#১৭

486 18 0
                                    

#আলোছায়া
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১৭

সাতসকালেই ছেলেকে উঠিয়ে হাতমুখ পরিষ্কার করে দিয়ে তাকে বিছানায় বসিয়ে দিল চৈতালি। তারপর তার হাতে ধরিয়ে দিল খেলনা গাড়ি। ছেলেটি সারারাতে একদম ঘুমোয়নি। কিছুক্ষণ পরপরই কেঁদে কেঁদে উঠেছে। মুখে তোলেনি একটি দানাও। শরীরের তাপমাত্রাও অস্বাভাবিক গরম। জ্বর করেছে বোধহয়। তবে এনিয়ে কোনো উদ্বেগ নেই এবাড়ির মানুষদের মাঝে। তারা দিব্যি খাচ্ছেদাচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাতে অবশ্য একবার তার ঘরে এসেছিলেন সেঁতারা বেগম। চোখমুখ কুঁচকে বলেছিলেন, কান্দে কেন পোলায়? তবে জবাবে তার কথা শুনে তিনি দেখাননি কোনো সহমর্মিতা। ভেবেই বুকটা ভার হয়ে এল চৈতালির। ছেলের কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে সে এগুলো নিচতলায় টুটুলের ঘরের দিকে। ছেলেটির জ্বর বাড়ছে। দ্রুত কিছু একটা করা দরকার তার।

টুটুলের ঘরের দরজায় কড়া নেড়ে দাঁড়িয়ে রইলো চৈতালি। ছেলেটার জ্বর মেপে জোর করে হলেও কিছু খাইয়ে দিয়ে ঔষধ দিতে হবে। তারপর ব্যবস্থা করতে হবে ডাক্তারের। ছেলেটির এমন অবহেলিত জীবন যাপন দেখে কোনোভাবেই স্বস্তি পায়না সে। বুকের ভেতরটা কষ্টে ভারী হয়ে আসে। মনে ডাকে কু।
"কে?"
ভেতর থেকে টুটুল চেঁচিয়ে উঠতেই চৈতালি বললো,
"আমি.. থার্মোমিটারটা দাও তো একটু।"
ঘুমঘুম চোখে দরজা খুলে আবারও বিছানার দিকে এগুলো টুটুল।
"কার আবার জ্বর হলো?"
"চমকের গা গরম লাগছে.."
"অহ.. নিয়ে যাও।"
ঘরে ঢুকে ওয়ারড্রবের দিকে এগুলো চৈতালি। ঘরটির জানালাগুলো বন্ধ থাকায় সবটা তার নজরে না এলেও সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে থার্মোমিটার খোঁজার চেষ্টা করে বললো,
"কাল রাতে চমক ঘুমোয়নি.. তুমি কি একবার সুরুজ চাচার কাছে ওকে নিয়ে যাবে?"
"জ্বরটা দেখো.. যদি বেশ মনে হয় নিয়ে যাবো।"
"ঠিকাছে.. কোথায় রেখেছো থার্মোমিটার?"
"উপরেই আছে কোথাও। মোড়ায় দাঁড়িয়ে খুঁজে দেখো.."
পাশ থেকে মোড়া নিয়ে তাতে দাঁড়িয়ে অজস্র জিনিসের স্তুপের মাঝে হাত দিল চৈতালি। তবে থার্মোমিটারের কোনো চিহ্ন সেখানটায় না দেখতে পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে টুটুলের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রয়েছে তার বুকের দিকে। সাথেসাথেই মোড়া থেকে নেমে পড়লো সে। পরনের ওড়না ঠিক করে প্রথম ড্রয়ার খুলতেই ওপাশ থেকে ঘরের আলো জ্বেলে দিল টুটুল।
"তুমি জানো বাবা আমাদের নিয়ে কী ভাবছে?"
কয়েক কদম এগিয়ে এসে টুটুল প্রশ্নখানা করলেও সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চৈতালি বললো,
"কোথায় রেখেছো থার্মোমিটার? মনে করে আমায় বলো।"
"মনে করে বলছি.. তার আগে তুমি আমায় এটা বলো তুমি আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কিছু জানো?"
"জানতাম না.. এখন জানলাম।"
"মিথ্যা বলছো.. তুমি জানতে।"
ঢোক গিললো চৈতালি। অস্বস্তিকর এক পরিস্থিতির হাত থেকে বাঁচতে সে থার্মোমিটার খোঁজা বন্ধ করে দরজার দিকে চেয়ে বললো,
"আমি যাচ্ছি.. তুমি থার্মোমিটার খুঁজে আম্মার কাছে পাঠিয়ে দিও।"
তড়িঘড়ি করে দরজার দিকে এগুলেও মাঝপথেই হঠাৎ নিজের হাতে টান অনুভব করলো চৈতালি। পিছন ফিরে বিস্মিত ভঙ্গিতে টুটুলের দিকে চাইতেই সে মৃদু হেসে বললো,
"তোমার হাসিটা সুন্দর ভাবি।"
"কী করছো এসব? হাত ছাড়ো।"
"আমি তোমাকে নিয়ে ভাবছি ভাবি.."
"হাত ছাড়ো টুটুল.."
টুটুলের শক্ত হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে অপর হাত দিয়ে তার গালে কষিয়ে একটা চড় বসিয়ে দিল চৈতালি। পুরো শরীর তার থরথরিয়ে কেঁপে উঠলেও নিজেকে শক্ত রেখে দৃঢ় গলায় বললো,
"ভাবিও বলছো আবার হাত ধরে টানাটানিও করছো। লজ্জা করছে না তোমার? আজ তোমার ভাই বেঁচে থাকলে এই ধরনের কাজ করার সাহস পেতে তুমি?"
চৈতালির চড় খেয়ে তার হাত ছেড়ে দিতেই টুটুলের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল সে। দ্রুত পায়ে এগুলো নিজের ঘরের দিকে। ঠিক-ভুল, শুদ্ধ-অশুদ্ধ, ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে জানে না সে। করেনা কারো মতামতের তোয়াক্কাও। শুধু এটুকুই জানে আর মানে মুবিন তাকে ঠকাবে না। ছলছলে নয়নে ঘরে ফিরে এসেই ছেলেকে বুকে চেপে ধরলো চৈতালি। চোখজোড়া বুজে অঝোর ধারায় কেঁদে ডেকে উঠলো উপরওয়ালাকে। হে আল্লাহ, মুবিনকে আর সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগিয়ো না। ওকে দ্রুত আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।

আলোছায়া Where stories live. Discover now