এক মুঠো গোলাপ
৯
____
নিদ্র শিক্ষক হিসেবে ভীষণ স্ট্রিক্ট এবং রুড।
স্বপ্নে দেখা বাঁশের সেই এক হাত লম্বা কঞ্চিটা নিয়ে পড়তে বসায়। এক ভুল দু'বার করলে সপাং করে মার পড়ে হাতের ওপর। অবশ্যি আমি এখনও পড়ায় ফাঁকি দিয়ে মার খাইনি, বেচারি আভা অনেক খেয়েছে সেই প্রথমদিন থেকে।
মারের ভয়ে ও পড়ার টেবিলে বসতেই চায়না। জোর করে ধরে বেঁধে নিয়ে বসাতে হয়। নিদ্র বই খুলতে বললেই ওর কান্নাকাটি শুরু হয়ে যায়। পুরো সময়টা আমি দর্শকের ভূমিকায়। নিদ্র আভাকে ধমকায়, আমাকে ধমকায়। আভা কাঁদে আর আমি বিমুগ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। মানুষটা রাগলে তার পুতুলের মত চোখজোড়ার পিঙ্গলাভ মণির রঙ পরিবর্তন হয়ে যায়। দেখতে দারুণ লাগে।
আমি এমন হা করে তাকিয়ে থাকলে সে আলতো করে কঞ্চির বাড়ি দেয় হাতের ওপর। আমার কাছে কঞ্চির বাড়িও ফুলের টোকা মনে হয়। আমি লজ্জা পেয়ে খাতায় মুখ গুঁজি।
ঘসঘস কলম চালিয়ে সুন্দরভাবে মনের কথা লিখি। প্রাইভেট শেষে আরক্ত মুখে খাতাটা তার হাতে ধরিয়ে বেরিয়ে যাই। সে ঐ মুহুর্তে তো কিছু বলেনা কিন্তু পরদিন এর শাস্তিস্বরূপ একগাদা অংক করতে দেয়। অংক কমপ্লিট না হলে বাসায় বলে দিবে এমন ভয় দেখায়। আমি ভয় পাইনা কিন্তু অভিনয় করি ভীষণ ভয় পাচ্ছি।
ভয় পেয়ে সব অংক করে নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু ব্যাপারটা এরকম না। আমার কিশোরী মন এমন অবস্থায় যে, সে আমার বড় আকাঙ্ক্ষার মানুষ। ভালোবাসা নামক বিশাল সাম্রাজ্যের একমাত্র অধিপতি। আমি তার সব কথা শুনতে বাধ্য। ভালো খারাপ যা-ই হোক না কেন আমি শুনবো এবং অবশ্যই শুনবো।
এভাবেই দিনগুলো যাচ্ছিল আমাদের৷
আমার প্রপোজাল পেয়ে সে হ্যাঁ না কিছুই বলতো না, একদম নিস্তব্ধ থাকতো। মাঝেমধ্যে আমি অস্থির বোধ করতাম। কিছু তো একটা বলুক?
সে কি না বলবে? উঁহু চান্সই নেই। আমার মত সুন্দরী, ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে আর পাবে নাকি একটাও!সে হয়তো এইচএসসি পরীক্ষা কমপ্লিট হওয়ার জন্য ওয়েট করছে। পরীক্ষা শেষ হলেই আমাকে এক্সেপ্ট করে নিবে। এরকম কনফিডেন্স নিয়ে আমি চলাফেরা করি।
,
বিকেল বেলা প্রাইভেটে গিয়ে দেখি আভার ভীষণ জ্বর। এক মুঠো ঔষধ খেয়ে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে সে। আন্টি আমায় ওর পাশে একটু বসতে বলে ফ্রেশ হতে চলে গেলেন। চোখ মুখের অবস্থা দেখেই বুঝতে পারছিলাম আভার চিন্তায় নাওয়া খাওয়া কিছুই হয়নি বেচারির ।
ঘরটাও ঠিকঠাক গোছানো নেই। ব্যাগটা এক সাইডে রেখে টুক টুক করে ঘরটা গুছিয়ে দিলাম। মনটা তো নিদ্র নিদ্র করছে কিন্তু কোন বাহানায় যাবো তার কাছে?
