৪র্থ পর্ব

1 0 0
                                    

কানাডিয়ান প্রদেশগুলোর মধ্যে নোভা স্কটিয়া অন্যতম একটি। নোভা স্কটিয়ার  হান্টস কাউন্টির পূর্ব হান্টস জেলার পৌরসভায় অবস্থিত ছোট শহর রেনফ্রু। বর্তমানে রেনফ্রু একটি পরিত্যাক্ত শহর । যার কারণে এটি ‘গোস্ট টাউন’  নামে অধিক পরিচিত৷ প্রিন্স এডওয়ার্ড ‘ব্যারন অফ রেনফ্রু’ উপাধি ধারণ করার পর তার জন্য এই শহরটির নামকরণ ‘রেনফ্রু’ করা হয়েছিল। বলা হয়  মেরিটাইমসের সবচেয়ে সফল সোনার খনির স্থান ছিল এই গোস্ট টাউন রেনফ্রু।
বর্তমানে রেনফ্রু ঘন জঙ্গলে ঘেরা এক বনভূমি। সেই জঙ্গলের মাঝে হলুদ ও কালো রঙের মিশ্রণে রাঙা স্পোর্টবাইক থামিয়ে সে ডানে-বামে বিভক্ত হওয়া দুটি পথের দিকে বারংবার দৃষ্টির স্থানান্তর ঘটাচ্ছে। কালো হেলমেটের ফেস শিল্ড উপরে উঠিয়ে রাখার কারণে তার কুঁচকানো ভুরু যুগল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেই চাহনিতে একরাশ বিরক্তি এবং সুপ্ত এক ক্ষোভ। পরনের লেদার জ্যাকেটটার চেইন গলা অবধি উঠানো। রোদে চিকচিক করছে তা। কালো গ্লাব্স পরিহিত হাত দুটোর নখ বাইকের গায়ে অনবরত শব্দ করে নির্দিষ্ট একটি গানের সুর তৈরিতে ব্যস্ত।
বেশ খানিকক্ষণ সময়ের দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর সে ডানের রাস্তায় স্পোর্টসবাইক চালাতে আরম্ভ করে। দুপাশের ঘন জঙ্গল পিচঢালা অথচ ভাঙা রাস্তাকে ক্রমান্বয়ে সরু করে তুলছে। খানিকটা পথ মোটামুটি ভালো থাকলেও পরের পথটুকু চলার অযোগ্য। রাস্তার মাঝে বড়বড় গর্ত হয়ে পানি জমে আছে। কোথাও কোথাও এমন অবস্থা যেন এটি নদী হতে গিয়ে ভুলবশত রাস্তা হয়ে গিয়েছে।
নোংরা ও ঘোলাটে পানিকে পরোয়া না করে সে বাইক চালিয়ে যাচ্ছে। নোংরা পানিতে তার বাইক এবং কালো জিন্সের একাংশ ভিজে যাচ্ছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার৷ গন্তব্যে পৌঁছানো তার নিকট অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
বেশ অনেকটা পথ অতিক্রম করার পর সে অদূরে একটি কুটির দেখতে পায়। টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে সেই কুটির থেকে। সে কুটিরের ঠিক সম্মুখে বাইক থামিয়ে হেলমেট খুলে নেয়। এরপর বাইক থেকে নেমে ভারী কদম ফেলে প্রবেশ করে কুটিরের অভ্যন্তরে।
একটি পেন্টাকলের মধ্যখানে বসে আছে এক কৃষ্ণকেশী সুন্দরী যুবতী। পরনে তার খুব ঢিলেঢালা লাল রঙের লম্বা পোশাক। পঞ্চভুজের পাঁচ কোণায় পাঁচটি সাদা মোমবাতি জ্বলজ্বল করছে। থেকে থেকে নৃত্য করে উঠছে সেই মোমবাতির জ্বলন্ত শিখা। পেন্টাকলের ভেতরে বসে থাকা যুবতীর চোখজোড়া বন্ধ। বিরবির করে কিছু পাঠ করছে সে। সামনে রাখা কাঁচ পাত্রে সবুজ রঙের এক অদ্ভুত তরল‚ আগুন বা আঁচ ছাড়াই টগবগিয়ে ফুটছে।
কাঠের মেঝেতে তার প্রতিটি কদম ক্যাচক্যাচ শব্দের সৃষ্টি করছে। তার ছায়া ঘরে পড়তেই শুভ্র মোম পাঁচটি এক ধমকা হাওয়ায় নিভে গেল‚ কুচকুচে রঙ ধারণ করল। পাত্রের সবুজ তরলের টগবগানোও থেমে গেল। যুবতী মেয়েটির কপালে দুটো ভাঁজ পড়ল৷ অস্বাভাবিক বিষয় এবং ঘরে দ্বিতীয় কারো উপস্থিতি উপলব্ধি করতে তাকে চোখ খুলতে হলো না। চোখ বন্ধ অবস্থায় সে  কণ্ঠে উগ্রতা প্রকাশ করে উচ্চারণ করল‚
“রিয়ন ওয়ালেস্ এডরিন।”
মেয়েটি চোখ মেলে উপরে তাকালে রিয়নের দাম্ভিক বাঁকা হাসি দেখতে পায়। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে সে। হাত দুটো বুকের নিচাংশে বাঁধা। সে চাপা কণ্ঠে বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে বলল‚
“ওহ‚ এতো আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন নেই‚ এলিথ। এখন আমি আমার রাজ সিংহাসনে অবস্থান করছি না।”
এলিথ রিয়নের বিদ্রুপাত্মক জবাবকে অবজ্ঞা করল। নিজের স্থানে অনড় থেকে সে আবারও প্রশ্ন করল‚
