তাড়াতাড়ি জানলা বন্ধ করে খেতে বসলাম। আমি খাচ্ছিলাম আর ওরা তিন ভাই বোন আমার দিকে তাকায় থাকল। ওদের এভাবে তাকাতে দেখে আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হলাম।
...... কি হল?? সবাই তাকিয়ে আছো কেনো??
...... তোমার চুল খোলা কেন রেনুমা?? চুল খোলা রেখে কেউ খাবার খাই?? দেখো কয়েকটা চুল মুখেও চলে গেসে।
আমি তাড়াতাড়ি মাথায় হাত দিলাম। সত্যি তো!! হাত ধুয়ে আবার খোপা বাধলাম। তারপর আবার খাচ্ছিলাম। কিন্তু এবারও ওরা তাকায় রইলো।
...... রেনুমা তোমার কি হয়ছে বলবা?? তুমি মুক্তার প্লেট কেন নিসো??
আমি প্লেটের দিকে তাকালাম। সত্যি তো!! আমার প্লেট এক পাশে পড়ে আছে। আর আমি মুক্তার খাবার খাচ্ছি। আর মুক্তা আমার দিকে এ্যাংরি বার্ডের মত তাকায় আছে। আমি নার্ভাস ভাবে মুক্তার দিকে তাকিয়ে হাসি দিলাম।
..... স্যরি!!
জবাবে মুক্তা প্লেট কেড়ে নিলো। আমি তারপর নিজের প্লেট নিয়ে খেতে লাগলাম।
খাওয়া শেষে সবাই শুয়ে পড়লে আমি মামুনের ডাইরি টা নিই। প্রতিনিয়ত আমার এটা পড়ার ইচ্ছা জাগে। কিন্তু বিবেক বন্দিনী হয়ে পড়তে পারি না। আবার রেখে দিলাম। মারোয়া ওই দিকে ফিরে ঘুমিয়ে আছে। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। এরপর সবচেয়ে কাজের জিনিস এলার্ম টা দিলাম। কিন্তু আমার ঘুম আসছেনা। কি করি?? ডাইরি টা আবার নিলাম। আমি আইনত মামুনের স্ত্রী তো নিশ্চই পড়তে পারি। এটা দোষের কিছু না। কাপা কাপা হাতে ডাইরি টা খুললাম। সুন্দর ডিজাইন করা ডাইরি। প্রথম পৃষ্টা খুললাম। এর প্রথম পৃষ্ঠায় লিখা
"আমার প্রথম সন্তানের ১৮ বছর ফুর্তিতে এই দিনলিপি। ভালো থাকো আব্বু। আর এই ডাইরি টা তোমার দিনলিপি বানাতে পার। কেননা আল্লাহ তোমার প্রত্যেক কাজের হিসাব নেবেন সুতরাং নিজের দিনের হিসাব নিজেই রাখো"
♪শুভ জন্মদিন আব্বু♪
এটা মামুনের আব্বুর দেওয়া তার আঠারো তম জন্মদিনের গিফট। সযত্নে রেখেছে মামুন। আমার মুখের কোনে হাসি ফুটে উঠল। কিন্তু এটা ফেলে দিল কেন মামুন??
তারপরের পৃষ্ঠা উল্টাতেই আমার হাসি মিলিয়ে গেল। একটা মেয়ের হাসি মাখা মুখের ছবি। চোখে চশমা পড়া। গালে টোল পড়া। মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দরি। সে তুলনাই আমি কিছুই না। সাথে সাথে আমার বুকে প্রচুন্ড ব্যথা অনুভব করলাম। নিজের অজান্তে চোখে পানি চলে আসল।
নিজেকে প্রবোধ দিই এই বলে যে আমি যেটা ভাবছি সেটা নাও হতে পারে।
পরের পৃষ্ঠা উল্টালাম। সেই পৃষ্ঠা থেকে শুরু। সেখানে লেখা ঠিক এই রকম
২-৩-২০১৫ -------------
"আজ আমার জন্মদিনে আব্বু এই ডাইরি টা দিল"
তারপর কয়েক পৃষ্টায় কিছু লেখা নাই। পৃষ্টায় কিছুই লেখা নেই। এরপর এক পৃষ্টায় লেখা
৪-৫-২০১৫---------------
"আজ মুক্তা বৃত্তি পেয়েছে"
এরপর আবার খালি। কিছু পৃষ্টা পর আবার লেখা পেলাম
১০-৮-২০১৫--------
"আজ সিয়ার সাথে প্রথম দেখা। ওর গালে টোল পড়ে। হাসিটা ওর এত মিষ্টি লাগে টোলের কারনে। আমি তো টোলের প্রেমে পড়ে গেলাম।"