এই সময় বাসায় আমি আন্টি আর আভা ছাড়া কেউ নেই কিন্তু ওপর তলায় তো ঠিকই নিদ্রর বাবা-মা আছেন?
নিদ্রর বাবা গম্ভীর মানুষ । দেখলেই ভয় লাগে। এ যাবৎ আমার সাথে দেখা হয়েছে সম্ভবত তিন চারবার। সালাম দেয়া ছাড়া বাড়তি কোনো কথা হয়নি ওনার সাথে। সালামটাই যে কঠিন গলায় নেন অন্য কথা বলার সুযোগ কই!
-- কখন এসেছিস সুপ্ত?
আভার কথায় আমার চিন্তার রেশ কাটে।
বিছানায় ওর পাশে বসে বলি_
-- আধ ঘন্টা হবে। তুই এত জলদি উঠে গেলি!
-- ঘুমটা ভেঙে গেলো হুট করে।
-- জ্বর বাঁধালি কীভাবে?
-- কাল রাতে শাওয়ার নিয়েছিলাম। আবার বাবা ঢাকা থেকে ফেরার সময় আইসক্রিম নিয়ে এসেছিল । একা বসে সাবাড় করে দিয়েছি।
আজ ফলাফল তোর সামনে।
-- মানে বডির ওপর কোনো অত্যাচারটা বাকি রাখিস নি!
আভা মাথা দুলিয়ে হাসলো।
-- আঙ্কেল আবার ঢাকায় গেলেন কবে?
-- পরশু রাতের গাড়িতে।
-- অফিশিয়াল কাজে?
-- উঁহু তোর সতীন আনতে।
-- মানেহ্?
-- মানে...
আধশোয়া হয়ে বসলো আভা। সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো_
-- তোকে তো বলাই হয়নি। তোর সংসারটা মনে হয় তৈরি হওয়ার আগেই ভেঙে যাবে রে।
আমি বিরক্ত হলাম। ওর চোখ মুখের এক্সপ্রেশন পছন্দ হচ্ছে না আমার। বিরক্তমাখা কণ্ঠে বললাম_
-- ঝেড়ে কাশ তো।
-- কথা হচ্ছে নিদ্র ভাইয়ার বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। পাত্রী হলো ওর মামাতো বোন নুহা। তোকে তো বলেছিলাম চাচ্চুর সাথে ডিভোর্সের পর চাচি তার ভাইয়ের বাসায় উঠে যান৷ নিদ্র ভাইয়া আর নুহা আপু সমবয়সী। অনেক ছোটো থেকেই নুহা আপু ভাইয়াকে ভালোবাসেন কিন্তু কখনো বলতে পারেননি। যখন ভাবলো বলবে তখন নিদ্র ভাইয়া তার বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে রিলেশনে জড়িয়ে পড়ে। ভাইয়ার সুখের কথা চিন্তা করে বেচারি আর এগোয়নি। কিন্তু এই কয়েকমাস আগে সামহাউ ভাইয়ার রিলেশন টা ভেঙে যায়। ভেতর থেকে ভাইয়াও খুব ভেঙে পড়ে। ভাইয়াকে এমন কষ্টে দেখে নুহা আপু চিন্তা করে তার দায়িত্ব নিবে।
এজন্যই প্রস্তাব পাঠায়। ভাইয়া অবশ্য শুরুতেই না করে দিয়েছিল। শুনেছি চাচি নাকি খুব রাগারাগি করেছে ভাইয়ার সাথে। ভাইয়া না বলেই আমাদের বাসায় চলে এসেছিলো।
কিন্তু মা কে ছাড়া কতদিন থাকবে? ভাইয়া কিন্তু চাচিকে ভীষণ ভালোবাসে।
চাচিও তার ছেলেকে চোখের আড়াল হতে দেন না৷
মান অভিমান শেষ হলে ভাইয়া আবারও ব্যাক করে ঢাকায়। দ্বিতীয়বার রংপুরে আসার কথা ছিলো না। আমি জোর করায় এসেছে।
-- সৃষ্টিকর্তাই তাকে নিয়ে এসেছে আমার জন্য।
শোন ঐসব বিয়েশাদি ক্যান্সেল। আমাকে ছাড়া অন্য কারো চিন্তা মাথায় আনলেও ওকে খুন করবো আমি।
-- প্রেমের চক্করে এবার খুনি হয়ে যাবি?
