#আলোছায়া
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১"আমি বেরুচ্ছি রফিক মিঞা। ওদিকে মেয়েটার স্কুল ছুটি দিয়ে দিয়েছে বোধহয়! মেয়েটা একা কেঁদেকেটে অস্থির না হয়ে পড়লে হয়!"
দ্রুত পায়ে হাসপাতাল ছেড়ে বেরিয়ে রিকশায় উঠে বসলো মেসবাহ। উদ্বিগ্ন মুখে হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রিকশাচালকের উদ্দেশ্যে সানরাইজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের নাম আওড়ে কপালের ঘাম মুছে নিল। স্কুলটি খুব একটা দূরে না হলেও তীব্র এই রোদের মাঝে হেটে যাওয়া আজ সম্ভব হবে না। তাছাড়া আজ বেশ দেরি হয়ে পড়েছে। খুব দ্রুত পৌছাতে হবে তাকে স্কুলে। নয়তো বড়সড় একটি ভুমিকম্প আসতে একদন্ড সময় নেবে না!আবারও হাত ঘড়ির দিকে নজর দিল মেসবাহ। বেলা বাজে দুপুর বারোটা। সূর্যর প্রখর তাপ এসে লম্বভাবে পড়ছে তার উপর। যার উত্তাপে পুরো শরীর ঘেমে ভিজে উঠছে। জ্বলুনি ধরছে পিঠের দিকটায়। হাত বাড়িয়ে রিকশার হুডটা উঠিয়ে দিল সে। লম্বা একটি দম ছেড়ে ফুটপাতের দিকে নজর দিতেই চোখে পড়লো মৈত্রীর স্কুলেরই এক বাচ্চাকে। স্কুল তবে ছুটি হয়ে গেছে? অবশ্য তার রাস্তাও বেশি একটা নেই। কিছুক্ষণের মাঝেই পৌছে যাবে সে। তবে মেয়েটি সেটুকু সময় ধৈর্য ধরে থাকলে হলো! বয়স তার খুব একটা বেশি নয়। সবে চারবছর। তবে উল্লাসীর কথামতোই তাকে পাঁচের কোঠা না পেরুতেই ভর্তি করে দেয়া হয়েছে স্কুলে। এতে বরং উল্লাসীর জন্য সুবিধা হলেও অসুবিধায় পড়েছে সে। রোজ রোজ সকালে উঠে মেয়েকে তৈরি করে তাকে নিয়ে স্কুলে পৌছানো, ডিউটি শেষ না হতেই আবারও মেয়েকে স্কুল থেকে আনবার তোড়জোড় তাকে বেশ নুইয়ে দিয়েছে এই ক'দিনেই।
"বাবা.. আমার বাবা। এসে গেছি আমি।"
গেইট দিয়ে ঢুকেই দুইহাত বাড়িয়ে মেসবাহ ডেকে উঠতেই ঠোঁট ভেঁচকে কেঁদে উঠলো মৈত্রী। আহ্লাদে আটখানা হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ফুঁপিয়ে উঠলো সে।
"ভালোবাসে না.. আমাকে কেউ ভালোবাসেনা।"
"ভুল হয়ে গেছে বাবা। ভুল হয়ে গেছে.. আর হবে না ভুল। বাবা সরি.. খুব সরি!"
সে কথা কানে তুললো না মৈত্রী। বাবার দিক থেকে মুখ ঘোরাতে পিছন ফিরলো সে।
"মা তো ফ্রি। তারপরও মা কেনো আসেনা? তুমি কেনো দেরি করো। আমার যে কষ্ট হয় তা তোমরা বুঝো না?"
মৃদু হাসলো মেসবাহ। পকেট থেকে চকলেট বের করে তা মৈত্রীর দিকে বাড়িয়ে ধরতেই আবারও তার দিকে ফিরলো মৈত্রী। চোখের কোণার পানি মুছতে মুছতে তাকে আঁকড়ে ধরতেই মেয়েকে কোলে উঠিয়ে নিল মেসবাহ। বড়বড় পা ফেলে রিকশার দিকে এগুতে এগুতে বললো,
"মা কোথায় ফ্রি? মার তো একটু পরেই কোচিং-এ যাবে।"
"সকালে তো বাসায়ই থাকে।"
"সকালে তো বাসার কাজ করে মা।"
"বাসার কাজ মা নয় করিম খালা করে।"
"মাকে তো দেখতে হয়।"
চকলেট মুখে পুড়ে নাক কুঁচকে ফেললো মৈত্রী।
"ধুর! মা আমাকে ভালোবাসে না। একটুখানিও ভালোবাসেনা। রশ্নির মা সারাটা সময় স্কুলে এসে বসে থাকে। লাবিবের মাও.. কিন্তু আমার মা আসেনা। তার কত্ত কাজ! তার কত্ত লেখা-পড়াশোনা! সে আমায় খাইয়ে দেয় না.. আমায় কোলে নিয়ে চুমুও খায় না!"
মেয়ের মাথায় চুমু দিল মেসবাহ। তাকে সজোরে বুকের ভেতরটায় চেপে ধরে বললো,
"ওদের মায়েদের পড়াশোনা করতে হয় না বাবা।"
"তবে আমার মারও পড়াশোনা করতে হবেনা।"
"তখন যে তোমার মাকে নিয়ে ওরা মজা করবে! বলবে জানিস মৈত্রীর মা পড়তে জানেনা!"
"আমিও বলবো.. তোদের মাও তো পড়তে জানেনা!"
"উহু! ওদের মায়েদের তো পড়াশোনা শেষ। এখন আর পড়াশোনা বাকি নেই বলেই তোমার মার মতো উনারা পড়াশোনা করে না। তেমন তোমার মারও একসময় পড়াশোনা শেষ হবে।
"কিন্তু তখন তো আমি আর ছোট থাকবোনা বাবা.."
মন খারাপ করে ফুটপাতের দিকে তাকালো মৈত্রী। এখন আর হাতের চকলেট খাচ্ছেনা সে। নড়াচ্ছে না পাজোড়া। চোখভর্তি জল নিয়ে সে ভাবছে.. ভাবছে রশ্নির মায়ের মতো কেনো হলোনা তার মা?