এক মুঠো গোলাপ
৬
__
ভালোবাসা এক নিমেষে হয়ে যেতে পারে আমি এরকম মতবাদে বিশ্বাসী । সেদিন রাতের ঘটনার পর থেকে নিদ্র'র সাথে দ্যাখা হলো না অনেকদিন৷ আমার খুব অস্থির লাগতো , ভাবখানা এমন তাকে এক পলক না দেখলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে । আমি ইনিয়েবিনিয়ে আভার কাছেই জানতে চাইতাম সব। আভা চোখ সরু করে দুষ্টুমি ভাব ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করতো হুট করে তার প্রতি ক্যানো ইন্টারেস্ট বেড়ে গেল?
আমি একটা কথাও লুকোতাম না । প্রথমবারের মত কাউকে এক পলক দেখবার তীব্র আকাঙ্খা দমিয়ে রাখা আমার পক্ষে যেন অসম্ভব হয়ে উঠছিল ।
আমার আকুলতা আভার মনেও নাড়া দিয়ে গিয়েছিল হয়তো । এক শুক্রবার সকালে ওর বাসায় ডেকে পাঠালো আমায়৷ আভার বাসায় যাবো মানেই নিদ্র'র সাথে দ্যাখা হবে? ভাবতেই অন্যরকম সুখে চোখের কোন ভিজে উঠছিল ।
নিজেকে পরিপাটি করে আভার বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম৷ বড় লোহার গেট খুলে আমাদের গাড়িটা যখন ভেতরে প্রবেশ করছিল তখন উত্তেজনায় কাঁপছিলাম আমি ।
আজ আভা আমায় রিসিভ করতে দাঁড়িয়ে ছিল বাসার নিচে ।
গাড়ি থামা মাত্র আমি হুড়মুড় করে নেমে গেলাম । লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে আভার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম_"সে কই?"
আভা মুখ কালো করে ফেললো । আমার ডান হাত চেপে ধরে সোজা ছাদে নিয়ে এলো । আমার বুকের ভেতরটা তখন ধুকপুক ধুকপুক করছে ।
দোলনায় বসিয়ে ও আমায় জিজ্ঞেস করলো_
-- তুই হুট করে নিদ্র ভাই কে নিয়ে ভাবতে শুরু করলি ক্যানো?
-- জানিনা হুট করে ভালো লেগে গেল ।
-- হুট করেই?
-- না মানে..
-- তুই কি ভাইয়ার সাথে নিজের পরিস্থিতি ম্যাচ করানোর চেষ্টা করছিস?
প্রত্যুত্তরে আমি কিছু বললাম না কেবল মাথা নিচু করে রইলাম । আভা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ।
-- নিদ্র ভাইয়ার প্রতি সিম্প্যেথীই থেকে কোনো ফিলিংস আনিস না সুপ্ত । সামহাউ তোদের আ্যাটাচমেন্ট হয়ে গেলে কিছুটা সময় স্পেন্ড করার পর তোর নিজেরই বিরক্ত লাগবে । দু'জনেই খারাপ পরিস্থিতিতে পড়ে যাবি । তুই কি অস্বীকার করতে পারবি প্রিয়কে তুই মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত ভুলতে পারবি না!
