এক মুঠো গোলাপ
২০
____
আমাদের শহরে হিউম্যানিটিজের জন্য কোচিংয়ের সংখ্যা বেশ কম, হাতে গোনা দু তিনটে।
আমি যেখানটায় পড়ছি সেটা বাসা থেকে বেশ দূরে। খুব সকালে বেরিয়ে পড়তে হয়, চার ঘণ্টা ক্লাস। ফিরতে ফিরতে দুপুর।
এতটা সময় বাইরে থাকার কারণে খাওয়া দাওয়ায় বেশ অনিয়ম হয়ে গিয়েছে। এই নিয়ে প্রতিদিন মায়ের বকুনি। ফজরের নামাজের পর পর-ই উঠে সে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দেয় কিন্তু এত সকালে খাওয়ার অভ্যেস নেই আমার।
কোচিং-এ আবার ব্রেইক নেই, মা টিফিনও সাজিয়ে দিতে পারেনা। কি যে আক্ষেপ তার!
আমি মাঝেমধ্যে অবাক হয়ে যাই, দু'দিন বাদে ভার্সিটিতে উঠবো আর সে আমায় টিফিন সাজিয়ে দেবার কথা ভাবছে!
এখনই এত টেনশান তাহলে আমি ঢাকায় যাওয়ার পর তার কি অবস্থা হবে?
,
আজ কোচিং পৌঁছুতে বেশ লেইট হয়ে যাবে। ঘুম থেকে উঠতেই পারিনি সকালবেলা । সবই হয়েছে নিদ্রর জন্য । ফের কাল রাতে এসেছিল বাসায়, এবার ব্যালকনি টপকে।
সারারাত আমায় জেগে জেগে পাহারা দিতে হয়েছে। মহারাজ তো শান্তিমত ঘুমুচ্ছিলেন। তার কোনো টেনশান নেই।
আমার থেকে থেকে সন্দেহ হয়, সামহাউ এই ছেলের মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি!
এ তো একদম মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত পাল্টে গিয়েছে।
-- মিস.ক্লোজাপ হাসি, কোচিংয়ে যায়?
নিদ্রর মেসেজ পেয়ে ঘোর কাটলো, ওর সাথেই তো চ্যাটিং করছিলাম মনে হয়।
মুচকি হেসে রিপ্লাই দিলাম_
-- ইয়েস। আপনার কি খবর কি করা হচ্ছে?
-- আমি ঘুম বিলাস করি।
-- এখনো ঘুম?
-- ইয়েস। তোমার বেডটা ভালো না সুপ্ত, একদমই ঘুম হয়না।
-- উমমহ কি মিথ্যেবাদী। আমার সাধের কোলবালিশ জড়িয়ে ভুশ ভুশ করে ঘুমালে আর এখন বলছো বেড ভালো না?
-- আমি ঘুমের অভিনয় করেছি, ঘুমাইনি।
-- তাই নাকি? তো আমি এতবার চিমটি কাটলাম, গালে হাত বুলিয়ে দিলাম, মাথার চুল টেনে দিলাম; কই উঠলে তুমি?
-- হেই ওয়েট। তারমানে আমি ঘুমোলে তুমি এভাবে টর্চার করো আমায়? হুমমমম
এই-রে ধরা খেয়ে গেলাম যে। কপাল চাপড়ে নিজেই নিজেকে গালি দিতে দিতে নিদ্রকে "বাই" বলে ডাটা অফ করে দিলাম।
না'হলে অবস্থা খারাপ করে দিবে একদম।
,
এদিকে সুপ্তর ভয়ে পালানো দেখে হেসে ফেললো নিদ্র। মেসেজে সুপ্তকে থ্রেড দিয়ে ফোনটা রেখে দিলো ডেস্ক টেবিলের ওপর।
তারপর উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। আবার বেরুতে হবে একটু পর।
------
কোচিং শেষে বাইরে আসতেই দেখি রাস্তার অপজিটে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে বাইকে হেলান দিয়ে নিদ্র দাঁড়িয়ে । ও এই অসময়ে কোচিংয়ের সামনে কি করে?
আমি ভ্রু কুঁচকে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করি_
-- এখানে কেন?