-- হ্যাঁ দরকার হলে তাই হবো।
-- তবে বিয়ের কথাবার্তা কিন্তু শক্তপোক্ত ভাবেই উঠেছে বুঝলি?
-- আমি বুঝে কি করবো? তুই বোঝ যাতে ভাঙতে সুবিধা হয়। তুই যদি কিছু করতে না পারিস, আমি যদি ওকে না পাই তাহলে কিন্তু গলায় দড়ি দিবো বললাম। কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম আমি।
-- পাগল হয়ে গেলি নাকি তুই? কান্নাকাটি করিস না। দেখি কি করা যায়!
-- দেখি না কর..
-- সুপ্ত?
আমার কথার মাঝেই আন্টির ডাক পড়লো।
আমি "জ্বী" বলে উঠে দাঁড়ালে আন্টি বললেন_
-- তোর নিদ্র ভাইয়া এক্ষুণি তোকে ডাকছে। কি যেন ইম্পর্ট্যান্ট নোট দিবে।
-- কোথায় আছেন উনি?
-- আশিকের ঘরে আছে।
-- উনি এখানেই আছেন?
-- হ্যাঁ। এখানেই তো থাকে। যা তো শুনে আয় ওর কথা।
-- আচ্ছা যাচ্ছি ।
আভার দিকে একবার তাকিয়ে বেরিয়ে গেলাম। ও চোখের ইশারায় বললো আমি যাতে মনের কথাটা জানিয়ে দিই নিদ্রকে। এদিকে ও তো জানেনা সেই কাজ আমি অনেক আগেই করে ফেলেছি চিরকুটের মাধ্যমে।
____
মেঝেতে বইখাতা ছড়িয়ে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বসে আছে নিদ্র।
এত এত বই দেখে মনে হচ্ছে সাক্ষাৎ বিদ্যাসাগর। কিন্তু বিদ্যাসাগরের মনযোগ ল্যাপটপে!
ভ্রু কুঁচকে আমি দরজায় নক করলাম। মনিটরে চোখ রেখেই সে হাতের ইশারায় ভেতরে ডাকলো।
আমি গিয়ে একটা সোফায় বসলাম।
-- ডেকেছিলেন স্যার?
আমার সম্বোধনে সে মাথা তুলে তাকালো। চোখ বড় বড় করে হা করে তাকিয়ে থাকলো মুখের দিকে।
এমন এক্সপ্রেশনের অবশ্য কারণ আছে।
পড়া শুরু হয়েছে থেকে এ অবধি আমি ওনাকে কোনো সম্বোধনেই ডাকিনি। প্রয়োজনে "শুনুন না" বলে ডেকেছি হয়তো।
আজ হুট করে স্যার বলায় স্বভাবতই ঝটকা খেয়েছে ।
তবে বেশিক্ষণ মুখভঙ্গি একরকম থাকলো না। ।
দ্রুতই স্বাভাবিক হয়ে খু খু করে একটু কাশলো।
বললো_
-- সুপ্ত আই নিড ইওর হেল্প।
-- আমি কোনো হেল্প করতে পারবো না।
সাথেসাথেই জবাব দিলাম আমি।
পুনরায় ওনার ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো।
-- কেন পারবা না?
-- আমি আপনাকে হেল্প করবো কেন?
-- এতে কিন্তু তোমারও লাভ আছে।
-- আপনাকে হেল্প করার মধ্যে আমার লাভ থাকতে যাবে কেন!
-- আগে শুনে তো নাও।
-- শুনে,না শুনে কোনো পরিস্থিতিতেই হেল্প করবো না৷
-- ভেবেচিন্তে বলছো তো?
-- ইয়েস অফকোর্স। আমি আপনাকে হেল্প ক র তে পা র বোও নাআআ...
-- ওকে তাহলে যাও।
যাও শুনেও আমি বসে রইলাম। হুট করে আমার মনে হচ্ছে যদি বিয়েটা ক্যান্সেলের ব্যাপারে হেল্প চায়?
উশখুশ করে বললাম_
-- আচ্ছা কি হেল্প?
-- তুমি না বললে হেল্প করতে চাও না?
