সাল টা তখন ২০১২। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়। গ্রীষ্মের ছুটি চলছে সব স্কুল কলেজে। বাড়িতে বসে একাকী নির্জন সময় কাটাচ্ছিল অদ্রি। পড়াশোনায় খুব মনযোগী হলেও সারাদিন বই নিয়ে বসে থাকার অভ্যাস তার মাঝে নেই। মাত্র কিছুদিন হলো স্কুলে ক্লাস শুরু হয়েছিল। দশম শ্রেণীতে উঠে নতুন নতুন ক্লাস শুরু করেছিল অদ্রি কিন্তু এর মাঝেই আবার ছুটি এসে পড়লো। অবশ্য এখনো গুনে গুনে আরো দশ মাস আছে তার এসএসসি পরীক্ষার। অনেকটা সময় এখনো আছে তার হাতে। তাই বেশি প্যারা না নিয়ে এই ছুটির দিনগুলোতে শুয়ে বসে আরামে সময় কাটাচ্ছিল অদ্রি। ঠিক সেই সময় গ্রামে বন্ধু বান্ধব নিয়ে ঘুরতে এল তার ফুপাতো ভাই ইমতিয়াজ।
ছোট বেলায় ইমতিয়াজ এর সাথে অদ্রির খুব সখ্যতা থাকলেও বয়স বাড়ার সাথে সাথে এটা ক্রমেই কমে এসেছে। এখন বলতে গেলে প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা কথা হয় না তাদের। যখন ইমতিয়াজ ঢাকা থেকে তার মামার বাড়িতে ঘুরতে আসে তখন 'কেমন আছো অদ্রি, পড়াশোনার কি খবর' আর ঢাকা ফিরে যাবার সময় 'ভালো করে পড়াশোনা করো অদ্রি' এমন ধরণের দু একটা কথা ছাড়া তাদের মাঝে বিনা কারণে আর তেমন একটা কথা হতো না। কিন্তু ছোট থাকতে তাদের মাঝে এই জড়তা টা ছিল না। মেপে মেপে কথাও বলতো না তারা। ইমতিয়াজ গ্রামে এলে যেন খুশির সীমা থাকতো না অদ্রির মনে। একসাথে বৌছি, কানামাছি, গোল্লাছুট নামক আরো বিভিন্ন খেলায় তারা মেতে থাকতো। অথচ আজ একে অপরের সাথে কথা বলতেও কেমন যেন একটা অস্বস্তি কাজ করে। অবশ্য ইমতিয়াজ সবার সাথেই খুব কথা বলে। অপরদিকে ইফতেখার ছিল ইমতিয়াজ এর পুরো উলটো। অদ্রির সাথে খুব ভাব ও ছিল। অদ্রির নিজের ও কথা বলতে, এক সাথে চলা ফেরা করতে ভালো লাগতো ইফতেখারের সাথে। দুই আপন ভাইয়ের এতোটা অমিল লক্ষ করে অদ্রি নিজেই মাঝেমাঝে কিছুটা হতাশ হতো।
ইমতিয়াজ এর সাথে এবার গ্রামে এসেছে তার ভার্সিটির ফ্রেন্ড নিলয়। অদ্রির সাথে ইমতিয়াজ এর গ্রামে আসার দিন কথা হলেও পরে আর কথা হয় নি। অদ্রি নিজে ও সেধে সেধে কথা বলতে যায় নি ইমতিয়াজ এর সাথে। এদিকে নিলয় নামের ছেলেটা যেন অদ্রির পিছুই ছাড়ে না। সব সময় বিরক্ত করে মারে। এখানে ঘুরতে নিয়া যাও, ওখানে ঘুরতে নিয়ে যাও শুনতে শুনতে বিরক্তের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মাত্র তিন দিনেই এই হাল। এরা নাকি থাকবে আরো দশ পনেরো দিন। ভেবেই অন্তি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছিল। ঠিক এর মাঝেই এসে উপস্থিত হলো আবার নিলয় নামের বান্দর টা। কিছু কথা এই লোকটাকে শুনাতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তেই নিলয়ের সাথে সাথে অদ্রির ঘরে ঢুকলো ইমতিয়াজ। নিলয়কে দেখে যতটা ফুলে ফেঁপে উঠেছিল ইমতিয়াজ কে ততোটাই চুপষে গেল অদ্রি। বিছানার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো
-"কিছু দরকার?"
ইমতিয়াজ কোনো উত্তর না দেবার আগেই নিলয় বলে উঠলো
-"অবশ্যই দরকার।"
অদ্রি নিলয়ের কথা শুনে মনে মনে বললো তোরে জিগাইছি বেডা!হুদাই আগে আগে মুখ নড়াস।
-"কী দরকার?"
-"তোমারদের বাড়ির ওপাশটায় যে চলনবিল আছে ওইদিক টায় যেতে চাচ্ছি। তুমিও চলো।"
-"আমার মাথা ব্যথা করছে, যেতে পারবো না।"
এ পর্যায়ে ইমতিয়াজ মুখ খুলে বললো
-"অদ্রি, গেলে মাথা ব্যথা টা কমে যাবে।"
অদ্রি বিরক্ত মুখে ইমতিয়াজ এর দিকে তাকিয়ে বললো
-"চলনবিল আবার কবে থেকে মাথা ব্যথা কমানোর ঔষধ হিসেবে কাজ করতে শুরু করেছে?"
-"না, মানে সেটা বলছি না।"
-"সরি, আমি যেতে পারবো না।"
নিলয় এতোক্ষণ চুপ থেকে দুজনের কথা বার্তা খেয়াল করছিল। অদ্রির মুখে বিরক্তির ছাপ দেখে বললো
-"থাক, ওর যেতে হবে না। চল, আমি আর তুইই যায়, ইমতি।"
অদ্রি কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বললো
-"ইমতি ভাইয়াও যাচ্ছো?"
নিলয় হালকা হেসে বললো
-"জ্বি, ম্যাডাম।"
-"আচ্ছা চলুন তাহলে। হাজার হোক আপনি আমাদের এখানে ঘুরতে এসেছেন, আপনাকে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গ্রাম দেখানো আমার দায়িত্ব।"
-"এইতো লাইনে এসেছো। তো যাওয়া যাক তাহলে। ভাবি, আপনি এগোন।"
ভাবি ডাকটা শুনে এই মুহূর্তে দম টা আটকে আসছিল অদ্রির। নিলয় নামের ছেলে টা কী তালে ভাবি বলে ডাকছে? না,ভাবি বলে ডাকবে কেন? কোন জনমের ভাবি হয় নিলয়ের সে? তাহলে কী ভুল শুনেছে নাকি? হুম, এটাই হবে হয়তো। তাই এই একটা শব্দের পিছনে না পরে থেকে অদ্রি এগুলো। ওর পেছনে পেছনে গুঁতোগুঁতি করতে করতে ঘর থেকে বেড়িয়ে এল ইমতিয়াজ আর নিলয়ও।