"না ঈফা তুমি যাবে না।"
"আমার সকল বন্ধুরা যাবে সবাই অনেক আনন্দ করবে আমিও যেতে চাই।"
"নো মিনস্ নো ঈফা। সবাই গেলেও তুমি যাবে না।"
"মাম্মাম প্লিজ্। তুমি আমাক যেতে অনুমতি দাও।"
পরক্ষণেই ঈফার গালে কষিয়ে চড় বসিয়ে দিলেন অরুনি। তার সিদ্ধান্তের উপর কারো কথা বলা তার পছন্দ নয়।
"তুমি দিন দিন বড্ড বেয়াদপ হয়ে যাচ্ছো ঈফা। আমি যখন বলেছি তুমি যাবে না তার মানে তুমি যাবে না দ্যাটস্ ফাইনাল।"
প্রতিউত্তরে ঈফা আর কিছু বললো না সে চুপ করেই রইলো।
"তুমি খুব ভালো করেই জানো আমার কথার উপর কারো কথা বলা আমি পছন্দ করিনা। আর কখনো যেনো তোমাকে আমার কথার পরে কথা বলতে না দেখি।"
উপরোক্ত কথাটি বলেই সেখান থেকে চলে গেলেন ঈফার মা। ঈফা সেখানেই গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এক ফোঁটা চোখের জল ঈফার গাল বেয়ে গড়িয়ে নিচে পড়লো।
ঈফা ভাবতে লাগলো সে কি এমন বললো যে তার মা তার গায়ে হাত তুললো। এর আগে অনেক বকাঝকা করলেও তার মা তাকে কখোনোই মারেনি। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া বারো বছরের বাচ্চা মেয়ে ঈফা। ছোট থেকেই বেশ চঞ্চল এবং মিষ্টি স্বভাবের অধিকারিণী ঈফা যে কারোরই মন জয় করে ফেলবে। কিন্তু অরুনি ঈফাকে প্রায়সই বকাঝকা করে। আপন মা হয়েও ছোট থেকেই অরুনি ঈফাকে তেমন পছন্দ করতেন না। অরুনির কাছ থেকে মায়ের আদর কখনই পায়নি ঈফা তাই সে জানেও না মায়ের আদর কেমন। কিন্তু মাম্মামের তাকে মারার ব্যাপারটা ঈফা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা। ঈফা চোখের জল মুছে সেখান থেকে দৌড়ে বাড়ির পেছনে থাকা পুকুরপাড়ে চলে গেলো।
অনেক্ষণ ধরেই পুকুরের পানিতে পা ভিজিয়ে বসে আছে ঈফা। বসে বসে মাছেদের ছুটোছুটি, লুকোচুরি খেলা দেখতে তার কাছে বেশ ভালোই লাগছে। ফলে ঈফার মন খারাপটা একটু কমেছে কিন্তু পুরোপুরি ভাবে যায়নি। হঠাৎ সেখানে আর্শি এলো।
"কেমন আছিস ঈফা?"
"কবে ফিরলি?"
"এইতো সবে ফিরলাম এসে দেখি তুই এখানে বসে আছিস।"
"ওহ্!"
"মন খারাপ?"
"একটু।"
"আজকেও কাকি বকেছে?"
"সাথে মেরেছেও।"
"কী কাকি তোকে মেরেছে!"
"হ্যাঁ।"
"আজকে না নতুন স্কুলে যাবার কথা ছিলো তোর?"
"হুম।"
"স্কুলে এমন কিছু হয়েছিলো যে কারণে কাকি তোকে মেরেছে?"
"না।"
"আচ্ছা মন খারাপ করিস না। দেখ তোর জন্যে আমি কী এনেছি।"
"কী?"
"নানুবাড়ি থেকে ফেরার সময় নানু আম দিয়েছিলো। তোর জন্যেও এনেছি খেয়ে দেখ খুব মিষ্টি।"
ঈফা সেখান থেকে একটি আম নিয়ে খেলো।
"হুম আসলেই আমগুলো বেশ সুস্বাদু।"
"মন খারাপ করে এখনো কিছু খাসনি তাই না?"
