পর্ব ১৬

15 2 0
                                    

জাংকুক - হানা আর তেয় - ইউনা বসেছে আরেকপাশে, মানে পাশের স্টেজে। এতোক্ষণ তো চুমুপার্টি আর হলুদপার্টির কাহিনী দেখলাম, এবার ঐ পার্টির কাহিনী দেখার জন্য এই স্টেজ থেকে নেমেছি, এমন সময় আমার চোখে যা পড়লো, তা দেখে সেখানেই মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখলাম-
একটু দূরে কোণায় দাঁড়িয়ে আছে সখিনা আন্টি, তার সামনে হাঁটুগেড়ে, হাতে একটা জবা ফুল নিয়ে বসে আছে আমাদেরই গ্রামের শেফালির বাবা। এই কাহিনী দেখার পর নতুন দম্পতিদের বাদ দিয়ে সেদিকে দৌঁড় দিলাম, কাহিনী কি সেটা জানা লাগবে তো!
- " ঐদিন তোমার গান শুইন্না আমি পাগলা হইয়া গেসি গো সখিনা। হুনলাম তোমার একটা মাইয়া আর জামাইও আছে, তয় আমার কুনু সমস্যা নাই। আমি তোমার লাইগা সতীনের ঘর করতেও রাজী। আমি তোমারে বিয়া করতে চাই গো সখিনা। " হাতে থাকা জবা ফুলটা সখিনা আন্টির নাক বরাবর ধরে রেখে কথাগুলো বললো শেফালির বাবা। কী চলছে এসব! এদিকে বাড়ির চারজোড়া ছেলে - মেয়ের বিয়ে হচ্ছে, তার ওপর আবার বুড়াবুড়ির এই কাহিনী! সখিনা আন্টির জামাই যদি এই কাহিনী জানতে পারে, তাহলে শেফালির বাবা তো আছেই, পুরো পরিবারসহ কবরে পাঠাবে। আর শেফালির বাবাও বলিহারি! ঐ গান শুনেও কেউ বেঁচে থাকতে পারে! সখিনা আন্টি প্রায় দুইমিনিট চুপ করে থেকে বললেন,
- " সবই বুঝলাম। তুমি সতীন নিয়া ঘর করবা তাও বুঝলাম। কিন্তু তার আগে আমার মন জয় করা লাগবো তোমার। আমার সব কথা যদি মানতে পারো, তখন আমি রাজী হমু। " সখিনা আন্টির কথা শুনে শেফালির বাবার মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠলো। সে সাথে সাথেই সখিনা আন্টির শাড়ির আঁচলটা তুলে নিজের হাতে নিয়ে বললো,
- " এই ধরলাম তোমার আঁচল, মন জয় না কইরা আর ছাড়মু না। " মনে মনে শেফালির বাবার আত্মার অগ্রীম মাগফিরাত কামনা করে আবার গেলাম হলুদের প্রোগ্রামে।

জাংকুক আর হানার কাছে গিয়ে দেখি দুইজনের মুখই একদম পরিস্কার। একজনও গালে হলুদ লাগায়নি। একি অবস্থা! ওদের কেউ এখনো হলুদ লাগায়নি! আহারে, মনে মনে ওরা কী দুঃখই না পাচ্ছে! তাড়াতাড়ি গিয়ে একখাবলা হলুদ নিয়ে হানার গালে লাগাতে নিলেই স্টেজে থাকা সব মানুষসহ হানা জাংকুকও " নাআআআআআ" বলে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠলো। ওদের চিৎকার শুনে একলাফ দিয়ে দূরে সরে গিয়ে হলুদসহ হাতই কানে চেপে ধরে স্টেজে বসে থাকা মানুষদের উদ্দেশ্য করে বললাম,
- " সবগুলো একসাথে পাগল হয়ে গেলে নাকি! এভাবে চিৎকার করলে কেন?" এবার এদের মধ্যে একজন বললো,
- " একই কাহিনী আমাদের সময়ও ঘটেছে। আমরা যখন ওদের হলুদ লাগাতে গেলাম, তখন জাংকুক আর হানাও ঠিক এভাবেই আমাদের না করেছে। তাই আমরাও তোমাকে না করলাম। " অবাক হয়ে জাংকুকের দিকে তাকাতেই ও মিনমিন করে বলে উঠলো,
- " আমরা ঠিক করেছি সবার আগে আমরা নিজেদের মধ্যে হলুদ দেবো। এরপর বাকীরা দিবে। " এবার আমার মাথা গরম হয়ে গেলো।
- " তো তোরা কী বিয়ের পরে হলুদ লাগানোর চিন্তা করেছিস? এখনি তোরা হলুদ লাগাবি, নয়তো এক থাপ্পর দিয়ে দুজনের  গাল লাল করে দিবো বলে দিলাম। " এই এক ধমকেই কাজ হয়ে গেলো। জাংকুক আর হানা একে অপরের গালে হলুদ লাগিয়ে দেয়ার পর বাকীরা শুরু করলো ওদের হলুদ লাগানো। এবার পালা তেয়- ইউনার। ওদের দিকে তাকাতেই দেখলাম আরেক অবাক করা কাণ্ড। ইউনা বসে আছে,আর তার কোলে বসে আছে তেয়। এ কেমন স্টাইলরে বাবা!
