এক মুঠো গোলাপ ১

42 1 1
                                    

এক মুঠো গোলাপ

সূচনা পর্বঃ
আমার মানসপটে ভেসে ওঠে এক যুবা পুরুষের প্রতিচ্ছবি । দীর্ঘ গড়নের সেই যুবকটি সুপুরুষ, সুদর্শন । তার পিঙ্গলবর্ণের গভীর দু'টো চোখজোড়ার সেই মায়াময় প্রগাঢ় চাহনি আজও মনে পড়লে আমার শিরা উপশিরা অদ্ভুত শিহরণে আন্দোলিত হয়ে যায় । তার সেই ঘন কালো  ভ্রুযুগোল , লাবণ্যময় মুখমণ্ডল , পুরু ওষ্ঠাধরে স্নিগ্ধতা মাখানো সেই মৃদু হাসি আমি আজও ভুলতে পারিনা । আমার মন-মস্তিষ্ক জুড়ে তার সাথে কাটানো কিছু সুখ দুঃখের স্মৃতি সর্বদা ঘুরে বেড়ায় ।
বলছি আমার জীবনের সেই সুপুরুষটার কথা যার ভালোবাসার শেকল আমায় আজীবনের জন্য বন্দী করে নিয়েছে ভালোবাসার রাজ্যে যে রাজ্যের বন্দীদশা থেকে মুক্তি এ জন্মে সম্ভব নয় ।

