আমি তোমার স্বপ্নে পাওয়া আঙ্গুল/স্পর্শ করি জলের অধিকারে

6 0 0
                                    

তখন আমি ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। ক্যাম্পাসে মন বসেনি তেমন করে। নিরুদ্দেশ যাত্রার একটা রোগ কাজ করত আমার মধ্যে সবসময়। মনে হতো কোথাও বেরিয়ে পড়ি। অচেনা স্টেশনে নেমে যে কোনো দিকে হেঁটে হেঁটে পৃথিবীর কোনো সবুজ গ্রামে পথ হারিয়ে ফেলি। সারাটা দুপুর রোদে রোদে ঘুরে বেড়াই। কোনো একটা নদীর তীরে উঁচা রেইন ট্রির পাতায় পাতায় শালিকের ওড়াউড়ি দেখি। পঞ্চগড় গিয়েছিলাম বন্ধুদের সঙ্গে। মহানন্দার পাড়ে অনেক ঘোরাঘুরির পর ঢাকা ফিরব। সৈয়দপুরে এসে ওদের বললাম আমি আর যাব না। ওরা অবাক হয়ে গেল। কই যাবি?

বললাম, খুলনা যাব খালার বাড়িতে। নেমে পড়লাম। দুপুর বেলা সৈয়দপুর শহরটা ঘুরে বেড়ালাম। বিকেলে ট্রেন। টিকিট কেটে অনেকক্ষণ স্টেশনের পত্রিকার দোকানের সামনে বসে থাকলাম। ওয়েটিং রুমে ঝিমালাম। হুমায়ূন আহমেদের বই শেষ করলাম। ব্রড গেজ লাইনের ট্রেনে উঠেছো কখনো? ঝম ঝম গম গম শব্দ হয়। মিটার গেজের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে চলে। সিটগুলো আরামদায়ক, নরম। ট্রেনে উঠে দেখলাম আমার ঠিক মুখোমুখি সিটে একটা সুন্দর মেয়ে বসা। সঙ্গে মালপত্র সুটকেস। পুরো পরিবার। ট্রেন চলতে শুরু করল। জানালার ধারের মুখোমুখি সিট দুটোয় আমি আর সেই মেয়েটা। বাইরের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে আছি অনেকক্ষণ। মাঝে মাঝে চোখাচোখি হচ্ছে। এভাবে নীরব চোখাচোখি আর জানালার বাইরে তাকিয়ে তাকিয়ে পুরো সন্ধ্যা হয়ে গেল। ওই বয়সে যা হয়। ওই বয়স তো তোমারও গেছে, তাই না? আমাদেরও গেছে। হয়তো তোমাদের আলাদা রকম ছিল। কিন্তু আমাদের ওই বয়সটা ছিল আড়ষ্ট একটা সময়। ট্রেন পাকশী স্টেশনে এলে একটু নড়ে-চড়ে বসলাম। পাকশী ব্রিজের নিচে লঞ্চে অনেক উঠেছি। কিন্তু কখনো ব্রিজের ওপরে ট্রেন দিয়ে যাইনি। তখন বর্ষাকাল জানো? আকাশে মেঘ কিন্তু দূরে দূরে। পাকশী আসার আগেই সবুজ ট্রেনলাইনের প্রেমে পড়ে যাচ্ছিলাম। দূরের বাজার, কাছের মানুষ খুব ভালো লাগছিল। ট্রেন ব্রিজের ওপর ওঠার আগেই দেখলাম সেই অপূর্ব জলমণ্ডল। সন্ধ্যার আলো তখনও মেলায়নি। নীল জলে একটু একটু শাদা-কালো মেঘের স্পষ্ট প্রতিবিম্ব। সামনের মেয়েটাকে বললাম, দেখো দেখো। সেও অবাক হয়ে দেখল। পুরো আয়নার মতো জল। স্থির। নদীর আগে একটা বড় জলাধার। তারপর নদী। ভরপুর নদীর জলও দেখলাম শান্ত স্থির। কোনো ঢেউ নেই। তখন তো তেমনই দেখেছিলাম। কিন্তু বর্ষার পদ্মার কথা চিন্তা করলে এখন ভাবি, হয়তো স্থির ছিল না নদীর জল, হয়তো দ্রুতগতির ট্রেনে করে জল পাড়ি দেয়ার সামান্য দৃশ্যটা স্থির হয়ে গিয়েছিল। তমা সঙ্গে সঙ্গে ওর বাবা-মাকে ডেকেছিল। দেখিয়েছিল অপূর্ব স্বচ্ছ সেই নীল জল। ওই সূত্রেই কথাবার্তা চালু হয়ে গিয়েছিল। ওরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। জানতে চাচ্ছিলেন। কোথায় থাকি, কোথায় পড়ি, বাড়ি কোথায় এসব। আমিও জানলাম কিছু। তমার সঙ্গে কথা হচ্ছে। রাতে ট্রেনের ক্যান্টিনে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভোর হলো খুলনা স্টেশনে। ঠাণ্ডা বাতাস আর সকালের নরম আলো ধীরে ধীরে স্টেশনে স্থির হয়ে এলে আমি তাকিয়ে দেখলাম আমার সামনের সিটে কেউ নেই। হয়তো রাতেই কোনো স্টেশনে নেমে পড়েছে। আমার ঘুম না ভাঙিয়ে চলে গেছে। মনটা খুব ভার হয়ে গেল। অন্তত তমা তো জাগাতে পারত। ভাবতে ভাবতে নামছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার বুকপকেটে একটা চিরকুট। তমার ঠিকানা, যশোরের মনিরামপুরের একটা বাসার ঠিকানা। কোনো এক ফাঁকে খবরের কাগজে টুকরোয় লিখে পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছে। বহুদিন ওই চিরকুটটার দিকে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। বিস্ময়কর চিরকুটটায় একটা ঠিকানা ছাড়া আর কিছু ছিল না। কিন্তু না লেখা অনেক কথা সহকারে চিরকুটটা আমি বারবার পড়তাম। বহুদিন বহুকাল জমিয়ে রেখেছি সেই চিরকুট। একটার পর একটা চিঠি লিখেছি চিরকুটের ঠিকানায়। কিন্তু কোনো চিঠিরই উত্তর আসেনি। হয়তো ঠিকানায় ভুল ছিল, হয়তো বাসা চেঞ্জ হয়ে গিয়েছিল।

ফেস বাই ফেসWhere stories live. Discover now