ও হাত উঁচু করে রাস্তা পার হতে বলে।
আমি পিছু ঘুরে বন্ধুদের দিকে তাকাই। ওরা এখনো দেখতে পায়নি নিদ্রকে। দেখলেই শেষ একদম জোঁকের মত চিপকে যাবে আর ছাড়বে না। তাছাড়া ফাগুনও আছে, সেও মাইন্ড করতে পারে। এমনিতেই সেদিনের পর থেকে আমার সাথে তেমন কথা বলেনা।
আমার ভাবনার মাঝেই আভা এসে কাঁধে হাত রাখলো। ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো_
-- ভাই এখানে কি করে?
-- আমি জানি না। ও আবার আমাদের কোচিং চিনলো কি করে?
ফিসফিসেই উত্তর দিই আমি। আভা ঠোঁট কামড়ে বলে_
-- মনে হয় মা বলেছে। আমাকে নিতে আসবার নাম করে তোর কাছে এসেছে।
-- এখন কি করবো?
-- গিয়ে শোন আগে কি বলতে চায়।
-- সবাই আছে, কি করে যাই?
-- হুম তাও তো কথা। এক কাজ কর ওকে মেসেজ করে একটু সাইডে যেতে বল, তারপর তুই চলে যা।
-- আইডিয়া ভালো।
আভার কথা শুনে আমি চটপট ফোন বের করে নিদ্রকে মেসেজ করে দিলাম। ওর হাতেই ফোনটা ছিলো, আমার মেসেজ পেয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আমি চোখ পাকিয়ে বোঝালাম বন্ধুরা দেখলে মুসিবত।
ও ভাবলেশহীন দাঁড়িয়ে থাকলো যার মানে এই, "দেখুক তো কি হয়েছে?"
আমি বুঝলাম এই ছেলে কথা শুনবে না। আভাকেই বললাম ওদের অন্য কাজে ব্যস্ত রাখতে আমি ততক্ষণে চলে যাই ওপাশে।
আভা আমার কথা অনুযায়ী বন্ধুদের কাছে চলে গেলো। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাস্তা পার হয়ে নিদ্রর কাছে চলে এলাম।
আমি নিকটে আসামাত্র সে দাঁত বের করে হেসে বললো_
-- সারপ্রাইজ কেমন দিলাম?
-- ওয়ার্স্ট সারপ্রাইজ । না বলে এভাবে আসে কেউ? আমার বন্ধুরা কেউ জানেনা তুমি আমার বয়ফ্রেন্ড।
মুখ বেঁকিয়ে বললাম আমি।
-- তাই নাকি? তাহলে চলো শ্যালক-শ্যালিকাদের সাথে মিট করে আসি।
-- আরেহ আরেহ। ওদের সাথে মিট করতে হবে কেন?
আমি ওর হাত টেনে আটকালাম। ও হাসিটা বজায় রেখেই বললো_
-- পরিচিত হতে হবে না? তাদের একমাত্র কিউট ফ্রেন্ড সুপ্তর উড বি আমি। আমাকে না চিনলে হবে?
-- অত চেনা পরিচিতির দরকার নেই। সঠিক সময়ে সব হবে।
-- আচ্ছা তাহলে দেখাসাক্ষাৎ হলো না।
মন খারাপের ভান করে বললো ও। আমি চোখ সরু করে বললাম_
-- এত্ত রঙঢঙ শিখলে কবে বলো তো?
ও মুখটা নামিয়ে দুষ্টু হেসে বললো_
-- তোমার প্রেমে যেদিন পড়লাম সেদিন থেকে।
ওর বলার ধরনে আমিও হেসে ফেললাম। আলতো হাতে ওর মুখটা সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম_
-- কি যে করো! লোকে দেখছে।
-- দেখুক। আমার কি যায়-আসে!
-- আমার যায় আসে। একটু ঊনিশ বিশ হলেই তো বদনাম হয়ে যাবো।
-- আরো ভালো। প্রেমে বদনাম হলে সে প্রেম স্মরণীয় হয়ে থাকে।
-- কিছু না করেই বদনাম!
-- কিছু কি করতে চাও?
-- ছিঃহ্ নিদ্র। তুমি নটি হয়ে যাচ্ছো।
-- এখনই ছিঃহ্? পিকচার তো এখনো পুরোটাই বাকি। এখন নটি হয়েছি, এরপর নটিয়ার-নটিয়েস্ট হয়ে যাবো। তখন আমাকে কেমনে সামলাবা মিস.ক্লোজাপ হাসি!