-- না অস্বীকার করতে পারবো না বাট আমার কাছে এটা সত্যি যে আমি নিদ্র কে ভালোবেসে ফেলেছি । তুই একটা কারণ বলবি আমি হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি? বিনিময়ে ওকে ভালোবাসার হাজারটা কারণ আমি দাঁড় করাতে পারবো তোর সামনে । আমি যদি বলি তোর বার্থডে প্রোগ্রামের রাতে সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর মাঝরাতে ঘুম ভেঙে মাইগ্রেনের ব্যথায় যখন কাবু হয়ে ছিলাম তখন নিদ্র আমায় পরম স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল , মশলা চা বানিয়ে খাইয়েছিলো সেই ঘটনাটা আমায় মুগ্ধ করেছে । তোরা কেউ জানিস না আমি ব্যথার কারণে কিছু ঘটনা ভুলে যাই । এটা হয়তো সবার সাথে হয়না এটাকে রেয়ার বলতে পারিস । আমি পরদিন সকালেও নিদ্রর সাথে কাটানো মুহুর্তটা মনে রাখতে পারিনি কিন্তু এই ক'দিনে হাজারবার অতটুকু স্মৃতি মনে পড়ে গিয়েছে ।
কত হাজারবার ওর প্রোফাইল চেক করেছি , ওর বন্ধুদের থেকে ইনফরমেশন নিয়েছি । বলতে পারিস ওর ওপর থিসিস করে ফেলেছি । এই যে আজ এত পরিপাটি হয়ে এসেছি? ওর জন্য । ওকে মুগ্ধ করবার ক্ষমতা আমার হয়তোবা নেই তবুও আমি চেষ্টা করেছি । আমি এলোমেলো , পাগল মত কিন্তু নিজেকে গোটানোর চেষ্টা করছি । এই ক'দিনে আমি এক মুহুর্তও ওকে ভাবনা থেকে বাদ দিতে পারিনি । তবুও বলবি সিম্প্যেথীই কিংবা আ্যাট্রাকশন?
-- আই আন্ডার্স্ট্যান্ড সুপ্ত । বাট.. তুই ভাইয়ার ফ্রেন্ডদের সাথেও কথা বলেছিস?
-- হ্যাঁ বলেছি । সে আমার কাজিনেরও ফ্রেন্ড হয় এন্ড আমি এটা জেনেছি কিছুদিন আগেই । আপুর সাথে হ্যাংআউটের একটা পিকচারে ।
-- তুই তাহলে শিওর ভাইয়ার জন্য ফিলিংস কাজ করে তোর মধ্যে?
-- ইয়েস ১০০%
-- যদি তাই হয় তাহলে এ ব্যাপারে আমি তোকে হেল্প করবো । আগে তার সম্পর্কে সবটা জানতে হবে তোকে ।
-- তোর মুখ থেকে নয় তার মুখ থেকেই শুনতে চাই ।
-- বাব্বাহ কনফিডেন্স লেভেল তো হাই ম্যাডামের ।
-- আরে তুই আছিস না!
আমার প্যাম্পারিংয়ে খুশি হয়ে গেলো আভা । হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর বাকিটা সে সামলে নিবে ।
খুশি উদযাপন হলো কিছুক্ষণ , এরপর শুরু হয়ে গেলো প্ল্যানিং ।
একটা নিউজ শুনে মন খারাপ হলো ,নিদ্র গতকাল রাতে ঢাকায় ব্যাক করেছে । ফিরবে কবে জানা নেই । আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছিলো শুনে । এত কষ্ট করে সাজলাম কার জন্য!
তবে আভা আশা ছাড়তে মানা করে দিলো । সেদিনের মত কিছু উল্টোপাল্টা প্ল্যান করে বাসায় চলে আসলাম ।
___
বাসার পরিস্থিতি দেখে আমার মাথায় হাত । ড্রয়িংরুমের সোফায় আইসব্যাগ মাথায় নিয়ে বসে আছেন বাপি তার অপজিটে আপু এবং তৌহিদ ভাই । আপু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে , আর তৌহিদ ভাই চোখ গরম করে তাকাচ্ছে তার দিকে ।
আমি নিঃশব্দে বাপির পাশে দাঁড়িয়ে বিস্মিত হবার ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলাম_
-- কি চলছে বাপি?
আমায় দেখে বাপি- আপু দু'জনেরই যেন আত্মায় পানি ফিরে পাওয়ার দশা হলো ।
বাপি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন_
-- সুইট মামণি তোমার এই ছাগল বোনটাকে বোঝাও তৌহিদের সাথে বিয়েতে যাতে ও রাজি হয় ।
আপু বিরোধ করে বলল_
-- নাহ্ সুপ্ত তুই এই উল্টোবুদ্ধি তৌহিদকে বলে দে আমি ওকে বিয়ে করবো না না না ।
আমার কিছু বলবার আগেই তৌহিদ ভাই খেঁকিয়ে উঠলেন_
-- রাফনিদ অনেক বাড়াবাড়ি হয়েছে । আর না বললাম । বাবা আমাকে পারমিশান দিন আমি ওকে তুলে নিয়ে কাজি অফিসে ফেলবো তারপর দেখি ও কীভাবে বিয়েতে রাজি না হয়!
