এক মুঠো গোলাপ
১৪
___
আমার ধারানুযায়ী কোনো কাপলই তিন সাড়ে তিন মাসের সম্পর্কে ততটা সহজ স্বাভাবিক নয় যতটা আমরা হয়ে গিয়েছিলাম।
আমাদের সাবলীল কথাবার্তা, আমার নিদ্রর প্রতি কেয়ারনেস, অবসেশন এসব এত জলদি কারোরই মাঝে আসতে পারেনা। আমার কেবলই মনে হতো নিদ্রর জন্য ভালোবাসাটা আমার মনে প্রত্যেকদিন শতগুণ করে বেড়ে যায় । একা বসে থাকতে থাকতেই মনে হয় আমার নিদ্রকে সামনে চাই , এই মুহুর্তে চাই। এক পলক দেখতে না পেলে বুঝি মরেই যাবো।
দিন নেই রাত নেই ওকে দেখতে চাওয়ার তৃষ্ণা পেত।
শত ব্যস্ততার মাঝেও আমার এই আবদার পুরো করতে তাকে আসতে হতো সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে ।
আমি ছুটে গিয়ে তার বুকে জায়গা করে নিতাম, সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতো_"প্লিজ সুপ্ত কন্ট্রোল ইওর সেল্ফ"
প্রতুত্তরে আমি কিছুই বলতাম না। কিছু বলবার প্রয়োজন নেই। নিদ্রর শরীরের ঘ্রাণ শুষে নেয়াটাই সুপ্তর মূল কাজ।
এর বাইরে সুপ্ত কিচ্ছু শোনেনি , কিচ্ছু জানেনা।এইচএসসি পরীক্ষার দু সপ্তাহ আগে একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবে নিদ্র, ঢাকায়।
ও ঢাকায় যাবে শুনেই আমার দম বন্ধ অনুভূতি হতে শুরু করলো।
ইনসিকিউরড ফীল করছিলাম আমি। ঢাকায় তো নুহা আছে। নুহা যদি নিদ্রকে বিয়ে করার জন্য কোনো টিক্স খাটানো শুরু করে? নুহা তো ওর মামাতো বোন। ওর মায়েরও অগ্রাধিকার আছে এখানে। ও যদি ওর মায়ের কথা ফেলতে না পারে তাহলে!
এসব ভাবতে গেলেই আমার মুখ পাংশু বর্ণ ধারণ করতো।
ঘুম উবে গেল একপ্রকার ।
ওর ঢাকায় যাওয়ার আগের রাতে আমি বিরাট একটা কাজ করে ফেললাম।
ইনসিকিউরিটির তাড়নায় মধ্য রাত দুটোর দিকে বেরিয়ে পড়লাম ওর বাসার উদ্দেশ্যে।
পথে যে আমার বিপদ হতে পারে এরকম কোনো খেয়াল আমার নেই। মাথায় স্রেফ ঘুরপাক খাচ্ছিলো যতক্ষণ না আমি বোঝাতে পারবো আমি ওকে কতখানি চাই; আমার মনে ওর জন্য ভালোবাসা কতখানি, ততক্ষণ অবধি আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবো না।
ভাগ্য সহায় ছিল বলে পথে কোনো বিপদাপদ হলো না আমার।
ওদের বাসার নিচে গিয়ে যথারীতি কল করলাম নিদ্র কে। এত রাতে কল পেয়ে সে খানিকটা অবাকই হয়ে গিয়েছিল হয়তো, কারণ রাত্রি বারোটার মধ্যেই স্ট্রিক্টলি ঘুমোতে বলেছিল আমাকে।
আমিও ওর কথা রাখতে ফোন বন্ধ করে শুয়েছিলাম কিন্তু আনফরচুনেটলি ঘুমোতে পারিনি।
যাহোক কল রিসিভ করে ও শক্ত গলায় বললো_
--এখনো ঘুমোওনি সুপ্ত?
-- আমি তোমার বাসার নিচে। একটু আসো না, একা দাঁড়িয়ে থাকতে ভয় করে।
-- হোয়াট!
