বছর খানেক আগে……
স্কলারশিপ নিয়ে বাহিরের দেশ থেকে ডিগ্রি অর্জনের স্বপ্ন ছোটবেলার। একটা সময় সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করে কানাডার মাটিতে পা রাখতে সফল হয় মায়া। পড়াশোনা শেষে ডিগ্রি অর্জন করে অবশেষে যখন সে একজন কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে নিজের আত্মপ্রকাশ ঘটাতে পারল‚ তখন কানাডার মাটিতে থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা তার ছিল না। স্বদেশ মায়ের কোলে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা-ই ছিল তার। সেই খুশিতে সে কানাডার বন্ধুবান্ধবদের থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায়ও নিচ্ছিলো। ফিরে যাওয়ার সব ধরনের প্রস্তুতি সে নিচ্ছিল।
এক রাতে নিজের রুমে বসে নিজের জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য কিছু বই ঘাটাঘাটি করছিল সে। গভীর মনোযোগী। হঠাৎ তার মনোযোগ রুক্ষভাবে ভঙ্গ করে একটি ফোন কল। বিরক্তিকর চিত্তে মায়া এক হাত বাড়িয়ে টেবিলের এক পাশে রাখা মোবাইল ফোনটি হাতে তুলে নেয়। কলার আইডি খেয়াল না করে কল রিসিভ করে কান অবধি নিয়ে থমথমে গলায় প্রশ্ন করে‚
“হ্যালো?”
“আমার লক্ষীসোনার মন খারাপ?” অপর প্রান্ত থেকে রিদি সস্মিত চিত্তে প্রশ্ন করে উঠে। “কার এত বড় স্পর্ধা যে আমার প্রিন্সেসের মেজাজ বিগড়ে দিয়েছে?”
মুহূর্তে মায়ার অভিব্যক্তি পুলকিত হয়ে উঠে। এক হাতে মেলে রাখা বইগুলো বন্ধ করে সেও হেসে প্রশ্ন করে‚
“কেমন আছ‚ আপু?”
“বেশ তো ছিলাম। কিন্তু বোনের থমথমে স্বর শুনে এখন ভালো নেই। মন খারাপ কেন?”
তড়িঘড়িতে মায়া জবাবে বলে‚ “আরে না‚ না। তুমি যা ভাবছ তা না। আমি বই পড়ছিলাম। হঠাৎ কল আসায় বিরক্তবোধ করা। এই আরকি।” সে কথার মাঝে বিরতি টানে। রিদিকে কিছু বলবার সুযোগ দেওয়ার আগেই সে জবাবে বলে উঠে‚ “হ্যাঁ‚ আমি রাতের খাবার খেয়েছি। ঔষুধও নিয়েছি। বেশি রাত জাগব না। জলদি ঘুমিয়ে পড়ব।”
অপর প্রান্ত থেকে মায়া মৃদু হাসি শুনতে পায়। সে নিশ্চিত রিদি এই মুহূর্তে মৃদুভাবে মাথা দুলাচ্ছে এবং অস্ফুট ও অশ্রবণীয় ভঙ্গিতে ঠোঁট নাড়িয়ে বলছে‚ ‘পাগলী আমার।’
উৎফুল্ল নীরবতা ভেঙে মায়া ফের প্রশ্ন করে‚ “তুমি তোমার খবর শোনাও। সুস্থ আছ তো? নাকি আবার অসুস্থতা বেড়েছিল?”
“সুস্থ আছি। মাঝে শ্বাসকষ্ট একটু বেড়েছিল। তবে চি—।”
রিদির অসম্পূর্ণ বাক্য মাঝ পথে কেটে মায়া খানিকটা রাগান্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে‚ “শ্বাসকষ্ট বেড়েছিল? কেন? নিজের যত্ন নাও নি? নাকি ঔষুধ নেওয়াতে বিরতি ঘটিয়েছ।”
“শান্ত হো‚ মায়া। সেসব কিছুই না। মাঝে এক দিন অতিরিক্ত বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম। এজন্য।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়া। কথা বাড়ায় না। শুধুমাত্র ছোট ‘ওহ’ শব্দ উচ্চারণ করে। এই বিষয়ে রিদিকে সে কিছু বলবে না। বকাবকিও করবে না। কারণ একই নায়ের মাঝি সেও। মাইগ্রেন ব্যথা হবে জেনে সেও কতবার এমন বৃষ্টিতে ভিজেছে! নিজেকেই শোধরাতে পারেনি সে। বড়বোনকে কীভাবে বকাবকি করবে?
