এক মুঠো গোলাপ
৩
__
আমি সাধারণত নিজেকে যেরকমটা দেখানোর চেষ্টা করি তেমন কিন্তু নই। সকলের সামনে একটা ম্যাচিওর ,প্রাক্টিক্যাল মেয়ে হলেও ভেতরে ভেতরে সবচাইতে ইমোশনাল এবং ইমম্যাচিওর আহ্লাদি মেয়েটা হয়তো আমি ওহ্ হ্যাঁ তার সাথে যুক্ত করতে পারেন ভালোবাসার কাঙ্গাল । ভালোবাসার এই কাঙ্গালপনা শিখেছি আমার বড় আপুর কাছে ।
আজ তা'হলে বড় আপুর গল্প শোনাই । আমার বড় আপুর নাম রুবাইয়া কবির রাফনিদ । আমার চাইতে গুনে গুনে দশ বছরের বড় । গ্রাজুয়েশন শেষ করে বাসায় বসে আছে , জব টব করার কোনো আগ্রহ তার মধ্যে দেখা যায় না;আর না সে বিয়েতে ইন্টারেস্টেড । বাপি-মায়ের একটাই চিন্তা, ওর ফিউচার নিয়ে। যদিওবা আমাদের টাকা পয়সার কোনো কমতি নেই। বাপির যা সম্পত্তি আছে তা দিয়ে আমরা দু বোন আরাম করে এক জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো । কিন্তু মেয়ে বড় হলে চিন্তাটা শুধু টাকা পয়সাতে সীমাবদ্ধ থাকে না। হাজারটা চিন্তার মধ্যে সবচাইতে বড় হলো বিয়েশাদী করিয়ে সংসার সাজিয়ে দেয়া । আমার আপু সংসার বিমুখ , তার স্বপ্ন সে একজন ট্রাভেলার হবে । খুব কম বয়স থেকে ও ট্রাভেলিং শুরু করেছে । বাংলাদেশের পঞ্চাশ টা জেলা তার দেখা শেষ বাকি চৌদ্দটা জেলা দেখা হয়ে গেলে বিদেশে পাড়ি দেয়ার চিন্তাভাবনা ।
এখানে প্রশ্ন হলো এত টাকা ও কোথায় পায়? আপু যে জব করেনা কথাটা পুরোটা সত্য নয় । জব অবশ্যই করে, কিন্তু আর পাঁচটা গ্রাজুয়েটের মত কর্পোরেট লাইনে নয় । সে আউটসোর্সিং করে অর্থ উপার্জন করে । ইচ্ছা স্বাধীন কাজ তার। কখনো সারারাত জাগতে হয় কখনোবা সারাদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে থাকে । আপুর অদ্ভুত জীবনাচরণ আরো কারো পছন্দ হোক না হোক আমার ভীষণ ভালো লাগে ।
এর পেছনে দু'টো কারণ বলা যেতে পারে
প্রথমটা সে আমার আইডল। আমার মনে হয় এই পৃথিবীতে নিঃস্বার্থ ভাবে ও যদি কাউকে ভালোবেসে থাকে, সেটা শুধুই আমি।
আমি আমার বাপি-মায়ের নিজের মেয়ে নই । একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে আপু আমাকে ময়লার স্তুপে পড়ে থাকতে দেখে কিছু না ভেবেই বাসায় নিয়ে আসে । ও বাসায় ঢোকার ঠিক পাঁচ মিনিট পর সারা দেশে এক যোগে ভারী বর্ষণ শুরু হয় । হয়তোবা সেদিন বৃষ্টিতে ভিজেই আমার ছোট্ট প্রাণটা পৃথিবী থেকে বিদায় নিতো । কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমত সঠিক সময়ে আপুকে পাঠালেন।
ফেরেশতা হয়ে আপু না আসলে সুপ্ত নামক অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে থাকতো না । আমি জানিনা ও কেন আমাকে এত ভালোবাসে। তবে আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় আমার মনে ওর জন্য জায়গা কতটুকু? তবে আমি চোখ বন্ধ করে বলবো ওকে আমার মায়ের স্থান দিয়েছি । আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি গর্ভধারিণী'র চাইতে প্রাণ রক্ষাকারীনির মর্যাদা অনেক বেশি ।
এবং দ্বিতীয় কারণ.. দ্বিতীয় কারণটা আজ গোপন থাক । সেটা আরেকদিন বলা যাবে।
-- এ্যাই সুপ্ত কি লিখছিস বল তো তখন থেকে?
