এক মুঠো গোলাপ
৮
___
পুরো আলমারি তন্ন তন্ন করে খুঁজে একটা হলুদ শাড়িও পাইনি৷ তারপরই মনে পড়েছে ওহ্ আচ্ছা আমি তো শাড়ি বেশি একটা পছন্দ করিনা। মা আমায় হাতে গোণা দু একটা শাড়ি কিনে দিয়েছেন তাও আবার জোর করে।
এক মুহুর্তের জন্য মনটা খারাপ হয়ে যায়, ভাবি সে তো স্বপ্নে এসেছিল বাস্তবে নয়। বাস্তবে আমাকে ব্যাঙ বলার সাহস তো পাবেনা। কিন্তু পরক্ষণেই অন্য চিন্তা মাথায় আসে। কলিযুগ থেকেই শাড়ির ওপর মানুষের একটা দূর্বলতা আছে। শাড়ি পরে ফিটফাট হয়ে গেলে যতটা গুরুত্বটা পাওয়া যায় অন্য কাপড়ে ততটা পাওয়া যায় না। সিদ্ধান্ত নিই শাড়িই পরবো এবং প্রতিদিন শাড়ি পরেই যাবো ব্যাস।
কিন্তু শাড়িটা পরবো কার? আপুর আলমারি তো লক করা আর চাবি কোথায় আছে সে সম্পর্কে বিশেষ ধারণা নেই। মা ও বাসায় নেই। বেলা এগারোটার দিকে আর্জেন্ট কল আসায় বাপিসহ মেজো খালামণির বাসায় গিয়েছে, রাতের আগে তো ফিরবে না। তাহলে উপায়?
বসে বসে কতক্ষণ ভাবনা চিন্তা করতে করতে হুট করেই মনে পড়ে নবনীতার বড় বোন নতুন অনলাইন বিজনেস দাঁড় করিয়েছে। সম্ভবত তারই গ্রুপ স্ক্রল করতে করতে সেদিন দেখলাম হাফ সিল্ক শাড়িও স্টকে আছে। দেরি না করে ফটাফট ডাটা অন করে ফেইসবুকে ঢুকে যাই। ভাগ্য আমার সহায় ছিল । সুলভমূল্যে একটা কাঁচা হলুদ রঙের হাফ সিল্ক শাড়ি পেয়ে যাই। যেহেতু আমাদের পাশের পাড়াতেই তাই আপু বলে বিকেলের মধ্যে শাড়ি পৌঁছে যাবে বাসায়।
তার কনফার্মড মেসেজ পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ি আমি।
ফাইনালি নিদ্র সাহেবের হলুদ ব্যাঙ তার ঘাড়ে চাপতে যাচ্ছে ।
আচ্ছা তার যে ঘাড়ে চাপবো, সেটা লাফিয়ে নাকি সুরসুর করে?
নিজের লেইম জোক্সে নিজেরই হাসি পায়না। নিদ্র নামক স্বপ্নে বিভোর হয়ে কখন যে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যাই বুঝতেই পারিনা৷
,
ঘুম ভাঙে ফোনের শব্দে। আননোউন নাম্বার দেখে রিসিভ করতে ইচ্ছে হয়না। ভুল করেই যেন চাপ লেগে রিসিভ হয়ে যায় আর অজান্তেই কন্ঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসে ছোট্টো একটা শব্দ, "হ্যালো"
ওপাশ থেকে নবনীর ফ্যাচফ্যাচে কন্ঠ ভেসে আসে_
-- দোস্ত দরজা খোল আমি তোর বাসার সামনে।
আমি ভ্রু কুঁচকে না বোঝার মত প্রশ্ন করি_
-- আমার বাসার সামনে তুই কি করবি?
-- আরে বাবা তোর শাড়ি নিয়ে এসেছি। ব্যালকনিতে এসে দ্যাখ আমি নিচে দাঁড়িয়ে তোদের ফ্ল্যাটের দিকে তাকিয়ে আছি।
শাড়ির কথা শুনতেই আমার ঘুম উবে যায়। তড়িঘড়ি করে উঠে বাপিদের ব্যালকনিতে গিয়ে দেখি ঠিকই ও নিচে দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করতে বলে ঘর থেকে চাবি নিয়ে পুনরায় ব্যালকনিতে গিয়ে গ্রীল দিয়ে ছুঁড়ে দেই চাবিটা।
ও মুখ ঝামটে বলে_ ছিঃ বান্ধবীকে রিসিভ করতে দোতলা বেয়ে নামতে পারলি না। অলস কোথাকার।
-- তুই খুব কর্মঠ। জলদি তালাটা খুলে উপরে আয়।
ও আসতে আসতে চোখে মুখে পানি দিয়ে দরজা খুলে রাখি।
নবনী আসায় ভালোই হয়েছে। শাড়ি তো একা একা পরতে পারিনা। এবার ও ই হেল্প করবে।
,
আমাদের ব্যাচে সবচাইতে বাঁচাল মেয়েটা হলো নবনী। পুরো শহরের খোঁজ ওর কাছে। ওর এই নিউজ কালেক্ট করার অদ্ভুত ক্ষমতা দেখেই আমরা ওকে "বিবিসি চ্যানেল" উপাধি দিয়েছি। ওর অবশ্যি নামটা বেশ পছন্দ , স্বীকারও করেছে।
,
আধ ঘন্টা বকবক করে আমার মাথা খারাপ করে দিলো নবনী৷ সময় পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে ওকে বসিয়ে শাওয়ার নিতে চলে গেলাম।
ও ঘরে বসে বসেই চিল্লিয়ে টন্ট করতে শুরু করলো আমাকে।
ওর জ্বালায় অস্থির হয়ে কতবার ধমকও দিলাম কিন্তু নাহ্ ওর কথা থামে না।
এই নিদ্রর জন্য কি কিই না সহ্য করতে হচ্ছে আমাকে। উফফফ....