-- মন চেঞ্জ করেছি। করবো হেল্প।
সে একটু হাসলো।
-- এখানে আসো তিনটা ফর্ম আছে ফিলাপ করে দাও।
খাতায় সব ডিটেইলস লেখা আছে ফর্মে হুবহু তুলে দিবা।
আমি মাথা নেড়ে ওনার পাশে গিয়ে বসলাম।
ওনার সহ আরো দু'টো ছেলের ইনফরমেশন লেখা। এগুলো দিয়ে কি করবে ব্যাটা!
প্রশ্ন করতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলাম।
একটা ফর্ম লেখার পর কলম নাচাতে নাচাতে প্রশ্ন করলাম_
-- আপনার নাকি বিয়ে?
-- আমিও শুনলাম।
-- কি শুনলেন?
-- আমার নাকি বিয়ে।
-- মানে আপনার বিয়ে আপনি জানেন না!
-- এতদিন জানতাম না। কাল রাতে জানতে পেরেছি।
-- আপনি বিয়েতে রাজি?
-- ফ্যামিলি রাজি , পাত্রী ভালো। আমার রাজি না হওয়ার তো কোনো কারণ নেই।
--ফ্যামিলি বললো আর আপনি ড্যাং ড্যাং করে রাজি হয়ে যাবেন! আপনার নিজস্ব কোনো মতামত নেই? আপনি কি মাম্মাবয়!
-- মাম্মাবয় হতে যাবো কেন! বড়রা আমার লাইফ সেটেল করে দেয়ার কথা ভাবছেন। তাদের মতামতকে আমি প্রাধান্য দিবো না?
-- অদ্ভুত আপনি বড় হয়েছেন। আপনার লাইফের ডিসিশন এখনো ফ্যামিলি নিবে কেন?
-- ফ্যামিলি তো আমার ওপর চাপিয়ে দেয়নি। আমার মতামত জানতে চেয়েছে।
-- আপনি কি রিপ্লাই দিয়েছেন?
-- এখনো কিছু বলিনি।
-- কি বলবেন?
-- তুমি কি ধারণা করছো?
-- আমি ধারণা করছি না। বলছি আপনি সোজা না করে দিবেন।
-- কেন?
-- কেন মানে! আপনি জানেন না কেন?
-- কি জানবো?
জবাবে আগুনঝরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম তার দিকে।
আমার তরফ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে সে ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে চাইলো। এমন ভয়ংকর দৃষ্টি দেখে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো_
-- কি?
-- আমি করবো না আপনার হেল্প। যান বিয়েশাদি করে বউয়ের থেকে হেল্প নেন।
খাতা কলম আছড়ে ফেলে আমি উঠে পড়লাম। ভীষণ কান্না পাচ্ছে আমার।
ধপধপ পা ফেলে বেরোনোর পায়তারা করছি। দরজার মুখে আসতেই পিছু ডাক_
-- সুপ্ত?
আমি ঘুরে তাকালাম না কিন্তু ঠিকই দাঁড়ালাম।
উনি চাপা হাসির সাথে বললেন_
-- আমার কিন্তু এখন বিয়ে-শাদির প্ল্যান নেই।
-- নেই কেন? বয়স হয়েছে না আপনার। বিয়ে করবেন না কেন! অবশ্যই করবেন। এখন বিয়ে না করলে আজীবন বিয়ে হবে না।
মাথা ঘুরিয়ে এতটুকু কথা বলে বেরিয়ে আসলাম।
অসভ্য ছেলেটা বিনিময়ে একটা গা জ্বালানো চাপা হাসি দিয়ে উঠলো।
আরো একবার বোধহয় আমার সম্পর্ক হতে হতে ভেঙে গেলো!
চলবে?
sinin tasnim sara
أنت تقرأ
এক মুঠো গোলাপ
غموض / إثارةশুচিস্মিতা কবির সুপ্ত। সর্বদা নিজ জীবন চক্রকে জটিল ভেবে এসেছে। এক সময় তার জীবন সম্পর্কে জটিল ধারণাগুলোকে ভুল প্রমাণ করে জীবনের মানে শেখাতে এসেছিল একজন। জীবন নামক বর্ণহীন আকাশে হুট করে শত রঙের প্রজাপতি ডানা মেলে উড়তে শুরু করেছিল। সকল জড়তা কাটিয়ে বর্ণ...