“প্রিন্সেস‚ একটা ভালো খবর আছে।” রিদি প্রফুল্ল চিত্তে জানায়‚ “আঙ্কেল ফিরে এসেছেন।”
রিদির প্রত্যাশিত কোন প্রতিক্রিয়া মায়ার মাঝে ঘটল না। বরং তার অভিব্যক্তির অবশিষ্ট হাসিটুকু‚ আনন্দটুকু চিকন হাওয়ায় বিলীন হয়ে গেল। ভ্রূ যুগল একত্রিত করার বৃথা চেষ্টা করে সে চাপা রাগ মিশ্রিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল‚
“কবে ফিরেছে?”
“এইতো দুইদিন হলো। খালামণির কাছে ক্ষমাও চেয়েছে। তোর পরিবার আবারও পূরণ হয়ে গিয়েছে‚ মায়া। ঠিক যেমনটা তুই চেয়েছিলি।”
“চেয়েছিলাম।” শব্দটা জোরালোভাবে উচ্চারণ করে মায়া বিষয়টি যে অতীত তা নিশ্চিত করে। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দেয়। শরীরটা হঠাৎ করে দুর্বল অনুভূত হচ্ছে তার।
“তুই অসন্তুষ্ট‚ মায়া। কিন্তু কেন?”
“লোকটাকে কি এখন আমার জীবনে প্রয়োজন?”
“এসব কি বলছিস? বাবা-মায়ের প্রয়োজন জীবনের আদি থেকে অন্ত অবধি। কি হয়েছে বল তো?”
মায়া আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শরীর ঠেলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। এগিয়ে যায় বিছানার দিকে। শক্ত তোষকের ঠিক মধ্যেখানে বসে একটি বালিশ বুকে টেনে নেয় সে।
“নতুন করে কিছুই ঘটেনি‚ রিদিপু। তুমি বেশ ভালোমতো জানো যে লোকটা আমাদের জীবনে দীর্ঘ আটটি বছর অনুপস্থিত ছিলেন। আটটি বছর! একটি মেয়ের জীবনের যেই পর্যায়ে একটি শক্ত খুঁটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন‚ একজন বাবার ছায়া সর্বাধিক প্রয়োজন তখন কিন্তু তিনি জীবিত থেকেও আমার জীবনে অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি এমন একজন নারীর সঙ্গে ভোগ-বিলাসিতা করে দিন কাটিয়েছেন যে আমার মা না। নিজের ক্যারিয়ারের কথা মাথায় না রেখে আভিয়ান আমাকে আজ এতদূর অবধি নিয়ে এসেছে। বড় ভাই হয়ে বাবার দায়িত্ব পালন করেছে। অথচ আমি কিন্তু এতিম ছিলাম না।”
বলতে বলতে মায়ার কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে আসতে আরম্ভ করে। শব্দগুলোও খানিকটা অস্পষ্ট এবং জড়ানো। গলার মধ্যে পাকানো কান্না কম্পিত শ্বাস-প্রশ্বাস আটকে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কম্পিত উর্ধ্বশ্বাসে মায়া আরো যুক্ত করে‚
“আ–আট বছর আগের অত্যা-চার না-ইবা ধরলাম।”
রিদি অপর প্রান্ত থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে দিব্যি মায়ার অবস্থা বুঝতে পারছে। এই প্রসঙ্গ তোলার কারণে এখন সে অনুতপ্ত। বেশ তো হাসিখুশি ভাবেই কথা বলছিল মেয়েটা। বিমর্ষ কণ্ঠে রিদি বলে‚
“ঠিক আছে‚ লক্ষীসোনা। বুঝতে পেরেছি। তোমাকে আর বলতে হবে না। এসব আমার অজানা কিছু না। আমি শুধু…।” আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলতে সে বিরতি নেয়। তার ইচ্ছে করছে এক ছুটে ছোট বোনটিকে বুকে জড়িয়ে নিতে। কিন্তু তা অসম্ভব। দু’জন পৃথিবীর দুই ভূ-খণ্ডে অবস্থান করছে।
“আমি ভেবেছিলাম তুই হয়তো খুশি হবি। তোর তো সম্পূর্ণ পরিবার ফিরে পাওয়ার ইচ্ছা ছিল।”
“আপু‚ আমার ঘুম পাচ্ছে‚” কম্পিত কণ্ঠে মায়া জানাল। কিন্তু তার ঘুম পাচ্ছে না। প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। “এখন কল রাখি? পরবর্তীতে আমি সময় করে কথা বলব।”
প্রশ্ন করলেও সে উত্তরের প্রতিক্ষায় থাকে না। পরমুহূর্তে কল কেটে দিয়ে বুকে জড়ানো বালিশে মুখ চেপে হু হু করে কান্না করে উঠে।
YOU ARE READING
সন্ধ্যাবন্দনা
Vampire"আমি তোমার জীবনের এমন এক অধ্যায় যার সূচনা তোমার হাতে হয়েছিল‚ মন-ময়ূরী। যাকে তুমি স্বেচ্ছায় আশ্লেষে আলিঙ্গন করেছিলে। কিন্তু এই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি লিখব আমি। এবং কেবলমাত্র আমি।"