পর্ব-৯

16 3 0
                                    

চুপ করে বসে বসে জিন ভাইয়ার ছবি তোলা দেখছি, এমন সময় পেছন থেকে কেউ আমার গালে স্পর্শ করতেই তড়াক করে মাথাটা ঘুরিয়ে যা দেখলাম, তাতে আমার মনে হলো এ জীবনে বোধয় আর জিন ভাইয়ার বিয়ে দেখা হলোনা! দেখলাম, হবি ভাইয়ের একহাতে হলুদ মাখানো, আরেক হাত শক্ত করে অরণ্যের হলুদভর্তি হাতটাকে আটকে রেখেছে। কাহিনীটা বুঝে উঠতে পারছিনা।হচ্ছেটা কী! আর আমার মুখে হলুদটা মেখেছে কে? হবি ভাই, নাকি অরণ্য? এবার হবি ভাই অরণ্যের দিকে তাকিয়ে মুখটা শক্ত করে একটা হাসি দিয়ে বললো,- " আসলে অ্যালোহার ছোটবেলা থেকেই একটা রোগ আছে। আমি বাদে অন্যকারোর স্পর্শে ওর অ্যালার্জি আছে। " বলেই আমার দিকে তাকালেন। অরণ্যের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে না পারে চোখ দিয়েই হবি ভাইকে ভস্ম করে দেয়। তাহলে হলুদটা হবি ভাই -ই লাগিয়েছে। এবার মনে হলো, হবি ভাইয়ের দেয়া দুইঘণ্টা সেই কবে পার হয়ে প্রায় চারঘণ্টা হতে চললো! লিয়া, ইউনা, সখিনা আন্টির সব কাহিনীর মাঝে পরে হবি ভাইয়ের হুমকির কথা বেমালুম গিলে ফেলেছি। হবি ভাইয়ের তাকানো দেখেই বোঝা যাচ্ছে আজ আমার মরণ নিশ্চিত। অরণ্য রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সেখান থেকে চলে যেতেই হবি ভাই আমাকে সহ চেয়ারটাকে একটানে ঘুরিয়ে নিজের দিকে করে নিলেন। একঝটকায় চেয়ারের দুপাশে হাত রেখে আমার দিকে ঝুঁকে আসতেই চোখ বনধ করে ছোটবেলায় শিখা সবরকম দোআ দরূদ পড়তে লাগলাম।- " তোকে বলেছিলাম দু ঘণ্টা থেকে এক সেকেন্ডও দেরী না করতে, আর তুই চারঘণ্টা পরেও এলি না! আমার কথা অমান্য করার সাহস তোর হলো কীকরে! এর মাশুল তো তোর দিতে হবেই।" হবি ভাইয়ের শীতল কণ্ঠের ভয়ানক হুমকি। হঠাৎই মনে হলো আমি যেন শূন্যে ভাসছি। তবে কি ভয়ের চোটেই মরে গিয়ে সাত আসমান ওপরে চলে যাচ্ছি আমি! হঠাৎই, - " অ্যালোহারে এমনে বাচ্চাগো লাহান কোলে তুইল্লা কই নিয়া যাইতাসোস রে হবি?" সখিনা আন্টির সন্দেহ ভরা প্রশ্ন শুনে মনে হলো, সখিনা আন্টিও কী আমার মতো ঐপাড়বাসী হয়ে গেলেন নাকি! আস্তে আস্তে চোখ মেলতেই দেখলাম, হবি ভাই আমাকে আড়কোলে নিয়ে প্রায় ছাদের দরজার সামনে এসে পড়েছেন, আর সখিনা আন্টি আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। হায় খোদা! এবার বোধয় গণধোলাই খেয়ে মরা লাগবে আমার। একেই মাথার ওপর শনি হয়ে ঘুরছে হবি ভাই, তার ওপর আবার সখিনা আন্টি! হবি ভাই এবার বললেন,- " পকেট খরচের টাকা নেই, তাই অ্যালেহার নাড়ী-ভুড়ি বিক্রি করতে যাচ্ছি। " হবি ভাইয়ের এমন ত্যাড়ামার্কা উত্তরে সখিনা আন্টি খুব একটা সুবিধা করতে পারলেননা। আর হবি ভাইও আমাকে নিয়ে নামতে লাগলেন।- " কি করছেন হবি ভাই! ছেড়ে দিন আমায়!" বলতেই হবি ভাই বললেন, - " আর একটা কথা বললে সত্যিই ছেড়ে দিবো। সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে হাড়গোড় একটাও আস্ত থাকবেনা। " বাপরে! এ লোক যে ধরনের পিশাচ জাতের, তাতে আমার হাড়গোড় ভেঙে দেয়া উনার কাছে কোন ব্যাপার না। তাই ভদ্রমহিলার মতো শক্ত করে উনার গলার পেছন দিয়ে ঘাড় জড়িয়ে ধরলাম। আমাকে নিয়ে হবি ভাই নিজের রুমে ঢুকেই বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। হায় খোদা! আবার আমার গলা টলা কেটে রেখে দিবে নাকি এই লোক!