এক মুঠো গোলাপ ৭

9 1 0
                                    

এক মুঠো গোলাপ

---
নিদ্রকে ফেরানোর জন্য অস্থির  হতে শুরু করছিলাম আমি। সরাসরি  তাকে মেসেজ দিতে পারতাম না।  ইনবক্সে হাজারখানিক শব্দ জড়ো করে কতবার যে ব্যাকস্পেস চেপে সব ক্লিয়ার করে দিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। 
মনে মনে সাজানো পাগলাটে চিন্তাগুলো শব্দ ছকে বেঁধে সেন্ড বাটনে ক্লিক করবার পূর্বে মনে হতো তার সাথে তো আমার কোনো সম্পর্ক নেই।  আমি মেসেজ দেয়ার পর যদি সে পাল্টা প্রশ্ন করে_ আমি ফিরবো কার জন্য?
তখন আমি কি বলবো! আমার জন্য ফিরুন?
সে তখন ভ্রু কুঁচকে বলবে, তুমি আমার কে হও যে তোমার জন্য আমায় ফিরতে হবে!
ভয় পাচ্ছিলাম আমি। রিফিউজ হবার ভয়ে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো  আমার। 
প্রায় প্রতিদিন আভার কাছে গিয়ে কাঁদতাম। আভা মাঝেমধ্যে  হেসে কুটিকুটি হয়ে যেত, আবার মাঝেমধ্যেই  এক ধমক দিয়ে বলতো_ প্রেমে পাগল হয়ে বোধবুদ্ধি  হারাতে শুরু করেছিস কেন? ধৈর্য্যশক্তি নামক একটা শব্দ  আছে ভুলে গেছিস!
আমি প্রতুত্তরে  কিছুই বলতাম না।  কেবল পাওয়া না পাওয়ার সংশয়ে ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম । 
পরিস্থিতি  এমন হয়ে গেলো ঐসব চিন্তায় পড়াশোনা ভুলে গেলাম,  বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বসা বন্ধ হয়ে গেলো, বাপি-মায়ের সাথে কথাবলা কমিয়ে দিলাম।  মানে আমার সরল সোজা জীবনটা হুট করে পরিবর্তন  হয়ে গেলো।
প্রাইভেট কলেজ হওয়ায় আমাদের  পরীক্ষা  ছিলো বেশি। সেবার প্রথম প্রিপারেশন ছাড়া পরীক্ষা  দিতে গিয়ে আমি মোটে ৪ টা সাবজেক্টে ফেইল করলাম। 
আমার রেজাল্ট কার্ড দেখে বাপি মা তো বটেই,  ক্লাসের অন্যান্য সহপাঠীরা এমনকি টিচার রাও হতভম্ব হয়ে গেলেন। 
বাপির চাকরির জোরে কলেজে আমার একটা আলাদা ইমেজ ছিলো। প্রি টেস্টে ফেইল করে সেই ইমেজ এক নিমেষে গুঁড়িয়ে  যাওয়ার দশা হলো। 
রেজাল্ট  পাবলিশ হবার তিনদিন পর প্রিন্সিপাল স্যার গার্ডিয়ান সমেত আমায় ডেকে পাঠালেন অফিসে। 
ভয়ে লজ্জায় সংকুচিত হয়ে আমি উপস্থিত  হলাম বাপিকে নিয়ে। আমার চোখ মুখের অবস্থা তখন করুণ।
স্যার আমাদের  দেখেই এগিয়ে এসে আন্তরিকতার সহিত রিসিভ করলেন বাপিকে। 
আমি এক কোণে দাঁড়িয়ে  রইলাম। স্যার ভালোমন্দ  জিজ্ঞাসা করে বাপির সাথে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাদের  দু ঘন্টার দীর্ঘ  আলোচনার সারমর্ম হলো এই, "আমি একজন প্রথম সারির স্টুডেন্ট ।  আমার ফিউচার ব্রাইট।  কিন্তু ইদানীং  একেবারেই পড়াশোনা  ছেড়ে দিয়েছি।  মাসটা নভেম্বর ।  এই সময় পড়াশোনা  থেকে মনোযোগ উঠে যাওয়া মানে এইচএসসিতে  বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন  হওয়া।  এইচএসসিতে ক্ষতি মানে জীবন বরবাদ।  আমার এমন রেজাল্ট  মোটেই কাম্য নয়।  আমি যাতে আনুসঙ্গিক চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে সম্পূর্ণরূপে পড়াশোনায় মন দেই এজন্য বিশেষ ভাবে বলা হলো বাপিকে।  টু থ্রীর বাচ্চাদের মত উনি যাতে পাশে বসে থেকে পড়া কমপ্লিট করে নেন এরকম সাজেশন দিলেন স্যার। "