____
আসরের আজানের একটু পর নবনী সহ একসাথেই বেরুলাম। রিকশায় উঠে বাপিকে জানাতে ভুললাম না যে আমি প্রাইভেট পড়তে যাচ্ছি। বাপি মনে হয় ভীষণ ব্যস্ত,বেশি একটা কথাই বলতে পারলেন না।
ভালোই হলো। সওয়াল জবাব যত কম সুবিধা আমার ততই বেশি।
,
আভাদের বাসার গলিতে ঢোকার পর আমার হার্টবিট হুট করেই বেড়ে গেলো। নবনীও মাঝরাস্তায় নেমে গিয়েছে ওর জরুরি কাজ থাকায়।
একা আমি রিকশায় বসে বসে অতি উৎসাহে থর থর কাঁপছি।
রিকশা যখন বাসার সামনে থামলো তখন আমার কাঁপুনি আরো বেড়ে গেল যেন!
কাঁপা হাতে ভাড়া মিটিয়ে আভাকে কল করলাম।
আভা আমায় দেখে বিষম খেলো একটু।
চোখ বড় বড় করে বললো _
-- মাই গড তোকে তো হলুদের প্রোগ্রাম থেকে পালানো হলুদ বউ মনে হচ্ছে ।
ওর কথায় আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।
-- হলুদের প্রোগ্রামে গাঢ় হলুদ শাড়ি পরানো হয়।
-- হ্যাঁ কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তোকে কাঁচা হলুদ পরানো হবে। এই কালারটা স্যুট করে তোকে।
-- আজাইরা কথা বাদ দিয়ে বল তো কেমন লাগছে আমাকে?
-- আরে আসলেই হলুদ বউ লাগছে। খুব সুন্দর , ভেরিইই বিউটিফুললল..
শেষ শব্দ দুটো একটু বেশীই টেনে বললো আভা।
ওর হাতে মৃদু থাপ্পড় দিয়ে বললাম_
-- চল ভেতরে চল?
ও হাসতে হাসতে বললো_
-- সুপ্ত এই বিশ শতকে তুই কি প্রথম স্টুডেন্ট যে বরের থেকে ব্যাঙ উপাধি পাওয়া স্বপ্ন দেখে ড্যাং ড্যাং করে হলুদ শাড়ি পরে আসলি?
-- হ্যাঁ আমিই প্রথম। গিনেজ বুকে হলুদ কালি দিয়ে লিখে দিস হয়েছে!
-- মাই গড সুপ্ত। তোর তো দেখি লাজ লজ্জা সব হলুদ বাজারে বিক্রি হয়ে গিয়েছে। নির্লজ্জের মত স্বীকারও করছিস।
-- হ্যাঁ করছি। তোহ্?
-- আই আ্যাম প্রাউড অফ ইউ।
ঠোঁট চেপে হাসতে শুরু করলো আভা।
কিছুই বললাম না আর বলবো ও না। বুঝেই তো গিয়েছি এই নিদ্রর সাথে থাকতে গেলে আরো কত কিছু সহ্য করতে হবে আমাকে।
আভার সাথে রাগ করে একা একা সিঁড়ি বেয়ে উঠে চলে গেলাম। দরজা টা খোলাই ছিলো এবং চৌকাঠে দাঁড়িয়েই দেখা যাচ্ছিল সোফায় কালো গেঞ্জি-প্যান্ট পরে পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে মোবাইল চাপছে নিদ্র।
প্রথমে এসেই যে ওকে দেখতে পারবো এরকম কিছু কল্পনা করিনি আমি।
এতদিন বাদে চোখের সামনে কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখতে পেয়ে কেমন করে উঠলো ভেতরটা। চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু পানি জমতে শুরু করলো। সন্তপর্ণে টিস্যু চেপে চোখের পানি মুছে নেয়া মাত্র আন্টির ডাক পড়লো।
মাথা তুলে দেখি জলদি জলদি পা ফেলে আমার দিকেই আসছেন আন্টি। আমি স্বাভাবিক হয়ে ওনাকে সালাম দিলাম।
সালামের জবাব দিয়ে উনি আমার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। চোখে মুখে বিস্ময়ভাব ফুটিয়ে বললেন_
-- ও'মা সুপ্ত তোকে শাড়িতে কি দারুণ লাগে রে। একদম হলুদ বউ হলুদ বউ মনে হচ্ছে ।
তা হুট করে শাড়ি পরলি যে? কোথাও যাবি?