তৌহিদ ভাইয়ের কথা শুনে আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম । আপু "নাআআ" বলে মৃদু চিৎকার দিয়ে আমার পেছনে এসে লুকোলো, অনুনয় করে বলল_"সুপ্ত কলিজা আমার । বাঁচা আমাকে"
তৌহিদ ভাই সটান দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আদেশ করলেন_"সুপ্ত তোমার বোনের হাত শক্ত করে চেপে ধরো । আজ ওকে বিয়ে না করে ছাড়ছি না আমি"
আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম । ডানে যাবো নাকি বাঁয়ে যাবো? করুণ চোখে মায়ের দিকে তাকালাম । মা মুখ চেপে হাসছে ।
আমি বুঝে গেলাম এরকম চিড়িয়া ঘরে কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় ।
আপুকেই রাজি হতে হবে শেষ পর্যন্ত । আপুর হাত ধরে সামনে এনে সোফায় বসিয়ে দিলাম । ওর পাশে হাঁটু মুড়ে বসে তৌহিদ ভাই কে উদ্দেশ্য করে বললাম_
-- ভাইয়া আপনি কি আমার বোন সম্পর্কে সবটা জেনে তারপর বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?
তৌহিদ ভাই মাথা নেড়ে হু বললেন ।
আমি আবারও প্রশ্ন করলাম_
-- আপনারা আমার সিনিয়র বিয়ের মত ভারী একটা শব্দের গুরুত্ব কিংবা মহত্ত্ব আমার চাইতে ভালো জানেন তবে একটা কথা বলে রাখি আমি আপুর ব্যাপারে ভীষণ পোজেসিভ । ওর চোখে এক ফোঁটা পানি আমার সহ্য হয়না । বিয়ের পর ওর একটা অক্ষমতাকে কেন্দ্র করে যদি আপনার ফ্যামিলি কিংবা আপনার কাছ থেকেই কোনো কটু কথা শুনতে হয় এবং ও যদি কষ্ট পায় তা'হলে আমি আপনাদের ছেড়ে কথা বলবো না । স্যরি ফর ইন্টারফেয়ারেন্স আমি খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছি সমাজ স্বীকৃত নাদিম হক চৌধুরীর ওয়াইফ বর্ষা হক চৌধুরী আপনার স্টেপ মম?
ইউজুয়ালি দ্বিতীয় পক্ষ প্রথম পক্ষের সন্তানদের পছন্দ করেন না এবং জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে তারা বাঁধার সৃষ্টি করেন । আপনার আর আপুর বিয়েটা নিয়ে যদি ওনারা কোনো ঝামেলার সৃষ্টি করেন?
-- সম্ভব নয় কারণ আমার বউকে নিয়ে আমি আমার বাসায় থাকবো আমার বাবা'র বাসায় নয় । বলতে লজ্জা নেই আমার বাবা এবং তার স্ত্রীর সঙ্গে আমার কোনো প্রকার সম্পর্ক নেই । আমি ছোটোবেলা থেকেই আমার নানাজান-নানীবু এর সাথে থাকি । বাবার সাথে আমার তেমন একটা সম্পর্ক নেই শুধুমাত্র অফিশিয়াল কিছু ডিসকাশন ছাড়া এবং আমি আমার বাবার টাকায় চলাফেরা করিনা । আজ আমার যতটুকু আছে সব আমার এবং আমার মায়ের কষ্টার্জিত সম্পদ ।
রাফনিদ কে আমি ভালোবাসি সুপ্ত । ওকে ছাড়া একটা মুহুর্ত কল্পনা করা অসম্ভব আমার পক্ষে । ওর সব খামতি মেনে নিতে রাজি আমি শুধু আমায় একটু ভালোবাসবে , আর কিচ্ছু চাইনা আমার কিচ্ছু না ।
একটাবার তোমরা আমাকে বিশ্বাস করে দেখো? আমি যদি বিশ্বাসের মর্যাদা না রাখতে পারি তখন যা শাস্তি দিবে মাথা পেতে নিবো ।
তৌহিদ ভাইয়ের চোখের কোনে জল । তার চোখের ভাষাই বলে দিচ্ছে আমার আপুটার জন্য এক পৃথিবী ভালোবাসা বুকে নিয়ে বসে আছে ।
