এক মুঠো গোলাপ
১১
____
শিউলি আপুর হলুদ সন্ধ্যায় আপু তার লাল হলুদ মিশেলের সুন্দর একটা স্বর্ণ কাতান পরিয়ে আমায় সাজিয়ে দিলো।
চকচকে শাড়ি গয়না পরিহিতা আমাকে দেখে সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ । নানী তো একবার এককোণে ডেকে প্রশ্নই করে ফেললো_
-- হ্যাঁ রে ছোডো রানী শিউলির বিয়ার পানি তোর গাওতও ছুঁইলো নাকি? এক বিয়ার আসরে তুইও কবুল বলিয়া উঠবি!
নানীর প্রশ্ন শুনে আমি লজ্জা মিশ্রিত গলায় বললাম_
--" রাজা যদি একবার হয়ে যায় রাজি,
শীঘ্রই ডেকে ফেলবো কাজী"
আমার কথা শুনে নানী হেসে কুটকুট। তার ধারণা আমি সবসময় মজা করে কথা বলি। কিন্তু তাকে বোঝাবো কি করে? সুপ্ত এখন মজা করা ছেড়ে দিয়েছে।
নানীর সাথে হাসি মজা শেষে উঠে দেখি আমাদের থেকে দু তিন কদম পরেই শান্ত ভাইয়াদের সাথে নিদ্র বসে গল্পে মশগুল।
শান্ত ভাইয়া বড় মামার ছেলে, ঢাকায় পড়াশোনা করে। বিয়ে উপলক্ষে এক ঝাঁক বন্ধু নিয়ে তার আগমন ঘটেছে।
ঢাকার ছেলেরা সুদর্শন বৈ কি!
তবে সবার চাইতে হাজার গুনে সুন্দর লাগছে আমার নিদ্রকে। ছেলেরা এমন ভাবে তাকে ঘিরে বসেছে যেন আলোচনার মধ্যমনি সে ই।
নিদ্রকে এক ধ্যানে দেখতে দেখতে কখন যে ওদের কাছাকাছি চলে গিয়েছি খেয়ালই করিনি।
ধ্যান ভাঙে শান্ত ভাইয়ার গলার আওয়াজে । সে ভ্রু নাচিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলছে,
"সুপ্ত রানী বিয়েটা কি তোর? বউ সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। ঘটনা তো সুবিধার মনে হচ্ছে না?"
শান্ত ভাইয়ার কথায় নিদ্র সহ সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। ভাবছি কি উত্তর দেয়া যায়। অনেক ভেবেচিন্তে মাথা নিচু করে ফিসফিসিয়ে বললাম_
"শুনেছি বিয়ে বাড়িতে বিয়ে হওয়ার চান্স থাকে নাইনটি নাইন পার্সেন্ট।
আর বিয়ে হলো দিল্লির লাড্ডুর মত। যে খাবে সেও পস্তাবে যে খাবেনা সেও পস্তাবে। পস্তানোতেই সুখ বেশী তাই ভাবলাম সাজগোজ করে থাকি। যদি বাপি একটু বোঝেন মেয়ে বড় হয়েছে!"
-- বাপি বুঝলেই হবে রানী? রাজাও তো থাকা চাই!
-- রাজা আছে।
-- মাই গড! রাজাও জুটিয়ে ফেলেছিস? কে সে, থাকে কই? তোর মত আধ পাগল কে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলো?