চেঁচিয়ে উঠলো ফোনের ওপাশ থেকে । ছুটে এলো ব্যালকনিতে। আমি তখন ব্যালকনির দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। ওকে দেখামাত্র হাত নেড়ে ইশারা করলাম। ও ভীষণ রেগে বললো _
-- এই মেয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিস তুই? এত রাতে একা একা আসতে কলিজা কাঁপলো না তোর?
আমি মিনমিন করে বললাম _
-- প্লিইজ নিদ্র পরে বকা দিও। আমাকে ওপরে নিয়ে যাও এখন।
ও পুনরায় ধমক দিয়ে বললো_
-- একা একা এসেছিস। একা একাই ফিরে যাবি। না তোকে বাসায় ঢুকতে দিবো আর না তোর সাথে কথা বলবো আমি।
ফোন কেটে ভেতরে চলে গেলো নিদ্র।
আমি অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু মনে মনে শিওর ছিলাম ও ঠিকই নিতে আসবে আমায়।
দু মিনিট পর আমার ধারণা কে সত্যি করে বাসার মেইন গেইট টা খুলে গেলো।
চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো নিদ্র। আমি ছুটে গিয়ে ওর গলায় ঝুলে পড়লাম।
দু চারটে শুকনো চুমু খেয়ে বললাম_
-- আ'ম রিয়্যালি স্যরি। আমার যে তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল তাই তো এসেছি।
ও ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আমায় দু'হাতে আগলে নিলো।
-- এত পাগলামি কেউ করে সুপ্ত? কত ডেঞ্জারাস একটা স্টেপ নিয়েছো আইডিয়া আছে তোমার!
-- উঁহু । কত ভালোবাসি তোমাকে সেই আইডিয়া আছে। শুনতে চাও?
-- এটাকে ভালোবাসা না। পাগলামি বলে সুপ্ত। তোমার কিছু হয়ে গেলে কি হতো আমার!
-- স্যরি নিদ। আর কক্ষনো এমন হবে না।
ও নিশ্চুপ রইলো।
আমি ওর বুকে পর পর আরো কয়েকটা চুমু খেয়ে আহ্লাদী গলায় বললাম_
-- আই প্রমিস আর পাগলামি করবো না। এবারের মত মাফ করে দাও?
-- চলো তোমায় বাসায় দিয়ে আসি।
-- উঁহু আজ আমি তোমার সাথে থাকবো।
-- এক থাপ্পড় দিয়ে সব কটা দাঁত ফেলে দিবো।
-- বকা দাও মারো যাই করো আমি কোত্থাও যাবো না।
ওকে ছেড়ে রাস্তায় বসে পড়লাম আমি। ও কপাল চাপড়ে নিজে নিজেই বললো_"পাগল রে আমারে শান্তি দিলি না"
এরপর টুপ করে কোলে তুলে নিয়ে বাসার ভেতরে প্রবেশ করলো।
আমি গলা জড়িয়ে মিটিমিটি হাসতে থাকলাম।
,
পরদিন সকালের গাড়িতেই যাবে বলে সব প্রিপারেশন নিয়ে রেখেছে। সাজানো লাগেজ টা দেখে আমার বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছিলো একদম।
ও আমার বিষণ্ণতা দেখে প্রশ্ন করলো_
-- মুখটা অমন পেঁচার মত করে আছো কেন?
-- তুমি কতদিনের জন্য যাচ্ছো নিদ?
-- এক সপ্তাহ তো বটেই।
-- আমি থাকবো কি করে তোমাকে ছাড়া?
-- আমি কি একেবারেই চলে যাচ্ছি? মাত্র সাতদিনের ব্যাপার। আর তাছাড়াও ডেইলি ভিডিও কলে কথা হবে আমাদের ।
-- ভিডিও কলে কি তোমার গায়ের ঘ্রাণ টা পাবো?