আমি মৃদু হেসে আপুর দিকে চাইলাম । মাথা নিচু করে বসে আছে ।
ওর গালে একটা চুমু দিয়ে বললাম_
-- মানুষটা তোকে সত্যিই ভীষণ ভালোবাসে রে ।
আপু তবুও মাথা নেড়ে বলল_ আমি বিয়ে করবো না ।
আমি তৌহিদ ভাইয়ের চোখে চোখ রাখলাম , একটু ইশারা করতেই ওনার মুখে বিজয়ের হাসি ফুটে উঠলো ।
এক মুহুর্ত দেরি না করে উনি সোজা আপুকে কাঁধে ফেলে বললেন_
-- শুধুমাত্র তোমার জন্য লজ্জার মাথা খেয়ে শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সামনে দিয়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছি , এর শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে নিদ ।
তারপর মা-বাপিকে উদ্দেশ্য করে বিনীত ভঙ্গিতে বললেন_
-- স্যরি মা , স্যরি বাবা এই মেয়ের ত্যাড়া আচরণের জন্য এতবড় স্টেপ নিতে হলো । প্লিইজ মাফ করবেন ।
বাপি-মা দু'জনেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় , কোনো রকমে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলে তৌহিদ ভাই ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেলেন ।
আপু তো ঐদিকে চিৎকার চেঁচামেচি করছেই ।
আমি মূর্তমান বাপির পাশে বসে বললাম_
-- তৈরি হও কণ্যাসম্প্রদান করবে না?
বাপির রসগোল্লা সাইজের চোখ এবার বড় আলুতে পরিণত হয়ে গেলো । আমি লাজ লজ্জা ঝেড়ে ফেলে ড্যাং ড্যাং করে তৈরি হতে চলে আসলাম । বোনের বিয়ে , ছবি ভালো আসা চাই তো ।
__
নাকের পানি চোখের পানি এক করে বিয়েটা কমপ্লিট হলো আপুর । তৌহিদ ভাইয়ের ফাইনাল পরীক্ষা বলে আজই আপুকে নিয়ে যাবেন ঢাকায় , আপু কিছুতেই যাবে না । শেষে ধমকা ধমকি করে তাকে গাড়িতে ওঠালেন তৌহিদ ভাই ।
গাড়ি ছাড়বার মুহুর্তে আপু আমার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলল_
-- জানিস এই ডাকাত ছেলেটা আমায় কি বলেছে?
টুনাইট হি উইল মেসম্যারাইজ মি উইথ কাপঝাপ ।
-- কাপঝাপ? হোয়াট ইজ দ্যাট?
-- জানিনা । ভয় লাগছে আমি যাবো না রে প্লিইজ..
-- কিচ্ছু হবেনা আপু ভয় পাচ্ছিস কেনো? আমি আছি তো ।
আমাদের সাথে থাকার জন্য আপু একপ্রকার নাকে কান্না শুরু করলো । কিন্তু নাকে কান্না করেও বিশেষ লাভ হলো না । আমরা সবাই নিষ্ঠুরতম আচরণ করলাম তার সাথে ।
আপুকে বিদায় দিয়ে মা-বাপির চোখ থেকে সুখের অশ্রু ঝরতে দেখা গেলো ।
আমি আবারও একটা বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আপুর সন্তানের কমতিটাও আমিই পূরণ করবো । আমার গর্ভের সন্তান মা হিসেবে রাফনিদকেই চিনবে জীবনভর ।
চলবে?
sinin tasnim sara
YOU ARE READING
এক মুঠো গোলাপ
Mystery / Thrillerশুচিস্মিতা কবির সুপ্ত। সর্বদা নিজ জীবন চক্রকে জটিল ভেবে এসেছে। এক সময় তার জীবন সম্পর্কে জটিল ধারণাগুলোকে ভুল প্রমাণ করে জীবনের মানে শেখাতে এসেছিল একজন। জীবন নামক বর্ণহীন আকাশে হুট করে শত রঙের প্রজাপতি ডানা মেলে উড়তে শুরু করেছিল। সকল জড়তা কাটিয়ে বর্ণ...