-- "সুপ্ত রানীর ত্যাড়া রাজা,
রাজি না হলে খাওয়াবো ব্যাঙের ভাজা।"
মুখ বাঁকিয়ে চলে আসলাম আমি। তাকাবো না তাকাবো না করেও চোরা চোখে তাকিয়ে দেখি সবাই ভ্রু কুঁচকে আমায় দেখছে, স্রেফ নিদ্রর মুখে হাসি।
এই রাজা তো ঠিকই রাজি আছে, স্বীকার করতে চাইছে না জাস্ট।
___
হলুদ শেষ হলো আনুমানিক দেড়টায়। সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়েছে সবার।
তাছাড়াও এত বেশীই মানুষ এসেছে যে জায়গার সংকট দেখা দিচ্ছে । খালামণি না পেরে আমাদের সব কাজিনদের ছাদে পাটি বিছিয়ে শোবার জায়গা করে দিলো। ঢাকা থেকে আপুর পাঁচজন ফ্রেন্ড এসেছে তারাও যোগ হলো আমাদের সাথে এবং নিদ্রও।
ওরা সবাই পরিকল্পনা করছে ক্লান্ত শরীরকে চাঙ্গা করতে চা আড্ডা, রাত জেগে নাচ গান এসব হবে।
আমার হুট করে মাইগ্রেনের ব্যথা উঠেছে , ক্রমশ আমার মুখ চোখ রক্তিম হয়ে যাচ্ছে আমি বুঝতে পারছি। ঠিকমত চোখ মেলে তাকাতে পারছি না কিংবা কথা বলতে পারছি না। ইনফ্যাক্ট বসে থাকাটাও আমার পক্ষে কষ্টসাধ্য মনে হচ্ছে ।
আমি তো কিছুতেই এসবে থাকতে পারবো না বরং আমার একটা নিরিবিলি জায়গার প্রয়োজন।
বড় মামার মেয়ে তুবার কাঁধে মাথা রেখে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছি, অজান্তেই আমার মুখ দিয়ে গোঙানির শব্দ বেরুচ্ছে আমি বুঝতে পারছি।
তুবা বারবার জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে! আমি ইশারায় বোঝাচ্ছি কিছুনা আমি ঠিকাছি, কিন্তু আনফরচুনেটলি আমি ঠিক নেই। এই মুহুর্তে আমার নিদ আপুকে বড্ড প্রয়োজন। আপু সম্ভবত নিচে মায়ের সাথে আছে।
সবাই আড্ডায় মশগুল হয়ে গিয়েছে । আমি তুবার পেছনে বসে ওর কাঁধে মাথা এলিয়ে চুপচাপ বসে আছি।
মাঝেমধ্যে চোখ তুলে দেখার চেষ্টা করছি নিদ আপু আসে কি না, এর মধ্যে হুট করে কেউ আমায় কোলে তুলে নিলো।
অস্পষ্ট দৃষ্টিতে পরিচিত মুখ ভেসে উঠলো। নিদ্র?
আমি কিছু বলবার পূর্বে উপস্থিত সকলের প্রশ্নবাণ শুরু হয়ে গেলো।
কদাচিৎ দু একটা কথা আমার কানে ভেসে আসছে, "তুই ওকে কোলে নিলি ক্যান হঠাৎ? ওর কি হয়েছে?"
নিদ্র ধীর কণ্ঠে জবাব দিলো,"শী ইজ নট ফিলিং ওয়েল। আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি । ইউ গাইজ কান্টিনিউ৷ আর হ্যাঁ কাউকে বলার দরকার নেই"
তুবা মনে হয় পাশে থেকে বললো, ওর মাইগ্রেনের ব্যথা উঠেছে। আমি কি আসবো আপনার সাথে?"
নিদ্র প্রতুত্তরে ছোট্টো করে জবাব দিলো, "না"
তারপর দ্রুত বেগে বেরিয়ে গেলো।
গাড়ির কাছে আসা অবধি আমি পুরো অচেতনের মত পড়ে ছিলাম তার বুকে। গাড়িতে বসানোর পর একটু সেন্স আসে৷
বহুকষ্টে জিজ্ঞেস করি,
"কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?"
উত্তরে সে নিশ্চুপ থাকে।
এর পর আর কিছুই মনে নেই আমার।
____
ঘুম ভাঙে পাখির কিচিরমিচির শব্দে। চোখ মেলতেই পরিচিত রুমে আবিষ্কার করি নিজেকে।
দেয়াল ঘড়িতে সকাল আটটা বেজে পঁয়ত্রিশ।
ঘুমের রেশটা কাটতেই নাকে একটা উৎকট গন্ধ ভেসে আসে। আশেপাশে চোখ বুলাতে গিয়ে দৃষ্টি পড়ে বেড থেকে কিছু দূরে বসানো ফুল লেংথ আয়নাটায়। ও মাই গড!আমার মাথায় চুপচুপে তেল।
চুলে হাত বুলিয়ে নাকের কাছে আনতেই ভেতর উল্টে আসার মত অবস্থা। এত বিচ্ছিরি গন্ধযুক্ত তেল কে দিয়ে দিলো আমার মাথায়?