“এতটা পথ অতিক্রম করে আমার কুটিরে উপস্থিত হওয়ার উদ্দেশ্য?”
নিজের শরীর ঠেলে রিয়ন দেয়াল ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। পাশেই রাখা বেতের তৈরি চেয়ারটাতে বসে সে চিত্তাকর্ষক হাসিতে মাথা নাড়ল।
“সরাসরি কাজের প্রসঙ্গ লাফিয়ে পড়া… এটা আমার পছন্দ।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেকেন্ড কয়েকের বিরতি নিল সে।
“আমার একটি ঔষুধ চাই। এবং আমি জানি এটি তুমি তৈরি করতে পারো‚ এলিথ। সুতরাং মিথ্যা বলার দুঃসাহস করো না।”
এলিথ বুঝতে পারে রিয়ন তার নিকট কোন ঔষুধ চাইছে৷ সে কিছু বলার জন্য মুখ খুলে। কিন্তু রিয়নের চক্ষুবর্ণ লালচে বাদামি থেকে ধীরে ধীরে টকটকে লাল হতে দেখে সে নিজেকে থামিয়ে নেয়। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে পেন্টাকলের বাহিরে পা রাখে। ভেষজ ঔষুধের শেল্ফ থেকে একটি ছোট কাচপাত্র তুলে রিয়নের দিকে ফিরে তাকায়। নিজ জীবনের ঝুঁকি নিতে অপ্রস্তুত সে। কালচে বাদামী তরলে পূর্ণ কাচপাত্রটি রিয়নের দিকে বাড়িয়ে এলিথ বলল‚
“একবার পরীক্ষা করে নাও। ভিন্ন ব্যক্তির উপর ভিন্ন প্রভাব ফেলে এই ঔষুধ।”
এলিথের মুখমণ্ডল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রিয়ন তার হাতের কাচপাত্রের দিকে তাকায়। তার চাহনিতে কঠোরতা স্পষ্ট৷ এলিথের হাত থেকে দ্রুত কাচপাত্রটি নিয়ে কোন চিন্তা ছাড়াই তা পান করে নেয়।
মুহূর্তে রিয়নের অভিব্যক্তি পালটে যায়। অদ্ভুত তিক্ত স্বাদযুক্ত এই তরল তার দেহাভ্যন্তরের যতগুলো অঙ্গ অতিক্রম করছে সবগুলো যেন পুড়িয়ে ছাই বানিয়ে যাচ্ছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে এবং চোখ বন্ধ করে কিয়ৎক্ষণ এই যন্ত্রণা সহ্য করে সে। এরপর যখন তার দেহ স্বাভাবিক হতে শুরু করল তার শরীর খানিকটা শিথিল হলো। সে এলিথের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো‚
“পড়ন্ত বিকাল। রোদ এখনো আছে। যাচাই করার জন্য উত্তম সময়।”
এলিথের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে রিয়ন সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়। এরপর চোখের পলকে কুটির থেকে বেরিয়ে ঘন জঙ্গলের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। রিয়নের প্রস্থান ঘটতেই পেন্টাকলে রাখা মোমগুলো পুনরায় শুভ্র রঙ ফিরে পায়। কিন্তু তৎক্ষনাৎ জ্বলে উঠতে পারে না। কারণ তার আকষ্মিক প্রস্থান সম্পূর্ণ ঘরে এক ধমকা হাওয়া রেখে গিয়েছে।
রিয়ন প্রাচীন ও সুউচ্চ গাছের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। ডুবন্ত সূর্যের দিকে তার দৃষ্টি  স্থির। সম্পূর্ণ মুখমণ্ডল সূর্যের আলোতে কমলা রঙ ধারণ করেছে। লালচে বাদামি চোখজোড়া আরো লালচে রঙ ধারণ করেছে।
ধীরে ধীরে সে নিজের শরীরের লেদার জ্যাকেটের চেইন নিচের দিকে টেনে খুলে নেয়। খানিকটা ভয় কাজ করছে তার মাঝে। তার সুঠাম এবং বলিষ্ঠ দেহ জ্যাকেটের আবরণ থেকে বেরিয়ে আসে। সূর্যের আলোতে কমলা বর্ণ ধারণ করে। এবং রিয়ন কোন প্রকার বেদনা অনুভব ছাড়া সূর্যের উষ্ণতা অনুভব করতে পারে। স্বস্তির এক কোমল ও উজ্জ্বল হাসি তার সমস্ত মুখমণ্ডলে রাজ করতে আরম্ভ করে। যেন সে মহাখুশি।
সূর্যের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই রিয়ন বিরবির করে বলে‚
“খুব শীঘ্রই আমাদের আবার দেখা হচ্ছে‚ মন-ময়ূরী। এবং এবার তুমি আমার থেকে আলাদা হতে পারবে না। মৃত্যুও  আমার থেকে তোমাকে মুক্ত করতে পারবে না। আমি তোমার জীবনের এমন এক অধ্যায় যার সূচনা তোমার হাতে হয়েছিল। যাকে তুমি স্বেচ্ছায় আশ্লেষে আলিঙ্গন করেছিলে। কিন্তু এই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি লিখব আমি। এবং কেবলমাত্র আমি।”

সন্ধ্যাবন্দনা Where stories live. Discover now