আসন্ন কষ্টের কথা চিন্তা করে ফুঁপিয়ে উঠলাম আমি।
ও আমার সামনে মেঝেতে বসে আমার হাতদুটো নিজের দু হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো_
-- তুমি এত ভীতু কেন সুপ্ত? আমি তোমারই আছি আর তোমারই থাকবো। কেউ কখনোই আমাদের লাইফে এন্টার করতে পারবে না। আর এমন ছোটোখাটো বিরহ সব সম্পর্কেই থাকে, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কেও। আমরা সামাজিক জীব সুপ্ত। সমাজের কতগুলো রুলস ফলো করতে হয় আমাদের । খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে হলো খুব পরিশ্রম করতে হয়। স্রেফ ভালোবাসা দিয়েই পেট ভরে না, একটা শেল্টার পাওয়া যায় না।
আজ এতটুকু দূরত্ব মেনে নিতে না পারলে জীবনভর সাথে থাকাটা যে হবেনা । আমার এত প্রচেষ্টা আমাদের ভবিষ্যতের জন্যই তো।
আমি তো বারবার বলি আমি তোমার আছি, তোমারই থাকবো। আমি ছাড়াও তোমার লাইফে অনেক কিছু আছে সুপ্ত। শুধুমাত্র আমাকে নিয়ে পড়ে থাকলে লাইফটা থেমে যাবে তোমার। লাইফ টা নিয়ে কত পরিকল্পনা করেছিলে একসময়, আজ সব ভুলতে বসেছো। দিনে দিনে এত ডেস্পারেট হচ্ছো যে ক্যারিয়ার হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছো। অথচ তোমার পরীক্ষার বিষয়টা মাথায় রেখে পড়াশোনায় মগ্ন হওয়া উচিৎ ।
ভালোবাসাটাকে অর্জন করতে কত স্যাক্রিফাইস করতে হয়।
আজ একটু কন্ট্রোল করো নিজেকে, অবসেশন টা একটু কমিয়ে দাও। লাইফ গোলের দিকে ফোকাস করো, আ'ম অলওয়েজ দেয়ার ফর ইউ। আই প্রমিস।
-- তুমি সত্যি আমার হয়ে থাকবে তো?
-- থাকবো সুপ্ত। জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আমি তোমার হয়েই থাকবো।
নিদ্রর করা ওয়াদা শেষ অবধি আমায় স্বস্তি দিলো। আমি একটু হলেও বুঝতে পারলাম, আশ্বস্ত হলাম সে শুধুই আমার। তাকে পাওয়ার জন্য এত পাগলামির দরকার নেই।
গম্ভীর পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করতে নিদ্র বললো_
-- আমার চাঁদ। অসীম আকাশকে সাক্ষী রেখে- জ্যোৎস্নার আলোয় গা ভাসিয়ে কিছু স্মৃতি জড়ো করা যাক চলো?
আমি কান্নার মাঝেই হেসে দিলাম। ডান হাতটা ওর হাতের পানে বাড়িয়ে দিলে ও একরাশ মুগ্ধতা কণ্ঠে মেখে বললো_
-- প্রেয়সী তুমি কি জানো! তুমি হাসলে তোমার চোখও হাসে। তোমার হাসির ঝংকার আর চঞ্চল চোখজোড়ার প্রেমেই কিন্তু পড়েছিলাম আমি।
-- চোখ আবার হাসে নাকি!
-- হাসে। চোখ সকল অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে।
-- কীভাবে?
-- সেটা আরেকদিন বোঝাবো। আজ চলো ভালোবাসা মেখে আসি।
আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে পুনরায় কোলে তুলে নিলো নিদ্র।
ব্যালকনিতে ডিভানে বসিয়ে ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞেস করলো_
-- গান শুনবে?