হাজারবার শ্যাম্পু করলেও মনে হয় এই গন্ধ মাথা থেকে যাবেনা।
-- কি রে ছোডো রানী উইঠ্যা গেছিস? ঘুম ভাঙলো কখন?
নানীর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম_
-- এই বাসি পটির গন্ধযুক্ত তেল কে দিয়ে দিলো আমার মাথায়?
-- গন্দযুক্ত কি?
-- পটি মানে হাগু।
-- নাউজুবিল্লাহ। গন্দযুক্ত গু! এই জড়িবুটি তেল রে তুই গুয়ের সাথে তুলনা করলি? এইজন্য কয় মানুষের ভালো করতে নাই।
-- আহ্ নানী আহাজারি না করে বলো তো কে করলো এই কাজ?
-- কে আবার আমি।
-- তুমি?
-- হ। কাইল রাইতত তো তুই মাথার বিশে অজ্ঞান হয়া গেলি। ভালো করুক ছেলেটার কি জানি নাম নিদ-রো। সোনার টুকরা ছেলে তোর হাতির মত গতরটা দুহাতে ভাসিয়ে নিয়ে আসলো এই বাসায়।
কপাল ভালো তোর বড় মামীরও মা-ইগ্রে-নের বিশ ওঠে। তারে আমি এই তেল আনায় দিছিলাম আমার বাপের বাড়ির এলাকা থেকে। কিছু তেল আছিলো বলেই তোরে ডলে দিতে পারছি।
-- খুব ভালো করছো। মহান তোমরা। এখন বলো তো মা কই?
-- তোর মা তো ঐ বাসায় মানে তোর মেজো খালার বাসায়।
-- এখানে আমরা কে কে?
-- তোর মামা মামি, নি-দ-রো আর তুই আমি।
-- উফফ। এখন আমি শ্যাম্পু কোথায় পাবো? মামী কোথায়?
-- রান্দন চাপাইছে। রান্নাঘরে গিয়া দ্যাখ।
নানীর কথা শুনে বিরক্ত হয়ে নামলাম বিছানা থেকে। শখের কাতান ভাজে ভাজে শেষ হয়ে গিয়েছে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়িটা টানাটানি করে ঠিক করছি এই মুহুর্তে নানী ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো_
-- তোর প্যাডে পোয়াতি মেয়েলোকের মত ফাটা দাগ ক্যান?
নানীর কথায় আমি তড়িঘড়ি করে আঁচল ঠিক করে চোখ পাকিয়ে বললাম।
-- মোটা হইছি বলে ত্বকের টিস্যু ফেটে গেছে।
-- বুবুরে বলিস কি! এখনই এই দাগ পড়লে তো মসিবত। জামাই কাছে টানবো না তোরে। আইজই তোর মায়েরে বলতেছি মেয়ে বড় হইছে তার গতরের দিকে খেয়াল নাই মায়ের। দাঁড়া তুই ।
-- উফফ নানী। আমার দাগ আমার জামাই বুঝবে আর আমি বুঝবো। তুমি একদম মা কে কিছু বলবা না বলে দিলাম।
-- একশোবার বলবো হাজারবার বলবো। তাল গাছের মত খালি লম্বায় বাড়তেছিস। মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি কিচ্ছু নাই? নিজেকে ফিটফাট রাখা লাগবে না!
-- না লাগবে না।
নানীকে আর কিছু বলতে না দিয়ে আমি বেরিয়ে আসলাম।
অদ্ভুত কথাবার্তা , অন্যের জন্য এখন আমি ফিটনেসের ভূত মাথায় চাপাবো!
,
চলবে?
sinin tasnim sara
YOU ARE READING
এক মুঠো গোলাপ
Mystery / Thrillerশুচিস্মিতা কবির সুপ্ত। সর্বদা নিজ জীবন চক্রকে জটিল ভেবে এসেছে। এক সময় তার জীবন সম্পর্কে জটিল ধারণাগুলোকে ভুল প্রমাণ করে জীবনের মানে শেখাতে এসেছিল একজন। জীবন নামক বর্ণহীন আকাশে হুট করে শত রঙের প্রজাপতি ডানা মেলে উড়তে শুরু করেছিল। সকল জড়তা কাটিয়ে বর্ণ...