#আলোছায়া
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৮বাড়ছে রাত। সেই সাথে বাড়ছে উল্লাসীর অস্থিরতা। বুকের ভেতরটা তার কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদার দরুন বারেবারে নিঃশ্বাস আটকে আসছে। এই তার ভালোবাসার নমুনা? এই তার আগলে রাখার নমুনা? তবে দরকার নেই এমন ভালোবাসার। ডাইনিং ছেড়ে উঠে শোবার ঘরের দিকে পা বাড়াতেই ফোনের রিংটোনে থেমে গেল উল্লাসী। পাশ ফিরে ফোনের সন্ধান করতে পাশের ঘরের দিকে এগুলো সে।
জাভেদ ভাই কেনো এত রাতে কল করলো তাকে? আগুনে ঘি ঢালতে? তার কষ্ট বাড়াতে? তাকে আরও কাঁদাতে? দাঁতে দাঁত চেপে কল কেটে দিয়ে বিছানায় বসে পড়লো উল্লাসী। এই পৃথিবীতে কেউ তাকে বোঝে না। কেউ তার কষ্ট অনুভব করতে পারেনা। তবে জাভেদ নামের লোকটি আর যাই হোক তার খারাপ চায়না। আজ পর্যন্ত দেয়নি কোনো বাজে পরামর্শও। তাহলে কেনো লোকটির উপর রাগ দেখাচ্ছে সে? লোকটি কী এমন খারাপ করেছে তার সাথে? ভাবামাত্রই ফোন হাতে নিয়ে জাভেদের নাম্বারে ডায়েল করলো উল্লাসী। দু'বার রিং হবার পর ওপাশ থেকে জাভেদ কল ধরতেই উল্লাসী বললো,
"আপনি ঠিক বলেছিলেন জাভেদ ভাই। উনি কেয়ারলেস একটা লোক.. প্রচুর কেয়ারলেস।"
"তুমি কাঁদছো কেনো উল্লাসী?"
জাভেদের সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নাক টেনে নিল উল্লাসী। তারপর সময় নিয়ে ভাঙা গলায় বললো,
"জানেন উনি আমায় কত বকেছে? অথচ উনি একটা বারও এটাই লক্ষ্য করলো না আমি এসব কোত্থেকে পেয়েছি!"
"আচ্ছা.. এবার থামো।"
"উনি কেনো এমনটা করলেন? কেনো আমার সাথে রাগ দেখিয়ে এত রাতে আমাদের একা ফেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন? জানেন উনি কতটা কেয়ারলেস! বিয়ের পর যখন নতুন নতুন এখানে এসেছিলাম তখন উনি আমাকে একা একটি ঘরে আটকে রেখেছিল! আমি কত কেঁদেছিলাম.. উনাকে বারবার বলেছিলাম আমি ভয় পাই তবু্ও উনি শোনেনি।"
"আমি জানতাম উনি তোমায় ছোট পেয়ে তোমার উপর জুলুম চালাচ্ছে। তুমি এক কাজ করো.. নিজেকে আলাদা রাখো। উনাকে নিজের কাছে ঘেষতে দিও না।"
"আমি ঘেষতে দিব না কী! উনি নিজেই তো ঘেষবে না। উনার এত অহংকার যেন ডাক্তার হয়ে দিন দুনিয়া সব কিনে নিয়েছেন উনি!"
কিছুক্ষণ নীরব থেকে ওপাশ থেকে জাভেদ বললো,
"তোমার আপনজন বলতে কাছের কে কে এখনো তোমার সাথে যোগাযোগে আছে?"
"নানাজান.. নানাজান ছাড়া কেউ আমাকে আসল ভালোবাসে না। সবাই দেখাই.. কিন্তু কেউ ভালোবাসে না।"
চোখের পানি মুছে জবাব দিল উল্লাসী।
"কারণ তুমি মানুষ চিনতে জানো না.. চিনতে জানলে ঠকতে জানতে না। অবশ্য ঠকেই তো মানুষ শেখে তাই না?"
"জানি না.."
মৃদু হাসির মতো শব্দ করে জাভেদ বললো,
"একটা গান শুনাই কেমন? মন ভালো হয়ে যাবে তোমার।"
"না.. ভালো লাগছে না।"
"ভালোলাগবে.. একবার শুনেই দেখো।"
নড়েচড়ে বসলো উল্লাসী।
"আপনি গানও জানেন?"
"হ্যাঁ.. তবে শুরু করা যাক!"
গলা খাঁকরে উঠলো জাভেদ। তারপরই স্পষ্ট গলায় ধরলো গান।
"পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি
সোজা পথের ধাঁধায় আমি অনেক ধেঁধেছি।
নিষেধের পাহারাতে ছিলেম রেখে ঢেকে
সে কখন গেছে ফিরে আমায় ডেকে ডেকে
নয়ন মেলে পাবার আশায় অনেক কেঁদেছি
এই নয়নে পাবো বলেই নয়ন মুদেছি।"
কয়েক চরণ গেয়েই থেমে গেল জাভেদ। কোমল কন্ঠে উল্লাসীর উদ্দেশ্যে বললো,
"হেমন্ত মুখার্জির গান.. শুনেছিলে আগে?"
ঘাড় নেড়ে কিছু একটা স্মরণের চেষ্টায় সফল হতেই চোখমুখ জ্বলজ্বল করে উঠলো উল্লাসীর। উৎসাহী গলায় সে বললো,
"হেমন্ত মূখোপাধ্যায়? মা শুনতো তো উনার গান। মার কাছে উনার গানের অনেকগুলো ক্যাসেট প্লেয়ারও ছিল.."
"তাই? তবে তো তোমার মায়ের বেশ পছন্দের গায়ক ছিলেন উনি!"
"হয়তো.. জানেন আমার এখন মায়ের চেহারাটা আর চোখ বুজলেই আমার সামনে ভেসে উঠে না। কেমন যেনো আবছা হয়ে গেছে সবটা.. তবে এখন কেনো যেনো মনে হয় মা তার শেষ সময়ে বুঝেছিলেন মা তার বাবার সিদ্ধান্তের বিপরীতে গিয়ে ভালো নেই৷"
"কেনো বলোতো? এটা কেন মনে হলো তোমার?"
নিজেকে সামলে নিল উল্লাসী। বাইরের অপরিচিত এক ব্যক্তির কাছে তার বাবামায়ের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে কেনো আলোচনা করছে সে? প্রসঙ্গ বদলাতে হালকা কেশে উঠলো সে। ক্ষীণ স্বরে বললো,
"উনার ও নদীরে গানটাও মা অনেক শুনতো। শুনাবেন এখন ওই গানটা?"
"অবশ্যই.. কেনো নয়!
ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে।
বলো কোথায় তোমার দেশ
তোমার নেই কী চলার শেষ! ও নদীরে...
তোমার কোনো বাঁধন নাই তুমি ঘর ছাড়া কি তাই,
এই আছো ভাটায় আবার এই তো দেখি জোয়ারে..."
চোখজোড়া বুজে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল উল্লাসী। জাভেদের গাওয়া গানের তালে তালে হাতের আঙুল নড়াতেই তার সামনে ভেসে উঠলো তার মায়ের অবয়ব প্রতিচ্ছবি।