#ছন্নছাড়া
#পর্ব_১০
#Ashlar_Anuকিছুদিন পর....
ঈফা এখন সবসময় বইয়ের মাঝেই মুখ গুজে থাকে- রিয়া এবং মৌ ব্যতীত স্কুলের অন্যান্য বন্ধুদের সাথেও তেমন কথা বলে না সে। বাড়িতে থাকলে প্রয়োজন ছাড়া নিজ রুম থেকে বাহিরে যায় না। আজকাল কারো সাথেই ঈফা ঠিকমতো কথা বলছে না, কারো সাথেই সে আগের মতোন মিশে না। ঈফা মুখে সবসময় বিরাজমান সেই মায়াবী উচ্ছাসপূর্ণ হাসিটাও আজ তার মুখে দৃশ্যমান নেই- প্রসারিত সেই মুচকি হাসির পরিবর্তে বর্তমানে ঈফার মুখে বিরাজ করে একরাশ গম্ভীরতা।
ক্লাসের সবচেয়ে মনোযোগী শিক্ষার্থী হয়ে উঠেছে ঈফা। ঈফার অগ্রগতিতে সকলেই খুবি আনন্দিত। অরুনি ব্যতীত ঈফার পরিবারের সবাই তাকে নিয়ে খুবি খুশি এবং গর্বিত। বেশ কিছুদিন ধরে কাজের চাপে নানা ঝামেলায় দীপ তার প্রিন্সেস্ ঈফাকে সময় দিতে না পারলেও ঈফার পড়াশুনোর প্রতি আগ্রহ দেখে নিজেও কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো। কিন্তু সবকিছুর মাঝেও যেনো কিছুই ঠিক নেই। সবাই ঈফাকে নিয়ে মেতে থাকলেও মনের দিক থেকে বর্তমানে ঈফা অনেকটা একা হয়ে গেছে। সবাই থাকলেও ঈফাকে মন থেকে বুঝার মতোন কেউ-ই যেনো নেই।
সময় কারো জন্যেই থেমে থাকে না। একের পর এক এভাবেই দিনগুলো কেটে যেতে শুরু করলো। ঈফাদের স্কুলের মিডটার্ম পরীক্ষা অনেক আগেই অনুষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে, কিছুদিন পর তাদের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা। ধীরে ধীরে ঈফাদের হাফ-ইয়ার্লি এক্সামের দিন এগিয়ে আসতে শুরু করলো। কারো সাহায্য ছাড়াই ঈফা সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রচেষ্টায় পরীক্ষার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করেছে।
_______________________________
পরীক্ষার আগের রাতে ঈফা বসে বসে তার সকল নোটস্ এবং বইগুলোতে একবার করে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। তখনি ঈফার রুমে তার বাবা দীপ প্রবেশ করলো। ঈফা মনোযোগ সহকারে নোটস্ গুলো দেখছিলো তাই তার পাপাকে লক্ষ্য করতে পারেনি। এক্সামের জন্যে ভালভাবে প্রিপারেশন্ নিলেও ঈফার মাঝে কিছুটা নারভাস্ নেস্ কাজ করছে, তাই বার বার ভালো করে সবকিছুতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে যাতে ঈফার কোথাও কোনো ভুল না হয়।
“প্রিন্সেস্।”
পেছন থেকে পাপার কণ্ঠ পেয়ে সেখানে ফিরে তাকালো ঈফা।
“পাপা! বাড়ি ফিরলে কখন?”
“এই তো মাত্র আসলাম। আজকে কাজের চাপ একটু কম ছিলো তাই আগে ফিরতে পেরেছি।”
“ওহ্!”
“হুম। তোমার পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন চলছে?”
“মোটামুটি ভালোই।”
“আর্শি কিছুক্ষণ আগে আমাকে কল করেছিলো তোমার সাথে কথা বলার জন্যে কিন্তু আমি তখন ড্রাইভ করে বাড়ি ফিরছিলাম। আমি আর্শিকে বলেছি বাড়ি ফিরে তোমার সাথে কথা বলিয়ে দেব। তুমি কি আর্শির সাথে কথা বলবে, প্রিন্সেস্?”