জবাবে ঈফা কিছুই বললো না। নিরবতা সম্মতির লক্ষণ। আর্শি বুঝতে পারলো ঈফা সত্যিই খায়নি। আর্শি ঈফার চাচাতো বোন হয়।কিছুদিনের জন্য আর্শিরা নানুবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলো আজ ফিরেছে। আর্শি ঈফাকে অনেক আদর করে তাই বাড়ি ফিরেই ঈফার কাছে চলে এসেছে। শুধু আর্শি নয়, অরুনি বাদে বাড়ির সবাই ঈফাকে অনেক স্নেহ করে।
"বুঝিনা কাকি তোর প্রতি এতোটা নিষ্ঠুর কেনো। রাগ করে খাসনি তাই বলে তোকে একবারো ডাকলো না!"
"বাদ দে। এবার বল নানুবাড়িতে কী কী করলি?"
"সে অনেক বড় কাহিনী পরে কোনো একসময় বলবো। আগে তুই বল নতুন স্কুলে প্রথম দিন কেমন কাটলো?"
"শোন তাহলে।"
ঈফা এবার শুরু থেকে সবকিছু আর্শিকে বলতে লাগলো।
◼️ফ্ল্যাশব্যাক◼️
ক্লাসে শিক্ষার্থীদের এটেন্ডেন্স্ নিচ্ছেন শ্রেণিশিক্ষক আয়েশা। সকল শিক্ষার্থীদের এটেন্ডেন্স্ নেয়া সম্পন্ন হলেই ক্লাসে আগমন ঘটলো প্রধান শিক্ষক রাফসান এর। আয়েশাসহ ক্লাসের প্রত্যেকজন শিক্ষার্থী রাফসানকে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করলো।
"আসসালামু আলাইকুম স্যার।"
"ওয়ালাইকুমুস সালাম। বাচ্চারা কেমন আছো সবাই? স্কুলে সকল ক্লাস সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হচ্ছে তো?"
"জ্বী স্যার।"
"বেশ। তোমাদের জন্যে একটি সারপ্রাইজ রয়েছে।"
সারপ্রাইজের কথা শুনে আয়েশাসহ ক্লাসের সকলেই অবাক হলো। সারপ্রাইজটি কী তা জানতে সবাই রাফসানের কথা মনোনিবেশ করলো।
"আজ তোমাদের ক্লাসে নতুন অতিথির আগমন ঘটতে চলেছে।"
নতুন অতিথির কথা শুনে সবাই আরো অবাক হয় পাশাপাশি কে সে নতুন অতিথি তা জানতে বেশ উদ্বিগ্ন হয়। রাফসান ইশারা করলে ধীর পায়ে ক্লাসে প্রবেশ করে ঈফা, ঈফাকে দেখে ক্লাসের সবাই অনেক অবাক হয়। আয়েশা সাদরে ঈফাকে গ্রহণ করেন, রাফসান সকলের সাথে ঈফাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
"তোমাদের জন্যে আরো একটি সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে বাচ্চারা।"
রাফসানের এই কথায় ঈফার সাথে সাথে সবাই আরেক দফা অবাক হয়। আয়েশা রাফসানের কাছে সেই সারপ্রাইজে সম্পর্কে জানতে চায়।
"তোমরা সবাই জানো প্রতিবছর মে মাসে আমাদের স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ট্যুরে যায়। কিন্তু কিছু সমস্যার কারণে এবছর মে মাসে ট্যুর অনুষ্ঠিত হবে না।"
রাফসানের কাছ থেকে এ কথা শুনে অনেক শিক্ষার্থীর মন খারাপ হয়ে গেলো। বাচ্চারা সর্বদাই ভ্রমনপ্রিয়। তাই এবছর স্কুল ট্যুর অনুষ্ঠিত না হবার আশঙ্ক্ষায় তাদের অনেকের মুখেই বিষন্নতার ছাপ ফুটে উঠলো। শিক্ষার্থীরা আশাহীন দৃষ্টিতে রাফসানের দিকে তাকালো।
"এবছর ট্যুর মার্চে না হয়ে চলতি মাসের শেষের দিকে অর্থাৎ ২৯ তারিখ অনুষ্ঠিত হবে।"
রাফসানের আগের কথা শুনে শিক্ষার্থীরা যতটা হতাশ হয়েছিলো পরের কথাটি শুনে তার চেয়েও বেশি উচ্ছাসিত হলো। এ যেনো হারা খেলা জিতে যাওয়ার মতোন অনুভূতি। অতঃপর ক্লাসরুম থেকে রাফসান চলে যাবার পর তাদের আনন্দ-উল্লাস আরো বেড়ে গেলো। সবার সাথে ঈফাও বেশ খুশি কারণ অনেক দিন পর সে ঘুরতে যাবে কোথাও। আয়েশা ঈফাকে সিট্ দেখিয়ে দিলেন, ঈফা তার আসনে গিয়ে চুপ করে বসে রইলো। ছোট থেকেই ঈফা একা একা বড় হয়েছে, মাম্মামের নিষেধাজ্ঞা আর অতিরিক্ত কড়া শাসনের দরুণ বাড়ির বাহিরে খুব বেশি যাওয়া হয়নি তার ফলে আর্শি ব্যতীত ঈফার আর কোনো বন্ধু বা খেলার সাথী ছিলোনা। তাই বাড়ির বাহিরের জগতের সাথে ঈফা অভ্যস্ত নয়। অপরিচিত পরিবেশে ঈফা বেশ ভয় পাচ্ছিলো কিন্তু আয়েশার বন্ধুসুলভ আচরণে সে ভয় খুব দ্রুত চলে যায়।
"হ্যালো নিউ গার্ল্।"
"হাই।"
"তোমার নাম ইনা রাইট?"