আমি ওর ডান বাহুতে মাথা রেখে বললাম_"হু"
আকাশে প্রস্ফুটিত সেই এক ফালি চাঁদের আলোয় গা ভাসাতে ভাসাতে ভরাট কন্ঠে গেয়ে উঠলো_তোমায় ছাড়া মনের কিনারা
পথেই হারায় পাড়া বে-পাড়া।তোমার নামে মেঘের খামে
পাঠাই আমি নরম ইশারা
কেন এভাবে আমার সারাদিন
তোমায় ছুঁয়ে যে যায়।নানা বাহানায়, নানা বাহানায়
নানা বাহানায়, নানা বাহানায়।তোমার চিলেকোঠা রাতে
খোলা জানালাতে কতবার
আমার জেগে থাকা টুকু
আজ হারায় ঘুম তাঁর
পড়ে নিও চোখ সে তোমাকে গায়।নানা বাহানায়, নানা বাহানায়
নানা বাহানায়, নানা বাহানায়।তোমার আনাচে কানাচে
জোনাকি ছোঁয়াচে কি রঙিন
আমার অভিমানী হাওয়া
বুক ভাসায় দেখোনি
পড়ে নিও চোখ সে তোমাকে চাই।নানা বাহানায়, নানা বাহানায়
নানা বাহানায়, নানা বাহানায়।
,
আমি বিভোর হয়ে ওর গান শুনছিলাম। একটা মানুষ চারিদিক দিয়ে এত পারফেক্ট হতে পারে নিদ্রকে না দেখলে বোঝা যেত না।
গান শেষ হলেও গানের রেশটাই যেন কাটছিলো না। আমি চোখ বন্ধ করে পুরো সময়টা রোমন্থন করছিলাম এর মাঝেই ও আমাকে দু'হাতে আগলে নিয়ে প্রশ্ন করলো_
-- ঘুম পাচ্ছে? বাসায় যাবে?
আমি ওর গায়ের ওম নিতে নিতে বললাম_
-- উঁহু । আচ্ছা নিদ আমরা বিয়ে কবে করবো?
-- এইচএস টা দাও আগে। ভার্সিটিতে ওঠো।
-- নাহ্ আমরা পরীক্ষার শেষ দিনই বিয়ে করবো।
-- হ্যাঁ তারপর লেখাপড়া ছেড়ে দিবা, আ্যাডমিশন প্রিপারেশন হবে খারাপ আর কোনো ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাবা না তাই তো!
-- ওভাবে বলছো কেন?
-- তুমি যে নম্বর ওয়ান পড়া চোর সেটা আমি এই কদিনে বুঝে গিয়েছি। শোনো আমার কাছে একটা ভালো প্রপোজাল আছে। তুমি যদি পাবলিকে চান্স পাও তাহলে রেজাল্ট পাবলিশ হওয়ার পরপরই আমি মিষ্টি আর সম্বন্ধ নিয়ে আসবো তোমাদের বাসায়।
-- অত্ত দেরিই?
-- জ্বীইইই। রাজি থাকলে বলো নতুবা তোমার অনার্স কামপ্লিট হওয়ার পর।
-- এই না না আমি রাজি। প্লিজ প্লিজ অত দেরি না।
-- গুড গার্ল। তাহলে আমি কাল ঢাকায় গিয়েই মায়ের সাথে কথা বলছি।
-- সত্যি?
-- সত্যি সত্যি সত্যি। তিন সত্যি।
-- ইয়ে কি মজা!
আমি আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরলাম ওকে।
ও হাসতে হাসতে বললো_
-- তোমার মত বিয়ে পাগল এই পৃথিবীতে বুঝি আর একটাও নেই সুপ্ত।
-- আমি ওয়ান পিস ই আছি এই পৃথিবীতে হুহ্
-- আই আ্যাগ্রি উইথ ইউ।
আমি মৃদু হেসে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। নিদ্রর বুকে ঘুমোতেও শান্তি । জানিনা কোন ভালো কাজের উপহার স্বরূপ এই মানুষটাকে জীবনে পেয়েছি। কিন্তু এটা জানি, তাকে আমার সারাজীবনের জন্য নিজের করে চাই।
চলবে?
sinin tasnim sara
YOU ARE READING
এক মুঠো গোলাপ
Mystery / Thrillerশুচিস্মিতা কবির সুপ্ত। সর্বদা নিজ জীবন চক্রকে জটিল ভেবে এসেছে। এক সময় তার জীবন সম্পর্কে জটিল ধারণাগুলোকে ভুল প্রমাণ করে জীবনের মানে শেখাতে এসেছিল একজন। জীবন নামক বর্ণহীন আকাশে হুট করে শত রঙের প্রজাপতি ডানা মেলে উড়তে শুরু করেছিল। সকল জড়তা কাটিয়ে বর্ণ...