আভার কণ্ঠ পেয়ে ঝট করে ডায়েরিটা বন্ধ করে ফেললাম । আমার জীবনের ভয়ংকর রকমের সত্যিগুলো এই ডায়েরির পাতায় লিপিবদ্ধ , আমি চাই না কেউ কখনো এসব সত্যের মুখোমুখি হোক ।
-- সুপ্ত বারবার কই হারাচ্ছিস বল তো?
-- নাহ্ কোথাও না । বল কি বলবি?
-- মা খেতে ডাকছে। প্রাইভেটেও তো যেতে হবে ।
-- আরেহ্ ভুলে গিয়েছি তুই যা আমি একদম রেডি হয়ে নিচে নামছি ।
-- পাক্কা?
-- হুমম
-- ওকে আয় তা'হলে ।
আভা চলে যাওয়া মাত্র চট করে ডায়েরিটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলাম । এখন ফ্রেশ হওয়া দরকার , প্রাইভেটের আগে বাসায় ঢুকবো একবার । হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে তো আর প্রাইভেটে যাওয়া যায়না ।
চোখেমুখে পানি দেয়ার সময় মনে পড়লো পুরো একটা রাত বাইরে কাটিয়েছি আর বাপি একটা কল অবধি করেনি ,ভেরি ব্যাড । অভিমান জমে গেল মনে , বাসায় গিয়ে একটা কথাও বলবো না হুহ্ ।
আয়নার সামনে কিছুক্ষণ মুখ বাঁকা বাঁকি করে তারপর বেরুলাম ।
___
আভাদের ডাইনিং স্পেসটা বিশাল, সেই সাথে ডাইনিং টেবিলও । রাউন্ড করে ষোলো টা চেয়ার সাজিয়ে রাখা । এদের বাড়িতে লোকসংখ্যা কম , এতবড় ডাইনিং টেবিল দিয়ে করে টা কি? যাক গে যা করার করুক আমার তা'তে কি!
উল্টোপাল্টা চিন্তা ছেড়ে টেবিলটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম । আপাতত আভা আর নিদ্র সাহেব বসে খাচ্ছে।
বাকিরা কই? ওহ্ বেলা এগারোটা বাজে , আঙ্কেল নিশ্চয়ই কাজে গিয়েছে । আমার মত নবাবী জীবন-যাপন কে ই বা করবে! একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আভার পাশের চেয়ারটা টেনে বসলাম । চোরা চোখে নিদ্র সাহেবকে একবার দেখে নিতে ভুললাম না, এই অদ্ভুত লোকটার সাথে বসে খেতে হবে ভাবতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল । নাহ্ মেজাজ খারাপ করা যাবেনা , খাওয়ার সময় কোনো উল্টোপাল্টা বিষয় নিয়ে মন মেজাজ খারাপ করতে নেই নইলে ক্ষুধা চলে যায় । আমি কোনোভাবেই চাইনা আমার খাবারের রুচি চলে যাক। তাই বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলাম ।
আমায় দেখে আন্টি খাবারের ডিশগুলো নিয়ে একপ্রকার ছুটে আসলো । প্লেট সামনে দেয়ার এক সেকেন্ডের মাথায় খাবারে ভরপুর৷ খাবারের আইটেম দেখে আমার হেঁচকি উঠে গেলো । আভা চোখ সরু করে বলল_
-- কি রে খাবার না খেতেই হেঁচকি দেওয়া শুরু ।