- " দরজা কেন বন্ধ করলেন হবি ভাই? " ভয়ে ভয়ে প্রশ্নটা করতেই হবি ভাই বললেন, - " একটা শব্দও করবি না তুই। " হবি ভাইয়ের কথা কমে আসছে, তার মানে তার রাগও খুব বেশি। কী হবে তা ভাবছি, এমন সময় হবি ভাই ঘরের লাইট অফ করে হালকা নীল রঙের ড্রিমলাইটটা জ্বালিয়ে দিলেন। এবার আমার ভেতরের ভয় সরে গিয়ে হাত পা থরথর কাঁপতে লাগলো। হবি ভাই পরনের টিশার্টটা খুলে অন্য একটা কোন একটা কাপড় পরছেন। ওহ্! তার মানে কাপড় চেন্জ করার জন্য লাইট অফ করেছেন! যাক, মুখটা খাপছাড়া হলেও একটু লজ্জা বাকী আছে উনার। এদিকে লাইট অফ করলে কি হবে, হালকা নীলচে আলোয় উনার ফর্সা শরীরটা যে আরো বেশি মোহনীয় লাগছে সেটা কি উনি জানেন! এমন অবস্থায় উনাকে আর কোনদিন দেখেছি কি! নাহ্, দেখলে সেটা চোখে আটকে থাকতো, কোনদিনই ভুলে যেতাম না। আমাকে কি শাস্তি দিবে এ লোক তা তো জানিনা, তবে এখন যা করছেন সেটাও আমার কাছে শাস্তির চেয়ে কম কিছু মনে হচ্ছে না। লম্বা, শক্তদেহী ফর্সা মানুষটাকে এই নীলচে আলোয় গ্রীক দেবতার চেয়ে কম কিছু লাগছেনা। হঠাৎ রুমের লাইট জ্বলে উঠতেই হুঁশ ফিরলো আমার। একটা গাঢ় নীল রঙের পান্জাবি পড়েছেন হবি ভাই। যদিও সামনে থেকে এখনো দেখতে পাইনি, কারণ উনি এখনো পেছন ফিরে ড্রয়ারে কি একটা যেন খোঁজাখুঁজি করছেন। মাথাটা নিচু করে শক্ত হয়ে বসে নিজের এই বাড়তি হৃৎস্পন্দন আর কাঁপনটা লুকানোর বৃথা চেষ্টা করছি, এমন সময় ঠিক আমার সামনে এসে বসে আমাকে আবারো সেই আগের অবস্থায় নিয়ে গেলেন হবি ভাই। এখন সেই কাঁপুনি দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। পান্জাবিতে উনাকে এতোটা ভয়ানক রকমের সুন্দর লাগবে তা আমি ভাবতেও পারিনি। গলার কাছের বোতাম দুটো খোলা থাকার সুযোগ নিয়ে ফর্সা বুকটা এক ধরনের অদ্ভুত সৌন্দর্যের সৃষ্টি করছে এই গাঢ় নীলের মাঝে। চুলগুলো বোধয় শ্যাম্পু করার কারণে একটু বেশিই অবাধ্য হয়ে কপালের এদিক সেদিক বিচরণ করছে। বিছানা বসে পান্জাবির হাতাদুটো গুটাতে গুটাতে বললেন,- " সবসময় ঐ অরণ্য তোর আশেপাশে ঘুরে কেন! ধরে একটা থাপ্পর দিতে পারিসনা?" অ্যাহ্! হবি ভাই কী বলছে এসব! পাগল হয়ে গেলো নাকি রাগের চোটে! হঠাৎই হবি ভাই একটা মেহেদী এনে একটান দিয়ে আমার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে নিলেন।