“না পাপা, আমার এখন ভালো লাগছেনা। কালকে এক্সাম তাই আমাকে অনেক পড়া পড়তে হবে। তুমি আর্শি আপুকে বুঝিয়ে বলে দিও, আমি পরে তার সাথে কথা বলে নিবো।”
“ওকে প্রিন্সেস্। আমি আর্শিকে বলে দিচ্ছি। তুমি কাল তার সাথে কথা বলে নিও। আর এখন পড়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ো।”
“আচ্ছা পাপা। আমার আরো কিছু নোটস্ দেখা বাকি আছে, দেখা শেষ হলেই ঘুমিয়ে পড়বো। তুমি ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে বিশ্রাম নাও।”
“বেশ। অনেক রাত হয়েছে, পড়া কমপ্লিট করে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ো প্রিন্সেস্। বেশি রাত জেগে থেকো না নয়তো তোমার শরীর খারাপ করবে।”
“ওকে।”
দীপ ঈষফার রুম থেকে চলে গেলো। ঈফা ইচ্ছে করেই আর্শির সাথে কথা বলতে চায়নি। সেদিনের পর থেকে আর্শির প্রতি একটা চাপা অভিমান কাজ করে ঈফার, তাই সে সর্বদা চেষ্টা করে আর্শিকে ভুলে থাকার।
পড়া শেষ করে লাইট অফ করে ঘুমিয়ে পড়লো ঈফা।
_______________________________
আর্শি ফোন হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে পুরো ঘর জুড়ে হাঁটাহাঁটি করছে। ঈফাকে একবার দেখার জন্যে, একবার তার গলা শোনাবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছে আর্শি। তার মাঝে অনেক অস্থিরতা বিরাজ করছে। এখানে আসার পর আর্শির ফোনটি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো যার ফলে আর্শি ঈফার সাথে কোনো রূপ যোগাযোগ করতে পারেনি। আজকে শুধুমাত্র কিছুসময়ের জন্যে বাবার ফোন হাতে পেয়ে আর্শি তাই সবার প্রথমেই ঈফার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলো। তাই ফোন হাতে নিয়ে অপেক্ষায় আছে ঈফার ফোন আসার।
অবশেষে আর্শির হাতে থাকা ফোনটা জোরে শব্দ করে বেজে উঠলো। দীপের নাম্বার থেকে কল এসেছে! তার মানে ঈফা কল করেছে তাকে। আর্শি ধরার আগেই কলটা কেটে গেলো। অতঃপর আর্শি কল ব্যাক করতে গেলে আবার কল চলে আসে। আর্শি উদগ্রীব হয়ে ফোন ধরেই ঈফা ভেবে কথা বলা শুরু করে দেয়।
“হ্যালো ঈফা! কেমন আছিস তুই? আমাকে কী ভুলে গিয়েছিস? এখনো রাগ করে আছিস আমার উপর?”
“আর্শি আমি ঈফা নই তোমার কাকা দীপ বলছি।”
“ওহ্। কাকা ঈফা কোথায়?”
“প্রিন্সেসের কালকে পরীক্ষা আছে তাই সে পড়াশুনো করছে। এখন হয়তো ঈফা ঘুমিয়েও পড়েছে। তুমি কালকে ঈফার সাথে কথা বলে নিও কেমন।”
“হুম।”
আর্শি ছোট করে হুম বলেই ফোন টা রেখে দিলো। সে খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছে ঈফা এখনো তার উপর অভিমান করে আছে। নয়তো ঈফা কখনোই তার আর্শি আপুর সাথে কথা না বলে থাকতে পারতো না। আর্শি ছোট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ঈফার তার আপুর উপর অভিমানের পাল্লাটা এতটাই ভারী হয়ে গিয়েছে যে ঈফা তার সাথে আজ কথাও বললো না!