আমি বিস্ফোরিত নেত্রে তাড়াতাড়ি আবার ডাইরির পৃষ্টা উল্টিয়ে ওই মেয়ের ছবির দিকে তাকালাম। হ্যাঁ!! এই মেয়েটাই টোল পড়া সিয়া। যার টোলে মামুন মুগ্ধ। আমি নিজের গালে হাত দিয়ে দেখলাম। না আমার কোন টোল নেই বা টোল পড়া হাসি নেই। আমার খুব কান্না পেতে লাগল।
ডায়েরির বাকি পাতা গুলো পড়তে লাগলাম অশ্রু চোখে। যতটুকু লেখা ডাইরি তে তাতে বোঝা গেল সিয়া কে মামুন ভালবাসে আর সিয়াও মামুন কে ভালবাসত। ঘটনা ক্রমে মামুনের মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ ফারানের কাছ থেকে নিতে মামুন আমাকে বিয়ে করে আর সিয়া কে দূরে টেলে দেয়।
এইও বলা চলে যে আমিই দুজনের মাঝখানে চলে এসেছি। নিজেকে আরো একবার অপরাধী মনে হতে লাগল।
আমার আর পড়তে ইচ্ছা হল না। এই! এই ভয়ে আমি ডাইরি পড়তে চাইনি। আমার খুব কান্না পাচ্ছিল। পাছে কান্নার শব্দে মারোয়া উঠে চলে আসে তাই ঘরের বাইরে চলে আসলাম। এরপর ঘাসের উপর বসে আমি নিজের মুখ গুজে হাউমাউ করে কাদতে লাগলাম। আমি জানি না আমি কেন কান্না করলাম। কিন্তু মামুন অন্য কাউকে ভালোবাসে এই কথা ভাবতেই আমার বুকটা চুরচুর হয়ে যাচ্ছিল। কতক্ষণ এভাবে বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করছিলাম জানিনা। ধমকা একটা বাতাসে আমার হুশ হল এখন রাত। আর আমি বাইরে বসে আছি। টলতে টলতে উঠে দাড়ালাম। এখন রাত তাই নিকষ কালো হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পুর্নিমা রাতের মত সবকিছু উজ্জল। অথচ চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। ঘরের দিকে পা বাড়াতেই একটা ধমকা বাতাস ধাক্কা মারল। সেই সাথে বেলি ফুলের সেই মিষ্টি গন্ধটা। আমি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম। আর বুকটা হালকা হয়ে এলো। আর পিছন ফিরে দেখতে চাইলাম যে বেলি ফুলের গন্ধ টা কোথ থেকে আসছে। আবার গন্ধ টা নাকে ধাক্কা মারল। আমি উৎসুক হয়ে গন্ধ বরাবর হাটতে লাগলাম।
হাটতে হাটতে আমাদের ঘরের মালিকের শেষ সীমানা পর্যন্ত আসলাম। এরপর থেকে অন্য মালিকের। আর গন্ধ টা ওই দিক থেকে আসছে। কিছু না ভেবেই আমি ওই দিকে পা বাড়ালাম। এদিকটাই গাছপালা কিছুটা ঘন। তারপরও চারদিকে একটু আলো হওয়ায় সবকিছু দেখা যাচ্ছিল। কিছুদুর হাটতেই সাদা কিছু একটা দেখতে পেলাম। ওই টা কুন্ডলির মত গোল কোন কিছু।
আর গন্ধটা ওই দিক থেকেই আসতেছে। আমি পা বাড়ালাম। সাথে সাথে ঠান্ডা ফিনফিনে বাতাস শুরু হয়ে গেল। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় আমার একটুও ভয় করছিল না। অন্য সময় হলে আমি ভয়ে মরে যেতাম। সাদা কুন্ডলি পাকানো গোল জিনিস টা একটু একটু নড়ছিল। আমি আরেকটু এগিয়ে যেতেই জিনিসটা স্পষ্ট হয়ে এলো। ওটা একটা গাছ। আরো কাছে যেতেই দেখলাম ওটা বেলি ফুলের গাছ। আমার প্রিয় ফুলের গাছ!! আমার মনটা আনন্দে ভরে গেল। দুর থেকে সাদা এই জন্যে মনে হচ্ছিল কারন গাছটা বেলি ফুলে ছেয়ে আছে। এত বেশি বেলি ফুল ফুটে আছে যে দুর থেকে মনে হচ্ছিল যেন সাদা কোন কিছু ভেসে বেড়াচেছ। আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলাম। হঠাৎ আমার খটকা লাগল এখানে বেলি ফুল কিভাবে হবে?? বেলি বর্ষার পানির স্পর্শ পেলে ফোটে। তার আগে না। কিন্তু এখন কোন বর্ষা কাল না। তাহলে ফুল কিভাবে ফুটল?? তাও এত বেশি!!! আমি বেলি ফুল গুলো হাত দিয়ে স্পর্শ করলাম। এগুলো খুবই নরম আর মোলায়েম হয়ে থাকে। একটু স্পর্শ পেলেই ঝড়ে পড়ে। আমি ফুলের উপর হাত বুলাচ্ছিলাম।