-- ইশশ চুপ করো। এখন বলো না বলে আসলে কেন?
-- তোমাকে নিয়ে প্রেমবিলাস করতে যাবো বলে।
-- প্রেম বিলাস? সেটা কীভাবে
-- চলো দেখাই।
পকেট থেকে বাইকের চাবিটা বের করে বাইকের সিট থেকে হেলমেট টা নিয়ে আমার হাতে দিলো।
আমি খানিক অবাক হয়ে শুধালাম_
-- কোথাও নিয়ে যাবা নাকি?
-- হ্যাঁ প্রেমবিলাস করতে নিয়ে যাবো।
-- কিন্তু বাসায় কি বলবো?
-- বলো আভার বাসায় যাচ্ছো, গ্রুপ স্টাডি করতে।
-- বকা দিলে?
-- তুমি না ডেয়ারিং সুপ্ত, মাঝরাতে আমায় দেখতে আসো। এখন ভয় পাচ্ছো কেন?
-- কে জানে! আমি দিনে দিনে ভীতু হয়ে যাচ্ছি ।
মিন মিন করে কথাটা বলে বাসায় কল করলাম।
মা প্রথমে নিষেধ করলেও আমার রিকোয়েস্ট শুনে আর অমত করলো না তবে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে বললো।
আমিও তাকে আশ্বস্ত করলাম।
পরিশেষে আভাকে একটা মেসেজ করে দিতে ভুললাম না। ও সব সামলে নিবে ইনশাআল্লাহ।
_______________
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে মাত্র কিছুক্ষণ। সূর্যের আলোর তেজও কিছুটা কম। জনাকীর্ণ রাস্তায় নিদ্র আর আমি হেঁটে চলেছি, অজানা গন্তব্যে।
দু'জনেই নিশ্চুপ৷ আসলে নিস্তব্ধতাই মানাচ্ছে পরিবেশের সাথে। ভালোবাসা জিনিসটা ফীল করার বিষয়।
শুধুমাত্র ঠোঁটে ঠোঁটে কথা নয়, পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে;আঙুলের ভাঁজে আঙুল গুঁজে; মনের সাথে মনের সন্ধি করাটাও অন্যরকম ভালোবাসা।
,
কিছুটা সময় হাঁটার পর আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম ।
-- আর কত হাঁটবো নিদ?
-- আর অল্প একটু। সামনেই রেললাইন দেখতে পারবে। আজ বিনি পয়সায় ট্রেনে উঠাবো তোমায়। আসো?
-- বিনি পয়সায়! সেটা কীভাবে
ভ্রু কুঁচকে শুধালাম আমি।
-- আরে আসোই না?
ও হাত বাড়িয়ে ডাকলো। আমি মৃদু হেসে ছুটে গিয়ে ওর হাত চেপে ধরলাম।
-- জানো আমি না কখনো ট্রেন জার্নি করিনি।
-- তাহলে দূরের জার্নি গুলো কীভাবে করেছো?
-- কারে করে।
-- আচ্ছা আচ্ছা। বাপির আদরের মেয়ে আমার সুপ্ত।
-- হ্যাঁ। বাপি বলে দূরের জার্নির জন্য কারের চাইতে কমফোর্টেবল কিছু হয়না।
-- তুমি যে তুলোর বলের মত মোলায়েম তাই তোমার জন্য স্পেইশাল সব ব্যবস্থা। তাছাড়া কম্ফোর্টেবল তো সব কিছুকেই বানানো যায়। এটা একান্তই মনের ব্যাপার। বুঝলে?
-- বুঝলাম।
মাথা নেড়ে বললাম আমি।
আমাদের কথার মাঝেই ট্রেনের হুঁইসেল কানে আসে। ও আমার ডান হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করে_
-- তুমি তৈরি তো?