মন খারাপ করেই আর্শি চোখ বুজে বিছানায় শুয়ে রইলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আর্শি ঘুমের দেশে চলে গেলো। ঘুমন্ত আর্শির চোখের কোণে জমে থাকা পানির বিন্দুটি জানালার ফাঁক থেকে আসা চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো।
_______________________________
পরীক্ষা অনেক দিন আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। এক এক করে প্রায় সবগুলো এক্সাম্-ই ঈফা বেশ ভালোভাবেই দিয়েছি। অন্যান্য পরীক্ষাগুলোতে আর্শি আপু এবং তার পাপা তাকে গাইডলাইনস্ দিয়ে হেল্প করলেও এবার সে নিজেই একা একাই প্রিপারেশন নিয়েছে। ঈফার নিজের উপর ভরসা রয়েছে। ঈফা জানে এখন থেকে সামনে আরো অনেক পথ আছে যেখানে তাকে একা চলতে হবে- হয়তো এখন থেকেই সে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আজ ঈফাদের এক্সামের রেজাল্ট দেবার দিন। ঈফা যথাসময়েই স্কুলে এসে পৌঁছে ক্লাসরুমে নিজের সিটে গিয়ে বসলো। ঈফা ক্লাসে বসার পর রিয়া এবং মৌ ঈফার কাছে এসে বসলো- তারা ঈফার সাথে রেজাল্ট নিয়ে কথা বলতে শুরু করলো। রিয়া এবং মৌ উভয়েই এক্সামের রেজাল্ট নিয়ে খুবি এক্সাইটেড্। শুরু রিয়া আর মৌ নয়, ক্লাসের প্রত্যেকেই অনেক উদগ্রীব ভাবে অপেক্ষা করছে পরীক্ষার ফলাফল জানার জন্যে। ঈফা সবসময়ের মতোই চুপচাপ বসে আছে এবং নির্বাক শ্রোতার মতো রিয়া এবং মৌয়ের কথা শুনে যাচ্ছে। পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে তার মাঝে খুব বেশি এক্সাইটমেন্ট্ নেই ঠিকি কিন্তু একেবারে যে নেই তা নয়। ঈফাও মনে মনে অনেকটাই অপেক্ষা করছে ফলাফল ঘোষণার জন্য কিন্তু তা প্রকাশ করলো না।
“আমার অনেক ভয় লাগছে।” (রিয়া)
“আমারো অনেক চিন্তা হচ্ছে।” (মৌ)
“ঈফা তুই কিছু বল!” (রিয়া)
“আমি কী বলবো?” (ঈফা)
“ঈফা রেজাল্ট্ নিয়ে তোর টেনশন্ হচ্ছে না?” (রিয়া)
“কিছুটা।” (ঈফা)
“টেনশন্ করিস না ঈফা দেখবি তোর রেজাল্ট অনেক ভালো হবে।” (মৌ)
“হুম।” (ঈফা)সবার প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে শিক্ষার্থীদের ফলাফল ঘোষণা করলেন আয়েশা। আয়েশা পরীক্ষায় সর্বোচ্চ প্রাপ্ত নম্বরের ক্রম অনুযায়ী প্রথমে থাকা পাঁচজনের নাম ঘোষণা করলো।
ঈফা ক্লাসে সবার মধ্যে ফার্স্ট হয়েছে- প্রায় সব বিষয়েই হাইয়েস্ট মার্ক পেয়েছে সে। সকলে মিলে করতালির সাহায্যে ঈফাকে শুভেচ্ছা জানালো।
আজ আর ঈফাদের ক্লাস করানো হয়নি। ফলাফল জানিয়েই তাদের ছুটি দিয়ে দেয়া হলো।চলবে...
YOU ARE READING
ছন্নছাড়া
Teen Fictionমায়ের অবহেলা, হিংস্রতার স্বীকার এক মেয়ের জীবনে ঘটে গিয়েছে একের পর এক ভয়ংকর, বর্বর, নিষ্ঠুরতা, সকল প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তার এগিয়ে যাওয়ার গল্প।