- " কি করছেন হবি ভাই? " হবি ভাই মাথাটা নিচু রেখেই ফুস করে একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন,- " তোরে এখন কষিয়ে একটা থাপ্পর দেয়া উচিৎ। " বলেই উনি আমার হাতে মেহেদী দেয়া শুরু করলেন। এ লোক মেহেদীও দিতে জানে! মেহেদী অনুষ্ঠানের দিন হানার ঐ ঘটনায় আর মেহেদী দেয়ার সুযোগই পাইনি। কিন্তু তাই বলে হবি ভাই! সেই মানুষ, যে কোনদিন মহিলাদের কোন কাজের আশেপাশেও ঘেঁষতেন না! অবাকের চেয়ে বেশি খুশি লাগছে এখন। আমার দিকে ঝুঁকে মেহেদী দেয়ায় উনার চুলগুলো বারবার আমার নাকে মুখে লেগে হালকা সুরসুরির সৃষ্টি করছে। একটা নেশালো ঘ্রাণও আসছে। মেহেদী দেয়ার মাঝে মাঝে হাতের উল্টাপিঠ দিয়ে কপাল থেকে চুল সরাচ্ছেন হবি ভাই, আর যেটা দেখে আমি আবারো আরেকদফা তার প্রেমে পড়ে গেলাম। এদিকে উনার প্রধান বৈশিষ্ট্য, মানে সেই মাতাল করা ঘ্রাণ - এসব মিলিয়ে আমার বেঁচে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়েছে। এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কীই বা হতে পারে! প্রায় আধাঘণ্টা আমার হাতের ওপর নিজের সকল শিল্পকর্ম প্রয়োগ করার পর মাথা তুলে জোরে একটা দম নিলেন হবি ভাই। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। এতো সুন্দর করে মেহেদী দেয়া শিখলেন কোথা থেকে উনি! হাত থেকে চোখ তুলে দেখি হবি ভাই বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছেন।- " রাস্তায় মাটি কেটে আসলেও বোধয় এতো কষ্ট হতোনা! তোর জন্য কাল আধারাত পর্যন্ত বসে বসে মেহেদী দেয়া শিখতে হয়েছে!" নাক মুখ কুঁচকে কথাটা বললেন হবি ভাই। এ লোকটা কেমন! শুধুমাত্র আমার জন্য এতোকষ্ট করে মেহেদীর ডিজাইন শিখেছেন হবি ভাই! ভেবেই লজ্জায় মুখ লাল হয়ে যেতে লাগলো আমার। হঠাৎই হবি ভাই বসে পড়ে আমার হাত টেনে নিয়ে বললেন,- " আসল কাজই এখনো বাকী।" বলেই আবার মেহেদী নিয়ে আমার হাতের মাঝে বড় করে " HOBI" লিখে দিলেন। এবার আমার অবাকেরাও যেন সীমা হারিয়ে ফেললো। আমার হাতে হবি ভাই নিজে নিজের নাম লিখে দিলেন! যে লোক আমাকে দেখলেই তেড়ে আসে, সে লোক এই কাজ করলো! - " এতো খুশি হওয়ার দরকার নেই। ঐ অরণ্য না ফরণ্য আছেনা, সে কাছে আসলেই এই হাতের দিকে তাকিয়ে নিজের মাথা জায়গায় রাখিস। " বলেই হবি ভাই বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে গেলো। সেদিন তো অসুস্থ থাকায় খেয়াল করিনি,তাই আজ সুযোগে উনার রুমটা ঘুরে দেখছি। ছিমছাম গোছানো রুম। প্রয়োজনের বাইরে একটা বেশতি কলম পর্যন্ত রাখেন না এ ঘরে। এতোটা পারফেক্ট কোন পুরুষ হতে পারে! খাটের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রুমটা দেখছি, এমন সময় হবি ভাই কোত্থেকে এসে বললো,- " তোর শাস্তিটা তো দেয়া হলোনা!" অ্যাহ্! আরো শাস্তি দেয়া বাকী! এমনিতেই ভেতরে হাতুড়ি পেটার কারণে বুক ব্যথা হয়ে গেছে, এখন আরো শাস্তি দিলে সোজা কবরেই চলে যাবো। হবি ভাই হাতে একটা হলুদের বাটি নিয়ে সেখানে নিজের তিন আঙুল ডুবিয়ে আমার মুখে লেপে দিলেন। উনার এই হুটহাট স্পর্শগুলো যে কতটা ভয়ানক,তা আমি বাদে আর কেউই বোধয় বুঝতে পারবে না। হবি ভাই চুপ করে খুব মনোযোগ সহকারে আমার গালে হলুদ লাগাচ্ছেন, আর উনার এতোটা কাছে থাকায় উনার উষ্ণ শ্বাস আমার মুখে আছড়ে পড়ছে। উনার মৌনতাতেও আমার ভেতরে ঝড়ো হাওয়ার তাণ্ডব শুরু হয়ে গিয়েছে। চোখটা যতটা সম্ভব নিচে নামিয়ে একদম শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় হবি ভাই মাথাটা নিচু করে আমার গালের সাথে হালকা করে উনার গালটা স্পর্শ করতেই আমি মোটামুটি লাফিয়ে উঠলাম। একি করছে হবি ভাই! এবার উনার গালেও হলুদ লেগে আছে। আর এতেও তাকে প্রচণ্ড কিউট লাগছে।