তার সাথে প্রথম দেখা দুর্ঘটনা বশতঃ
সে বার প্রিয় বান্ধবীটির ঊনিশ তম জন্মদিন উপলক্ষে তাকে সারপ্রাইজ দেয়ার উদ্দেশ্যে একটা ছোট্ট পার্টির আয়োজন করা হলো বাসায় । যাবতীয় খরচ বন্ধুরা করলেও কেক আনার দায়িত্ব পড়লো আমার ওপর । ঘরকুনো মানুষ আমি আলসেমীতে ঠাঁসা । বাইরে বেরুনোর কথা উঠলে, পারলে কম্বলের নিচে গিয়ে লুকোই, সে ই আমাকেই দায়িত্বের গ্যারাকলে ফেলে হাত উঠিয়ে নিলো বাকিরা।
ভাদ্র মাসের অস্থির গরমে মাথা ভর্তি রাগ নিয়ে বেরুলাম বাজারের উদ্দেশ্যে । সেদিন আবার আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে একটা সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল শহরে । টাউনহল থেকে শুরু করে প্রেসক্লাব মোড় পর্যন্ত রাস্তা ব্লক করে ভাষণ দিচ্ছেন মাঝবয়সী রাজনীতিবিদেরা । দীর্ঘ সময় জ্যামে বসে থাকতে থাকতে একটা সময় উপলব্ধি করলাম এর থেকে হেঁটে গেলে জলদি কাজ সারতে পারবো । পরিকল্পনা অনুযায়ী রিকশা ভাড়া মিটিয়ে হাঁটা ধরলাম নিউ মার্কেটের দিকে । অন্যান্য দিন মানুষে গিজগিজ করলেও আজ হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া আর কাউকে নজরে আসছে না এদিকটায় ।
একদিক দিয়ে ভালো হয়েছিল খুব দ্রুত নিঃঝঞ্ঝাট  খরচপাতি করে ফিরছিলাম আমি ।
প্রেসক্লাব মোড়ে ত্রিমুখী রাস্তা , হাতের ডান দিকে গেলে সহজেই বান্ধবীর বাসায় পৌঁছানো যায় ।
কিছু না ভেবেই শর্টকাট নিয়ে এগুচ্ছিলাম আমি ।
অদ্ভুত ভাবে আজ এই রাস্তাও একদম শুনশান ।
ভাতের হোটেল পেরিয়ে বড় রাস্তায় ওঠার মুহুর্তে একটা ছেলের কথায় আমার পা জোড়া থেমে যায় ।
লাল রঙের বাইকে বসে একটা ছেলে শিষ বাজিয়ে আমায় ডেকে ওঠে_
-- এই যে খুকি এদিকে এসো তো?
বেশভূষায় বখাটে বুঝতে পেরে আমি চট করে সামনে ঘুরে দ্রুত পা চালাতে থাকি । প্রত্যাখান মেনে না নিতে পেরে ছেলেটা আমার পিছু পিছু বাইক চালিয়ে আসতে থাকে । ইভটিজিং কেইসে ভিক্টিম হওয়ার ঘটনা এই আমার প্রথম যার ফলে প্রচন্ড ভয়ে দিগ্বিদিক হারা হয়ে কোন গলি থেকে কোন গলি তে ঢুকতে থাকি তার হিসেব নেই ।
ছেলেটা তো বাইক চড়িয়ে পিছু পিছু আসছে আর অনবরত ডেকে যাচ্ছে আমাকে ।
আমি মনে মনে আল্লাহকে ডাকছি আর প্রতিজ্ঞা করছি আর কখনো একা বেরুবো না । আজকের জন্য যাতে আল্লাহ বাঁচিয়ে দেয় ।
আমার ডাক খুব জলদিই আল্লাহ শুনলেন । কোথা থেকে একটা গাড়ির হর্ণ ভেসে আসলো । এক পলক পেছনে তাকিয়ে দেখলাম একটা কালো রঙের মার্সিডিজ ঠিক বাইকারের পেছনে ।
আত্মায় যেন পানি এলো । আমি দৌড়ে বাইক ক্রস করে মার্সিডিজের সামনে দাঁড়ালাম । আচমকা সামনে আসায় খুব জোরে ব্রেক কষলো গাড়িওয়ালা আর আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলাম ।
কয়েক মুহুর্ত পরে কোনো ব্যথা অনুভূত না হওয়ায় পিটপিট করে যখন চোখটা খুললাম তখন দেখি পিঙ্গল বর্ণের চোখজোড়ার সেই মালিক অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে আমার দিকে ।
আমি ধাতস্থ হয়ে বিড়বিড় করে বললাম_
-- প্লিজ আমাকে বাঁচান ঐ ছেলেটা আমাকে কিডন্যাপ করে নিবে ।
সে আমায় কোনো উত্তর না দিয়ে গলা বাড়িয়ে আমার পেছনে তাকালো । আমি দেখলাম পেছনে তাকাতেই তার ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো । সে ভারী অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো_
-- আশিক তুই এখানে? তুই এই মেয়েটাকে কিডন্যাপ করছিলি?
-- আরে না ভাই আমি ওকে কিডন্যাপ করবো কেনো? আমি তো ওকে চিনি , আমি পরীক্ষা করছিলাম ও আমায় চেনে কি না! একটু মজা করে ডাকলাম কিন্তু ও আমায় এত ভয় পেলো যে দিগ্বিদিক হারা হয়ে কোথায় কোথায় দৌড়োতে থাকলো ।
আশিক নামক ছেলেটার কথা শুনে এবার আমি চট করে তাকালাম তার দিকে ।
ভালো করে লক্ষ করতেই মনে পড়ে গেলো আরেহ্ এ তো আমার বান্ধবী আভার ভাই । যে বান্ধবীর জন্মদিনে আমি যাচ্ছি তার ভাই কেই চিনতে পারিনি! অবশ্য না চেনারই কথা , চুল দাড়ি বড় করে গুন্ডার থেকে তো কম মনে হচ্ছে না। আবার বাসায়ও থাকেনা সারাদিন । দেখিই না তো ওদের বাসায় গেলে ।
জন্মদিন শব্দটা মাথায় আসতেই আমার কেকের কথা মনে পড়লো । দেখলাম হাতে নেই। আমার সাধের কেক নিচে পড়ে আছে অবহেলিত ভাবে ।
আমি ভয়ে ভয়ে বক্সটা তুলে নিয়ে দেখলাম পুরো কেক টাই ভেঙে চুরমার । কেকের এই হাল দেখে আমার চোখ ভেঙে কান্না চলে আসলো । অপরিচিত মানুষের তোয়াক্কা না করে আমি হু হু করে কেঁদে ফেললাম ।
আমার হঠাৎ কান্না দেখে উপস্থিত দু'জনই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো হয়তো । আশিক ভাই দৌড়ে এসে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললো_
-- আরে আরে খুকি কি হয়েছে কাঁদছিস কেনো?
-- আমার কেক ভেঙে গেছে । ইশশ আমার এত সাধের কেক! এখন আভা কে সারপ্রাইজ দেবো কি করে? আমার কাছে তো টাকাও নেই ।
কাঁদতে কাঁদতে টাকার কথা অকপটেই বলে দিলাম আমি ।
আশিক ভাইয়া ব্যস্ত হয়ে আমাকে ওঠালো , বললো_
--  তাই বলে কাঁদবি তুই? আবার না'হয় কিনে নিবো , আমি টাকা দিবো তোকে চিন্তা কিসের?
-- কিন্তু ঐদিকে দোকান তো সব বন্ধ ।
-- আরেহ্! ছাত্রলীগের ভাই গুলো দোকানপাট বন্ধ করতে বলেছে ,ভুলেই গিয়েছিলাম আমি । এখন কি হবে?
-- আমি হেল্প করতে পারি ।
আমাদের পাশে দাঁড়ানো মানুষটা বলে উঠলো ।
-- তবে হ্যাঁ ফ্রী তে কিন্তু হেল্প করবো না ।
-- কিন্তু আমার কাছে তো টাকা পয়সা নেই ভাইয়া
-- ওকে আপাতত ঋণী থাকো ।
-- ওকে ডান ।
আশিক ভাইয়া হেসে বলল_
-- হয়েই তো গেলো তবে । এখন চোখের পানিটা মুছে নে , সাজগোজ তো সব নষ্ট হয়ে গিয়েছে ।
পকেট থেকে রুমালটাও বের করে দিলো ভাইয়া ।
-- আমি বাইক নিয়ে আসছি তুই ভাইয়ার থেকে কেক টা নিয়ে আয় । একসাথে বাসায় যাই ।
আমি মাথা নেড়ে চোখটা মুছে ওনার থেকে কেকের বক্সটা নিয়ে নিলাম । বক্সটা হাতে দেবার সময় উনি একটুখানি কেশে বললেন_
-- ঋণী থাকলে মনে রেখো ।
আমার একটু বিরক্ত লাগলো । মনে মনে ভেংচি কেটে ছোট্ট করে বললাম_ থাকবে মনে ।

এক মুঠো গোলাপWhere stories live. Discover now