আমি ভ্রু কুঁচকে শুধাই_
-- কিসের জন্য।
ও স্রেফ বলে_
-- লেটস গো।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাতে টান পড়ে। ওর পিছু পিছু আমিও ছুটে চলি।
রেললাইন দেখামাত্র আমি বুঝতে পারি আমরা ছুটছি ট্রেন ধরতে।
কংকর বিছানো রাস্তায় দৌড়োতে অনেক কষ্ট হয়। কিন্তু সব কষ্ট চাপা পড়ে যায় প্রথম ট্রেন জার্নির এক্সাইটমেন্টের নিচে।
নিরন্তর ছুটতে ছুটতে মন্থর গতিতে এগোতে থাকা ট্রেনের একদম লাস্ট কম্পার্টমেন্টে আমরা উঠে পড়ি৷
নিদ্র ট্রেনের দরজায় হেলান দিয়ে হাঁপাতে থাকে, আর আমি দেহের সমস্ত ভার ওর শরীরে এলিয়ে দিয়ে আনন্দ-উত্তেজনায় কাঁপতে থাকি।
কিছুটা ধাতস্থ হয়ে নিদ্র বলে_
-- মিস.ক্লোজাপ হাসি, লাইফের ফার্স্ট বিনি পয়সায় ট্রেন জার্নিতে আপনাকে স্বাগতম ।
নিদ্রর কথায় সুপ্ত ওর বাহু জড়িয়ে প্রাণখোলা একটা হাসি দেয়।
অনিমেষ দৃষ্টিতে সেই হাসি দেখতে থাকে নিদ্র।
প্রেয়সীর ঠোঁটের কোণে হাসি দেখবার বাহানায় তো এতকিছু ।
অল্প সময়ের মধ্যে ট্রেনের গতি বেড়ে যায়। দূরন্ত ছুটে চলা ট্রেন থেকে বাইরের দৃশ্য অপরূপ লাগে সুপ্তর কাছে।
সারি সারি গাছপালা, ধানক্ষেত পেছনে ফেলে তারা এগিয়ে চলে অজানায়।
নিদ্র আলতো স্পর্শে ডাকে সুপ্তকে, ওর দিকে তাকালে আঙুলের ইশারায় নীলচে আকাশ টাকে দেখিয়ে দেয়।
মুগ্ধতা আরো বেড়ে যায় সুপ্তর। সারা আকাশ জুড়ে শুভ্র মেঘ পেঁজা তুলোর ন্যায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
খানিক যেতেই পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়া সূর্য দৃষ্টিগোচর হয় । সূর্যের রক্তিম আভায় নীল আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো কয়েকগুচ্ছ সাদা মেঘ রঙ পরিবর্তন করে গোলাপি বর্ণ ধারণ করেছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো প্রকৃতির অপার সৌন্ধর্য মন্ডিত দৃশ্য অবলোকন করে সুপ্ত, সব যেন আত্মস্থ করে নিচ্ছে মনের মনিকোঠায়।
এদিকে নিদ্র, দখিনা বাতাসে আন্দোলিত প্রেয়সীর দিঘল কালো কেশ সামলে দিতে ব্যস্ত। সেও পলকহীন চোখে শুষে নিচ্ছে তার বাহুডোরে বন্দী অষ্টাদশী তরুণীটির নৈসর্গিক সৌন্দর্য।
এ যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি।
দু'জনারই চোখের মোহাবিষ্টতা, ভালোলাগার অনুভূতি সবটা, সবটা অবলীলায় পড়ে ফেলা যায়।
তাদের দেখে মনে হয়, ভালোবাসার এ অন্যরূপ স্বর্গসুখ নামিয়ে দিয়েছে ধরণীর বুকে।
চলবে,
sinin tasnim sara
[একটু অগোছালো লাগতে পারে। উপমা দিতে আমি বড্ড কাঁচা 🤦♀️]
![](https://img.wattpad.com/cover/325002616-288-k523782.jpg)
YOU ARE READING
এক মুঠো গোলাপ
Mystery / Thrillerশুচিস্মিতা কবির সুপ্ত। সর্বদা নিজ জীবন চক্রকে জটিল ভেবে এসেছে। এক সময় তার জীবন সম্পর্কে জটিল ধারণাগুলোকে ভুল প্রমাণ করে জীবনের মানে শেখাতে এসেছিল একজন। জীবন নামক বর্ণহীন আকাশে হুট করে শত রঙের প্রজাপতি ডানা মেলে উড়তে শুরু করেছিল। সকল জড়তা কাটিয়ে বর্ণ...