"নো মাই নেম ইজ্ ঈফা।"
"সরি ফর মিসটেক্। বাই দ্য ওয়ে আমি রিয়া আর ও আমার ফ্রেন্ড মৌ।"
"নাইস্ মিটিং ইউ।"
"থ্যাংকস্। আমরা কি বন্ধু হতে পারি?"
"সিউর্।"
ঈফাকে একা বসে থাকতে দেখে পাশে বসা দুটি বাচ্চা তার সাথে কথা বলতে এগিয়ে আসে। পরবর্তীতে ঈফা, রিয়া এবং মৌ অনেক ভালো বন্ধু হয়ে যায়। প্রথম দিনে ঈফার ভালো পারফর্মেন্স্ দেখে আয়েশা তার উপর খুবি মুগ্ধ হোন। আয়েশার প্রিয় শিক্ষার্থীদের একজন হয়ে উঠে ঈফা। সময় খুব দ্রুত পেরিয়ে গেলো, স্কুল ছুটির পর ঈফা বাড়ি চলে আসে। স্কুলের ট্যুর্ টা নিয়ে ঈফা অনেক এক্সাইটেড্ ছিলো কারণ এর আগে ঈফা কখনোই কোথাও ঘুরতে যায়নি। ফলে বাড়ি ফিরেই ঈফা সবার আগে মাম্মামকে ট্যুরে যাবার কথাটা বলে। ঈফা অরুনিকে বলে সে ট্যুরে যাবে কিন্তু অরুনি কিছুতেই রাজি হলো না। অরুনির না বলার পরেও ঈফার পুনরায় ট্যুরে যাবার ইচ্ছে পোষণ করলে অরুনি ঈফাকে চড় মারে যাতে ঈফা অনেক কষ্ট পায়। আর্শি ইফার কাছ থেকে সবকিছু শুনলো।
"মন খারাপ করিস না। কাকু এসে কাকীকে বুঝিয়ে বললে দেখবি কাকি ঠিক তোকে যেতে দিবে।"
"হুম।"
"এবার আমাকে একটা সত্যি কথা বল তো।"
"কী?"
"নতুন বন্ধুদের পেয়ে আমাকে ভুলে যাবি নাতো?"
"কখনোই নয়।"
আর্শি ঈফাকে জরিয়ে ধরলো। সবশেষে ঈফাও মুচকী হাসলো।
সারাদিনের কাজ শেষে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরলেন দীপ। দীপ আসার সাথে সাথেই তাকে শরবত এগিয়ে দিলো মিনু। ঈফাদের বাড়িতে কাজকর্মে সাহায্য করে মিনু। দীপ এসেই সবার আগে ঈফাকে খোঁজতে লাগলেন। কিন্তু দুপুরের ঘটনা জানার পর দীপের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। অরুনি ঈফাকে মেরেছে শুনে দীপ ভীষণ রেগে গিয়েছে যা তার রক্তবর্ণ ধারণ করা চোখগুলো জানান দিচ্ছে। বেশ জোরে জোরে অরুনিকে ডাকতে লাগলো দীপ, কন্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে দীপ প্রচন্ড রেগে গিয়েছে।চলবে....
YOU ARE READING
ছন্নছাড়া
Teen Fictionমায়ের অবহেলা, হিংস্রতার স্বীকার এক মেয়ের জীবনে ঘটে গিয়েছে একের পর এক ভয়ংকর, বর্বর, নিষ্ঠুরতা, সকল প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তার এগিয়ে যাওয়ার গল্প।