- " এসব কী করছিস তোরা!" জিজ্ঞেস করতেই ইউনা বললো,
- " উফফ্, দেখিসনা একটু রোমান্টিক পোজ দিচ্ছি!" বলেই তেয়কে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে ইউনা বললো,
- " আমার জন্য একটা গান গাও না তেয়!" এবার তেয় হাসি হাসি মুখ করে গাওয়া শুরু করলো,
- " বুকে চিনচিন করছে হায়
মন তোমায় কাছে চায় " সাথে সাথেই দেখলাম গানের তালে তালে ইউনাও দুলে দুলে নাচছে। হায় খোদা! এ গান শুনেও এই মেয়ে এতো খুশি! এদিকে ওদের নাচের জন্য আমি দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছিনা। তাড়াতাড়ি স্টেজ থেকে নিচে নামতেই মাথায় একটা চিন্তা ঢুকলো- এতোক্ষণ হয়ে গেলো, হবি ভাইকে আশেপাশে কোথাও দেখতে পেলামনা কেন! যদিও এসব চেঁচামেচির মাঝে কোনদিনই উনাকে খুব বেশি দেখা যায়নি। তবুও, আজ অন্তত একবার তো আসার কথা ছিলো! তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে উনার রুমের দিকে উঁকি দিলাম। নাহ্, উনাকে ঘরেও পাওয়া গেলো না। এ সময়ে লোকটা যাবে কোথায়! হঠাৎই মনে হলো, ছাদে নেইতো! একদৌঁড়ে ছাদে গিয়ে দরজাটা ধাক্কা দিতেই দেখলাম - পেছন ফিরে রেলিংয়ে দুহাত ভর দিয়ে মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন হবি ভাই। কিন্তু এসময়ে তো উনি কোনদিন ছাদে আসেন না! তাড়াতাড়ি গিয়ে উনার পাশে দাঁড়াতেই আমার দিকে তাকালেন হবি ভাই। আজ একটা হলুদ রঙের পান্জাবি পড়েছেন উনি। হাতে কালো ফিতের একটা ঘড়ি। আজ ওপরের দুইটা না, সবগুলো বোতামই খোলা। যার কারণে সবছেড়ে উনার বুকের দিকেই আমার নির্লজ্জ চোখ তার আস্তানা গেড়ে নিলো। হঠাৎই হবি ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে তার বুকের সাথে আমার মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরলেন। প্রথমে কিছুটা অবাক হলেও পরে আমিও তাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। হবি ভাই কিছু বলছেন না। প্রায় পাঁচ মিনিট যাবৎ ঠিক একইভাবে আমার মাথাটা তার বুকের সাথে ঠেকিয়ে রেখেছেন। এমন তো কোনদিন হয়নি! এবার আমি মাথাটা তুলে হবি ভাইয়ের চেহারার দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম। তার চোখদুটো লাল হয়ে ফুলে আছে। ফর্সা গাল আর নাকটাও টকটকে লাল হয়ে আছে। হবি ভাই কেঁদেছেন!
- " আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন হবি ভাই! আপনি কেঁদেছেন?" জিজ্ঞেস করতেই হবি ভাই আবারো আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললেন,
- " যদি কোর্সটা তোর শখ না হতো, তাহলে কোনদিনই আমি তিনমাস তোকে আমার থেকে দূরে যেতে দিতামনা রে!" ওহ্! তারমানে কোর্সের কারণে তিনমাস তার থেকে দূরে থাকবো বলে উনার এ অবস্থা! উনাকে ছাড়া আমিই বা থাকবো কীকরে! আমিও এবার হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলাম। কাঁদতে কাঁদতে উনার পুরো বুক ভিজিয়ে ফেলেছি।
- " বাড়িতে বিয়ে চলছে, এভাবে মরাকান্না কাঁদিস না। " হবি ভাইয়ের সেই হবিস্টাইলের কথা। এইমাত্রই না এতো চুপচাপ ছিলো! এ লোক গিরগিটির আগে রঙ বদলায়। তাড়াতাড়ি মাথা তুলে চোখ মুছে তার বোতামগুলো লাগিয়ে দিতে লাগলাম। বাড়ি ভর্তি মেয়ে, তার মাঝে উনি এভাবে বুক দেখিয়ে ঘোরাফেরা করছেন! বেহায়া লোক!
- " সর তো! গরম লাগছে খুব।  পান্জাবি খুলে ফেলবো। " বলেই উনি একটা মুচকি হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকালেন।
- " হ্যাঁ, এতোক্ষণ অর্ধেক খুলে দেখিয়েছেন, এখন পুরোটা খুলে গিয়ে ঐ হেই চিপকির সামনে দাঁড়িয়ে পরুন। " বলেই উল্টা ঘুরে হাঁটা ধরেছি, এমন সময় হবি ভাই পেছন থেকে এসে আমার কোমড় জড়িয়ে আমার ঘাড়ে মুখ গুঁজলেন। প্রতিবারের মতো এবারও স্ট্যাচু হয়ে গেলাম। এতোবার, এতোদিন পরেও উনার সবকিছুই আমার কাছে নতুন বলে মনে হয়।
- " হবি ভাই এখনি কেউ এসে পড়বে। ছাড়ুন না!" বলতেই হবি ভাই বললেন,
- " আসলে আমার কি!" বলেই আমার চুলে কিছু একটা লাগানোর জন্য মোটামুটি যুদ্ধ শুরু করলেন।
- " করছেনটা কী হবি ভাই! "
- " একদম চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক। নড়েছিস তো.." উনার হুমকি শুনে নাক মুখ কুঁচকে এক করে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় নাকে বকুল ফুলের ঘ্রাণ আসতেই মাথায় হাত দিয়ে বুঝলাম এতোক্ষণ যাবৎ সেই মালা আমার চুলে লাগানোর জন্যই এতো যুদ্ধ চালাচ্ছেন এ লোক।
- " তোর চুলগুলো মোটেই ঝাড়ুর মতো না। " প্রায় পাঁচমিনিট চুলের সাথে যুদ্ধ করে মালাটা লাগিয়ে দিয়ে আবারো আমার কাঁধে থুতনী ঠেকিয়ে কথাটা বললেন হবি ভাই। পাশ ফিরে উনার দিকে তাকাতেই হবি ভাই আমাকে আবারো কোলে তুলে নিলেন। সোজা গিয়ে দোলনায় বসিয়ে দিয়ে কোত্থেকে একবাটি হলুদ এনে আমার গালে ইচ্ছেমতো লাগালেন।
- " জিনের হলুদের দিন তো কেঁপে কেঁপে আমাকেই কাঁপিয়ে দিচ্ছিলি। এসব কাঁপাকাঁপির ঝামেলা ভাঙার জন্য কাল.. " চোখ গোলগোল করে উনার দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি দাঁত বের করে হাসছেন। এবার সব লজ্জা ভুলে তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এ লোকটা এতোটা সুন্দর কেন! যাই করে, যেভাবেই করে - তাতেই তাকে অপূর্ব লাগে।
- " আমাকে দেখা শেষ হয়ে থাকলে চোখদুটো একটু ছোট কর, নাহলে যেকোন সময় খুলে পড়ে যেতে পারে। " বলেই হবি ভাই সেই আগেরবারের মতো আমার গালের সাথে নিজের গালে হলুদ লাগিয়ে নিলেন। লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে আছি, এমন সময় হবি ভাই আমার হাত ধরে টান দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে টানতে টানতে নিচে নিয়ে এসে বললেন,
- " হলুদ লাগিয়েছিস, এখন গোসলও তো করা লাগবে! " বলেই নিজে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। উনার এসব হুটহাট অদ্ভুতসব কাজ দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎই বাথরুম থেকে বের হয়ে একটান দিয়ে আমাকেও পানির নিচে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন।

secret admirer (Complete) Where stories live. Discover now