-- আন্টি যত খাবার দিয়েছে এগুলো এক মাসেও তো শেষ করা পসিবল নয় আমার দ্বারা ।
অসহায় ভাবে হেসে বললাম আমি । আন্টি কথা কেড়ে নিয়ে বলল_
-- ওমা কতগুলো খাবার দিলাম হ্যাঁ? মাত্র এই কয়টা খাবার দেখেই নাক সিটকোচ্ছিস । খাস না জন্য তো এমন ঢেঁড়স মার্কা চেহারা হয়েছে তোর । দাঁড়া তো তোর আম্মুর সাথে দেখা হোক , মেয়ের খাবারের প্রতি এত অনীহা তৈরি হলো কেন জিজ্ঞেস করতে হবে ।
আন্টির কথায় আমি ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলাম । বরাবরই আমার প্রতি আন্টির সোহাগ একটু বেশি, কিন্তু আজ অতিরিক্ত হয়ে গেল । ওনার কথা মোটেও সত্য নয়। আমি একজন পাক্কা ফুড লাভার এবং খাবারের প্রতি আমার এতই ভালোবাসা যে সারাদিন এটাওটা চলতেই থাকে । ইনফ্যাক্ট আমার পড়ার টেবিলের ওপর একটা কন্টেইনার সবসময় রাখা থাকে, যেখানে বিস্কিট চানাচুর কিংবা চকলেট ভরা । খেতে খেতেই আমার ওজন ষাটের ঘর পেরিয়েছে । এতটা ওজন হওয়া সত্বেও আন্টির সোহাগ আমাকে ঢেঁড়স বানিয়ে দিয়েছে । ইন্টারেস্টিং ।
চিন্তার সুতো কাটলো কারো চাপা হাসির শব্দে । চোখ তুলে দেখলাম আমার অপজিটে নিদ্র সাহেব মুখে রুটি পুরতে পুরতে ঠোঁট চেপে হাসছে । তার হাসির কারণ যে আন্টির মিছেমিছি কমপ্লিমেন্ট সেটা বুঝতে আমার এক সেকেন্ড সময় লাগলো না ।
দারুণ অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম আমি । প্লেটে হাত দিতেই ইচ্ছে করছে না এবার ।
আমার অস্বস্তি আরো বাড়িয়ে দিতে সে বিড়বিড় করে মজার ছলে বললো_"আহ্ ঢেঁড়সের কি রূপ!"
অস্বস্তি বদলে গেলো রাগে । এই লোকটার সাথে কি আমার জন্মের শত্রুতা? দেখা হয়েছে থেকে পিছে লেগেছে কেন! ওহ্ সে ভাবে আমি তার কেকের টাকা রিটার্ন করবো না ।
নিজের মত চিপ ভাবে নাকি সবাইকে! বাসায় গিয়ে নেই , জাস্ট পৌঁছেই দিয়ে দিবো হুহ্ ।
-- কি রে নিদ্র রুটি নে? প্লেট তো খালি ।
-- নাহ্ বড়ম্মু আমার পেট ভরে গিয়েছে ।
-- সে কি তুই তো কিছু খেলিই না ।
-- আরে খেয়েছি । বেশি খেলে আবার গেস্টের খাবার কম পড়ে যাবে ।
YOU ARE READING
এক মুঠো গোলাপ
Mystery / Thrillerশুচিস্মিতা কবির সুপ্ত। সর্বদা নিজ জীবন চক্রকে জটিল ভেবে এসেছে। এক সময় তার জীবন সম্পর্কে জটিল ধারণাগুলোকে ভুল প্রমাণ করে জীবনের মানে শেখাতে এসেছিল একজন। জীবন নামক বর্ণহীন আকাশে হুট করে শত রঙের প্রজাপতি ডানা মেলে উড়তে শুরু করেছিল। সকল জড়তা কাটিয়ে বর্ণ...