… সম্পূর্ণ মনোযোগ অন্যত্র। অনির্দিষ্ট কোনদিকে সে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে তার মুচকি হাসি। শোণিমার চলন ঘটেছে তার দু গালে। নিঃসন্দেহে সে প্রেমে পড়েছে।
গলা ঝেড়ে মায়ার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে রিদি। সফলও হয়। মায়া সচকিতে ফিরে তাকায়। অত:পর সলজ্জ হাস্যে উন্মুক্ত চুলে হাত বুলিয়ে বলে‚
“হ্যাঁ‚ ঠিকই ধরেছ‚ আপু। আমি বোধহয় প্রেমে পড়েছি।”
“তা মেডাম‚ কে সেই সৌভাগ্যবান?”
অস্ফুট অর্থহীন এক শব্দ করে মায়া জবাব দেয়‚ “জানি না।”
রিদি কিছু জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করে। তার ঈষৎ ফাঁকা ঠোঁটজোড়ার কম্পন খেয়াল করে মায়া আগ বাড়িয়ে বলে উঠে‚
“বলছি‚ বলছি। সব ঘটনা বলছি। একটু সবুর করো তো।”
এরপর মায়া একে একে সব ঘটনা খুলে বলতে থাকে। রিদি অবাক হয় না। বরং তার অভিব্যক্তি স্বাভাবিক। কেবলমাত্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলে‚
“তোর থেকে এমনটাই আশা করেছি আমি। ভালো লাগার পুরুষ হোক বা শত্রু‚ তুই আভিয়ান ব্যতীত সব পুরুষের সাথেই কুঁদুলির মতন আচরণ করিস।”
মায়া জবাব দেয় না। হতাশাজনক নিচু দৃষ্টিতে শুধুমাত্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রিদির একটি হাত এগিয়ে এলো। যেন ল্যাপটপের স্ক্রিন ভেদ করে ছোট বোনটির হাত চেপে ধরতে চাইছে।
“শোন‚ প্রিন্সেস। কানাডাতেই তো আছিস। সৌভাগ্যক্রমে দ্বিতীয়বার দেখাও হতে পারে।”
“দেখা হলেই কি হবে?”
“দেখা হলে সব হবে। তোকে শুধু নিজের মন যা বলে চায় তা শুনতে হবে। অতীত কি বলে তা নয়।”
“আমার মন বলে ‘পুরুষদের বিশ্বাস করতে নেই। সব পুরুষ এক স্বভাবের’। ”
“আভিয়ান কি তোর কথিত ‘সব পুরুষ’ এর কাতারে পড়ে?”
“ও তো আমার ভাই!”
“আর সে তোর হবু প্রেমিক। এরপর হবু স্বামী। তারপর পূর্ণাঙ্গরূপে তোর স্বামী।”
মায়ার মুখটা কিঞ্চিৎ বিকৃত হয়ে আসে। ল্যাপটপের দিকে মুখ বাড়িয়ে প্রশ্ন করে‚ “হবু প্রেমিক?!”
“হ্যাঁ। হবু প্রেমিক। প্রেম হওয়ার পথে। দ্বিতীয় সাক্ষাতের অপেক্ষা মাত্র।” স্বল্প সময়ের বিরতি নেয় রিদি। জিহব দিয়ে নিজের ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে আবারও বলতে আরম্ভ করে‚ “শোন‚ আমি যা বলব ঠিক তাই করবি।”
মায়া আপত্তি করার চেষ্টা করে। কিন্তু রিদি তাকে থামিয়ে দেয়।
“এরপর সাক্ষাৎ হলে সেটা দ্বিতীয় সাক্ষাৎ হবে‚ তাই না? আমি এটাকে বলব পূর্বরাগ। পূর্বরাগের সময়কালে পরিচয় পর্ব অতিক্রম করে সম্পর্কের একটা নাম দিতে হয়৷ সেই নাম হচ্ছে ‘বন্ধুত্ব’। এই পর্যায়ে তুই তোর হবু প্রেমিককে সময় নিয়ে জানবি‚ বুঝবি। ওর ইতিহাস নিয়ে ঘাটাঘাটি করবি। 'পূর্বরাগ' ধাপে আপাতত এটুকুই তোর কাজ।”
মায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবং বিরক্তি প্রকাশ করতে কেবল চোখ উলটায়। খানিকক্ষণ মৌনপালনের পর সে ফিরে তাকায় ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে। জবাব শুনতে অপেক্ষারত রিদির পানে তাকিয়ে সে শ্লেষাত্মক প্রশ্ন ছুড়ে‚
“ প্রেমবিজ্ঞান নিয়ে কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছ?”
“সেটা তোর জানতে হবে না। বর্তমানে আমি প্রেমবিজ্ঞান বিষয়ের অধ্যাপক। এবং তুই আমার শিষ্য। যেমনটা যেভাবে দিকনির্দেশনা দিব‚ তার পরীক্ষালব্ধ ফলাফল আমাকে জানাবি।”
“পারব না।”
“তোর 'পারব না' চুলোয় যাক। যাচ্ছি এখন। আগামীকাল নতুন খবর জানতে আবারও কল করব। আগামীকাল তোর অবসর সময় কখন?”
“সত্যি?” মায়া অপ্রসন্নে মুখ বাড়ালো। “তোমার ধারণা আজ রাত এবং আগামীকাল সন্ধ্যার ভেতর আমি সেই আহাম্মকের সন্ধান পাব?”
সংকুচিত কপালে রিদি নিজ কণ্ঠস্বর ম্লান কঠিন করে আদেশ করে‚ “প্রথমত‚ লোকজনকে সেসব শব্দে সম্বোধন করা বন্ধ কর যেসব অতি সহজে রাগের কারণ হবে এবং তোকে অপছন্দনীয় করে তুলবে। দ্বিতীয়ত‚ মন দিয়ে খুঁজলে ঈশ্বরকেও পাওয়া যায়। নির্ভর করে হৃদয়বাসনার অত্যুগ্রতার উপর। আগামীকাল সন্ধ্যায় কল করব তাহলে।”
রিদি অপেক্ষা করে না। সে উভয়ের যোগাযোগ মাধ্যমের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। মায়াকে কিচ্ছুটি বলার সুযোগও দেয়নি। বিকৃত মুখভঙ্গিতে মায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রিদি তাকে এ কোন মুসিবতে ফেলল! মানুষটা তার মনের‚ অথচ তাড়া সব তার বড় বোনের। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। অগত্যা সে বিছানা ছেড়ে বাহিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে উঠে।
VOUS LISEZ
সন্ধ্যাবন্দনা
Vampire"আমি তোমার জীবনের এমন এক অধ্যায় যার সূচনা তোমার হাতে হয়েছিল‚ মন-ময়ূরী। যাকে তুমি স্বেচ্ছায় আশ্লেষে আলিঙ্গন করেছিলে। কিন্তু এই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি লিখব আমি। এবং কেবলমাত্র আমি।"