আউচ!!! এটা কি?? তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নিলাম ফুল থেকে। কাঁটা লেগেছে আমার আঙ্গুলে। ওখান থেকে রক্ত বের হওয়া শুরু হয়ে গেছে। কয়েক ফোটা রক্ত মাটিতে পড়েও গেলো। অথচ বেলি ফুলের গাছে কোনো কাঁটা থাকে না। এবার আমার কিছুটা ভয় লাগল। এক পা পিছু হটলাম। এক পা পিছু হটতে আমার ঘাড়ে একটা বাতাসের উপস্থিতি টের পেলাম
আর কানে কানে কে যেন আমাকে ফিসফিস করে বলল
"যত দূরে যাও, জানি না ফুরাবে, জেনে রেখো শুধু, ফের দেখা হবে"
কন্ঠ অস্পষ্ট। তারপরও আমি বুঝতে পারলাম। আর সেই সাথে
আমি আমার হার্টবিট মিস করলাম। আতঙ্কে আমার চেহারা নীল হওয়া শুরু হয়ে গেছে। এটা ফারানের গান। ও আমাকে এই গানে প্রথম মেসেজ পাঠিয়েছিল। আমি ঝট করে পিছনে তাকালাম।
...... কেএএএ ও ও ওখানে???
জবাবে শুধু বেলি ফুলের সুবাস ভেসে বেড়াতে শুরু করল।
আমার প্রচুন্ড ভয় লাগছিল। আমার ভিতর থেকে আওয়াজ আসছিল যে এখনি পালাও। কিন্তু আমি পালাতে পারছিলাম না। মনে হল আমার পা মাটির সাথে আটকে আছে। কিছুতেই পা নাড়াতে পারছিলাম না। সেই সাথে ঘাড়ে কারো নিঃশ্বাসের অনুভুতি। এবার কেউ যেন পিছন থেকে আমার কোমড়ে হাত দিলো। আমি চিৎকার করতে চাইছিলাম কিন্তু কোন আওয়াজ বেরুলো না। লং স্কার্ট পড়েছিলাম। আর উপরে ফতুয়া। তাই হাতটা আমার পেটের সংস্পর্শে আসছিল। আমি চিনি এই স্পর্শ টা। ধীরে ধীরে দু হাত দিয়ে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। তারপর আমার চুলে নাক ডুবিয়ে শুকতে লাগল। এতক্ষন পর আমার হুশ হল যে আমার চুল খোলা অবস্থায়!!! আমি কোন রকম ভাবে বললাম
...... ফাপ ফাআরাআ আন!!
নাকটা চুল থেকে ঘাড়ে চলে গেল। তারপর অস্পষ্ট আওয়াজে বলল
...... Faran Loves Mohini Forever Ever And Ever!!!
...... আ আ পপনি বেবেবেচে আছেন??
এবারো জবাব অস্পষ্ট।
...... Love Never Dies Mohini!! Never!! And I Am Come Back For you!! Only for You!! And This Time I am Not Going Anywhere!!
এই কথা শুনে আমি ভাষা হারিয়ে ফেললাম। মনে হল এখনি আমি হার্ট এট্টাক করবো।। আমি ঘামছিলাম আর প্রচুন্ড ভয় হচ্ছিল। কোন রকম সাহস জুটিয়ে বললাম
...... আআমামকে ছেচে ড়েএএ দেন।
...... Never!!!
...... প্লিজ!!
এবার কোন জবাব এলোনা। শুধু মনে হল আমার ঘাড়ে বারবার কিছু একটার স্পর্শ হচ্ছে। আমি চমকে উঠলাম। ফারান আমার ঘাড়ে চুমু দিচ্ছে!! আমি চেষ্টা করলাম ছাড়াতে।। পারলাম না। আর সাথে সাথেই আমার চারপাশের দুনিয়াটা দুলতে লাগল। চোখমুখ অন্ধকার হয়ে এলো। এরপর আর কিছু মনে নেই আমার।
.
(চলবে)
YOU ARE READING
মোহিনী_২ ♥প্রেমান্ধ♥
Romanceপ্রেমের মানুষের জন্য দুনিয়া এক করে দেয়া এক পাগল প্রেমিকের গল্প... ♥