- " এভাবে যখন তখন জরুরি কাজের সময় ডিস্টার্ব করা তোর বদ অভ্যাস হয়ে গেছে অ্যালোহা! " অ্যাহ্,নিজে যে কাল থেকে অদ্ভুত সব কাজ করছে তার বেলা! সব দোষ শুধু আমার! নিজের চেয়ে মাথা নষ্ট হয়ে গেছে সেটার খবর কি রাখে! মনে মনে বিড়বিড় করে বকছি, এমন সময় হবি ভাই বললেন,- " আমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে? " বলেই উনি আরেকপা আমার দিকে এগিয়ে আসতেই আমি কোনমতে দৌড়ে উনার রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। ঘর থেকে বের হতেই সামনে পড়লো জাংকুক। ওকে দেখেই আমার হানার কথা পড়ে গেলো। কিন্তু কোন এক কারণে ওর ওপর রাগ হচ্ছেনা আমার। এখনো মনের মধ্যে জাংকুকের ওপর একটা বিশ্বাসের জায়গা রয়ে গিয়েছে। ও এতোটা নিচু কাজ করতে পারেনা। - " জাংকুক, আমার সাথে হানার রুমে আয়। তোর সাথে কিছু জরুরি কথা আছে।" জাংকুক একটু অবাক হয়েই ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,- " জরুরি কথা! কিছু হয়েছে? " - " তুই আসবি?" বলতেই জাংকুক নিঃশব্দে আমার পেছন পেছন এসে হানার রুমে ঢুকলো। ওমা! রুমে ঢুকেই দেখি হবি ভাই হানাকে নিয়ে রেডি হয়ে বসে আছে। জানলে কি করে যে আমি এখন মিটিংয়ে বসবো! আমরা গিয়ে বসতেই হবি ভাই জাংকুকের দিকে তাকিয়ে বললেন, - " এখন আমি যা যা জিজ্ঞেস করবো,কোনপ্রকার গাঁইগুঁই না করে সোজা সোজা উত্তর দিবি।" জাংকুক মাথা নেড়ে সায় দিতেই হবি ভাই বললেন,- " রাহার সাথে তোর কি ধরনের সম্পর্ক? " প্রশ্নটা করার সাথে সাথেই জাংকুকের চেহারাটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। একটু ভেবে বললো,- " কেন? হঠাৎ ওকে নিয়ে প্রশ্ন! " হবি ভাই এবার ধমক দিয়ে বললেন,- " যা জিজ্ঞেস করছি তার জবাব দে।" এবার জাংকুক বললো,- " আমরা ফ্রেন্ড, এর বেশি কিছুই না।" এটুকু বলে হানার দিকে তাকাতেই হানা একটা হাসি দিলো। এ হাসির মানে জাংকুল ও জানে, আমরাও জানি। জাংকুক এবার একটু ইতস্তত ভাবেই বললো,- " কিন্তু একটা সময় আমাদের সম্পর্কটা ফ্রেন্ডের চেয়ে একটু সামনে বেড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এখন সেসব নেই।" বলতেই হবি ভাই হানার ফোনটা টান দিয়ে নিয়ে সেই ছবিটা দেখিয়ে বললো,- " এ ছবির কাহিনী কি? এটা কি তুই আসলেই করেছিস? একটা শব্দও যদি মিথ্যা বলেছিস তো.." বলতেই জাংকুক একটান দিয়ে ফোনে থাকা ছবিটা দেখলো। আর সাথে সাথেই ওর চেহারা লাল হয়ে গেলো। ও দরদর করে ঘামছে,কপালের রগগুলো ফুলে উঠেছে। - " এটা কে দিয়েছে হানা? " শক্ত কণ্ঠে হানাকে জিজ্ঞেস করলো জাংকুক। হানা এবার আর হেসে নিজের কষ্ট লুকাতে পারলোনা। ওর চোখ থেকে টপটপ করে জল ঝরছে। - " আমি জিজ্ঞেস করেছি এটা কে দিয়েছে? " মোটামুটি চিৎকার করে প্রশ্নটা করতেই হানা কাঁপা কাঁপা গলায় শুধু