-- এইতো তোমাদের বাসায় এলাম।
-- ইশশ খুব ভালো করেছিস। কি মিষ্টি লাগছে তোকে।
গাল টেনে চুমু খেয়ে বসলেন আন্টি। আমি আন্টির সাথে কথা বলার ফাঁকে চোরা চোখে নিদ্রর দিকে তাকাচ্ছি। সে মাথা উঁচু করে একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার ফোনের দিকে তাকালো, দু সেকেন্ড পর আবারও তার দৃষ্টি আমাকেই আকর্ষণ করলো। সে এবার ভ্রু কুঁচকে তাকালো আমার দিকে।
আমিও মুখ ঘোরালে তার চোখে চোখ পড়ে গেলো।
সব কিছু ভুলে আমি বেহায়ার মত তাকিয়ে রইলাম তার চোখের দিকে।
একবার মনে হলো আন্টি আমায় বসতে বললেন। আমি মাথা নেড়ে নিদ্রর অপজিট সোফায় বসে পড়লাম।
বসা মাত্র আমার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিলো নিদ্র।
পুনরায় মোবাইলে মননিবেশ করে ছাড়া ছাড়া গলায় প্রশ্ন করলো_
-- কই যাও সুপ্ত?
-- কই আবার এখানেই এলাম। আপনার সাথে দেখা করতে৷
-- আমার সাথে দেখা করতে?
-- আরে আপনি তো আমাদের আইসিটি টিচার।
ঐ দেখা করতে মানে পড়তে এসেছি।
-- পড়তে এসেছো এই লুকে? তোমাকে তো হলুদের আসর থেকে পলাতক বউ মনে হচ্ছে ।
নিদ্রর মুখেও সেম কথা। উফফ..
আমি গরম চোখে তাকালাম তার দিকে।
সেও পুনরায় ভ্রু কুঁচকে তাকালো। অদ্ভুত এই ছেলের ভ্রু কোঁচকানো রোগ আছে নাকি?
-- দেখুন আপনারা সবাই কিন্তু ভুলভাল কথা বলছেন। হলুদের প্রোগ্রামে বউদের এত সিম্পল সাজ দেয়া হয়না কখনোই ।
-- এটা সিম্পল সাজ?
-- ইয়েস অফকোর্স।
-- আয়নায় নিজেকে দেখেছো একবার?
-- হোয়াট ড্যু ইউ মিন! আপনি কিন্তু আমায় অপমান করছেন।
-- উঁহু সত্যি বলছি বিশ্বাস না হলে ঘরে যাও আয়নায় দেখো। কত ভারী সাজ দিয়ে এসেছো।
-- সাজগোজের আপনি কি বোঝেন হ্যাঁহ? আমি এভাবেই সাজি আর সাজবো। প্রতিদিন এভাবেই শাড়ি পরে সাজুগুজু করে আসবো হুহ্
-- তুমি এত ঝগড়ুটে কেন সুপ্ত৷ আমি কিন্তু তোমায় ভালো কথা বলছি।
-- ভালো খারাপ বুঝি আমি।
মুখ বাঁকিয়ে বললাম।
আমি মোটেই বউদের মত সাজুগুজু করে আসিনি। শুধু পাউডার মেখে টিপ পরে এসেছি আর লিপস্টিক দিয়েছি। তাতেই কি বউয়ের সাজ হয়ে গেলো! এদের কথা শুনে রাগে গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে আমার।
ফুঁসতে ফুঁসতে বিড়বিড় করে নিদ্রকে গালাগাল দিতে দিতে হঠাৎ আমার মনে হলো কোমরের কাছে থেকে শাড়িটা সরে গেছে, ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে আর সেফটি পিনের চাপ বাড়ছে। হাত পেছনে দিয়ে দেখলাম ঠিকই তো। এখন কি হবে?
আভাটা কোথায় গেলো!
আশেপাশে আভাকে খুঁজছি কিন্তু সে নেই।
আমার অস্থিরতা দেখে নিদ্রর দৃষ্টি প্রখর হলো। আমি ওর দিকে না তাকিয়েই মনে মনে বললাম_
"তোমার হলুদ ব্যাঙ বস্ত্র বিহীন দিগম্বরী হতে চলেছে। চোখটা বন্ধ করে নাও নইলে ঝলসে যাবা"
চলবে?
sinin tasnim sara
ESTÁS LEYENDO
এক মুঠো গোলাপ
Misterio / Suspensoশুচিস্মিতা কবির সুপ্ত। সর্বদা নিজ জীবন চক্রকে জটিল ভেবে এসেছে। এক সময় তার জীবন সম্পর্কে জটিল ধারণাগুলোকে ভুল প্রমাণ করে জীবনের মানে শেখাতে এসেছিল একজন। জীবন নামক বর্ণহীন আকাশে হুট করে শত রঙের প্রজাপতি ডানা মেলে উড়তে শুরু করেছিল। সকল জড়তা কাটিয়ে বর্ণ...