বললো, - " রাহা।" এরপর আমি শুরু থেকে হানার গলায় দড়ি দেয়া অব্দি সব খুলে বললাম। জাংকুক কোন কথা বলতে পারছেনা। সোজা গিয়ে হানাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে একটা কথাই বললো,- এতোবড় একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমার কাছ থেকে একবার জেনে নিতে পারতে হানা! যদি সত্যিই তোমার কিছু হয়ে যেতো! বলেই হানার মাথাটা ওর বুকের সাথে চেপে ধরে বললো,- " শোন তাহলে। সবটা বলি। কলেজে ভর্তির পরই প্রথম আমার রাহার সাথে বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু দিন দিন রাহার আচরণ পরিবর্তন হতে লাগলো।আমি বুঝতে পারতাম ও আমাকে পছন্দ করে। আমি ওকে এ বিষয়টা থেকে বের করে আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একটা সময় আমিও কিছুটা দূর্বল হয়ে পড়ি। কিন্তু একমাসের মাথায়ই রাহার আচরণ আমার খারাপ লাগতে লাগলো।ও আসলে ভালো ছিলোনা। কিন্তু এতোটা ঘনিষ্ঠ তো দূর, ওর সাথে হাত ধরে হাঁটা বাদে আর কোন কিছুই হয়নি আমার। একমাসের মাথায় আমার মনে হতে থাকে আমি ভুল করছি, ঠকাচ্ছি আমি হানাকে। আমি রাহাকে হানার কথা বলে দিই। ওর সাথে একমাসের মধ্যেই সব সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দেই ঠিকই, কিন্তু ও যে আমার এতো বড় ক্ষতি করবে, তা আমি কল্পনাও করিনি। হ্যাঁ, আমি ভুল করেছি ওকে ঐ একমাস সুযোগ দিয়ে, কিন্তু এই ভুল আমি করিনি, যেটার কারণে হানার এতো বড় ক্ষতি হতে যাচ্ছিলো। এটা আমাদের একটা পার্টির ছবি ছিলো, যেটাতে আমার পাশে রাহা দাঁড়িয়েছিলো। এই ছবিটাকে.. ছিহ্! " এবার হানা মাথা তুলে জাংকুকের দিকে অবাক হয়ে তাকাতেই জাংকুক বললো,- " গত কয়েকমাস ধরে আমি তোমার সাথে ঠিকমতো কথা পর্যন্ত বলতে পারিনি হানা, আমি নিজেই একটা হীনমন্যতায় ভোগতাম যে আমি তোমাকে ঠকিয়েছি। কিন্তু সত্যি হলো ঐ কাহিনীর পরেই আমি বুঝতে পেরেছি আমি তোমাকে ঠিক কতোটা ভালোবাসি। " এবার হানা আরো জোরে কান্না শুরু করলো। বুঝলাম এবার আর আমাদের থাকা উচিৎ না। তবুও কী একটা ভেবে যেন সেখানেই হাবলি হাবলি চেহারা করে বসে আছি, এমন সময় হবি ভাই বললেন,- " ছোট ভাই - বোনের প্রাইভেট টাইমেও ডিস্টার্ব করা কি তোর খুব বেশি প্রয়োজন! এতো শখ থাকলে.. " বলেই আমার হাত ধরে একটানে হানার রুম থেকে বের হয়ে এলেন উনি। নিজের রুমে বসে বসে ফোনে গেমস খেলছে নামজুন, এমন সময় ঠাস করে দরজা খোলার শব্দে প্রায় লাফিয়ে উঠে দেখে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুহি। - " কাল কোন জামাটা পরবো সিলেক্ট করতে পারছিনা নামু। একটু বলে দাওনা কোনটা পরবো?" এই প্রথমবারের মতো সুহির মুখে এতো স্বাভাবিক আবদার শুনে নামজুন মোটামুটি একটা ঝটকা খেয়ে গেলো। নামজুন খুশি হয়ে বললো,- " ব্যাস! এটুকুই? আর কিছু না?" এবার সুহির চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো।- " ভালো কথা মনে করেছো। কাল জিন ভাইয়ার সাথে আমরাও বিয়েটা সেরে ফেলি, কি বলো?" নামজুন এবার চরম পর্যায়ের অবাক হয়ে গেলো। কারণ ও জানে, সুহি এটা মজা করে বলছেনা। - " পাগল হয়ে গেছো! কাল জিন ভাইয়ার বিয়ে,আর সেই দিনেই আবার আমাদের বিয়ে! তার ওপর আমি কেন তোমাকে বিয়ে করতে যাবো! আমি কি তোমাকে ভালোবাসি নাকি!" নামজুনের এই কথা শুনে সুহি আর সেখানে দাঁড়ালো না। এতোক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিলাম। মাত্র একটার কাহিনী সমাধান করতে না করতেই আবার আরেকটার প্যাঁচাল লাগলো! সুহি সবসময় পাগলামী করলেও ও যে নামজুন ভাইয়াকে প্রচণ্ড ভালোবাসে সেটা আমি জানি। কিন্তু ভাইয়া এতো কঠিন কথা বলতে পারলো! রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ওর কাছে গিয়ে বললাম,- " তুমি ওর মতো মেয়ে জীবনে কাইন্দা মরলেও পাবা? ওরে না করলা কীভাবে তুমি!" বলেই ক্ষেপেক্ষুপে সেখান থেকে নিজের রুমে এসে পড়লাম। মাঝরাতে একটা বিকট চিৎকার শুনে ঘুম থেকে একলাফে উঠে বসলাম। কীসের শব্দ আসছে! বাড়িতে আবার চোর এলো নাকি! তাড়াতাড়ি দরজা খুলে নিচে নেমে দেখি পুরো ড্রয়িংরুমের সব জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিচে পড়ে আছে। কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই। একে একে সবাই নিচে নেমে এলো, কিন্তু এ শব্দের উৎস কেউই খুঁজে পাচ্ছি না। হঠাৎই সোফার একটা কোণা থেকে সখিনা আন্টি বের হয়ে আসলো। তার পুরো মুখ ভয়ানক হয়ে আছে। লাল লিপস্টিক প্রায় কান অব্দি ছড়ানো, কাজল চোখের নিচে প্রায় এক ইঞ্চি পর্যন্ত ছড়ানো। আর সারা মুখ সাদা ধবধবে হয়ে আছে। রাগে ফুঁসছেন তিনি। উনাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে মা, এমন সময় সোফার পেছন থেকে বের হয়ে এলো আরেকজন মানুষ, কিন্তু আমরা কেউই আর চেহারা উদ্ধার করতে পারছিনা৷কে এই মহিলা! - " আমারে এমনে মেকাপ কইরা দিয়া কী ভাবসিলি? পাড় পাইয়া যাবি? আমি কি করতে পারি এখন ঐডা আয়নায় যাইয়া দেখ জরিনার মা।" সেই মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বললেন সখিনা আন্টি। তার মানে এই ভয়ানক মানুষটা জরিনার মা! তার মুখের অবস্থা আরো ভয়ানক। তার ঠোঁটে কালো লিপস্টিক, চোখে লাল কাজল, আর গালে গোলাপি রং। - " কাইল জিনের বিয়া,তাই জরিনার মারে কইসিলাম মেকাপ কইরা দিতে, কালকে কেমন মেকাপ করমু ঐডা ভাবতে যেন সময় না লাগে। ও দুইঘণ্টা সাজানোর পর আয়নার সামনে গিয়া দেখি আমার এই অবস্থা কইরা দিছে। পরে আমিও ওর ওপরে বইয়া জোর কইরা ওরে এমনে সাজাইছি। ভালা হইসে না? " বাড়িসুদ্ধ মানুষ এবার না পারে কান্না করে দেয়। কাল কতো কাজ, তার ওপর আজ রাতেও ঠিক করে ঘুমাতে দিলোনা এই মহিলার দল। জরিনার মা এবার সখিনা আন্টিকে বললেন,- " তোমারে আমি দেইখা নিমু। আমিও জরিনা মা,হুহ্।" বলেই চলে গেল। সবাই যার যার রুমে ফিরে যাচ্ছে, আমিও সিঁড়ি বেয়ে উঠছি,এমন সময় ড্রয়িংরুমের কোণায় চোখ পড়তেই যা দেখলাম, তাতে জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেলাম। এই মানুষটার এমনরূপ!....


চলবে..

secret admirer (Complete) Where stories live. Discover now