বাপির সাথে কথা শেষে স্নেহমাখা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন স্যার।  আমায় কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন_"তুমি তো এরকম ছিলে না মা।  নিজ হাতে জীবনটা নষ্ট  করছো কেন? তোমাকে নিয়ে আমাদের  কত গর্ব।  তুমি আমাদের  বিশ্বাস, স্বপ্নগুলো নষ্ট কোরো না।  জীবনে ভালো খারাপ পরিস্থিতি  আসবে। শক্তভাবে মোকাবিলা  করতে না পারলে তো টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে।  বুঝতে পারছো আমি কি বলছি?"
আমি কান্না আটকে ঘাড় কাত করে সম্মতি দিলাম। 
সেদিন আর আমার ক্লাস করা হলো না। 
স্যারের রুম থেকে বেরুনোর পর বাপি আমার কাঁধে  হাত রেখে মোলায়েম কণ্ঠে বললেন_"সুপ্ত মামণি  তুমি ঠিক কি কারণে ভেঙে পড়ছো আমি জানিনা।  জিজ্ঞেসও করবো না তবে এতটুকু জেনে রাখো তুমি কিন্তু লক্ষ্যচ্যুত হয়ে যাচ্ছো।  তোমার জন্মই হয়েছে লড়াই  করার জন্য। সতেরো বছরের এই ছোট্টো জীবনে এত বেশীই ভয়ংকর  ঘটনার সম্মুখীন হয়েছো যে এই ছোটোখাটো বিষয়ে মুষড়ে পড়া ঠিক মানাচ্ছে না তোমায়।  
আমরা তো সবসময়ই তোমার পাশে আছি,  নিদের মত একটা বড় বোন আছে তোমার।  আমাদের  সাথে তোমার কষ্টগুলো শেয়ার না করে ভেতরে ভেতরে  শেষ হয়ে যাচ্ছো দিস ইজ নট ফেয়ার বাবু। 
লাইফ ইজ ভেরি বিউটিফুল ।  কষ্ট  পেয়ে,  কেঁদে জীবনকে নষ্ট করার কোনো মানেই হয়না। 
বাবা-র  স্নেহমাখা কণ্ঠ শুনে আমার হুট করে কান্না পেয়ে গেলো।  বাপির কাঁধে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেললাম আমি। 
বাপি আদুরে ভাবে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন এবং সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে আমার মন ভালো করার কাজে লেগে পড়লেন।   মধ্যাহ্নবেলা থেকে একদম বিকেল পর্যন্ত  আমরা বাপ মেয়ে শহর চষে বেড়ালাম৷ এতদিন পর ঘোরাফেরা  করে আমার মন সত্যিই ভালো হয়ে গেলো। নেগেটিভ  চিন্তা ভাবনা সব পজিটিভ চিন্তায় রূপান্তরিত  হয়ে গেলো। 
বাসায় ফেরার মুহুর্তে ইকোনমিক্স, স্ট্যাটিসটিকস এবং ইংরেজি প্রাইভেট  ঠিক করে ফিরলাম।  বাবা-র  তিনজন পছন্দের কলিগসের পরিচিত  হোম টিউটর আমায় পড়াতে আসার জন্য রাজি  হলেন।
একটা সাবজেক্ট  বাকি রইলো তা হলো আইসিটি। 
দীর্ঘদিন পর ঘোরাফেরা  করে মেজাজ যখন ফুরফুরে হয়ে গেলো আমার তখন একেকটা নতুন নতুন আইডিয়া উদ্ভব হতে শুরু করলো। 
সন্ধ্যেবেলা পুরো সময় মা'য়ের  সাথে রান্নাবান্না গসিপিং করে কাটিয়ে পড়াশোনায় লেগে পড়লাম আমি। 
আমাদের  বন্ধুমহলের আড্ডাবাজির একটা বিশেষ টাইম বেঁধে দেয়া আছে রাত্রি বারোটা থেকে ভোররাত তিনটে পর্যন্ত । 
পড়াশোনা  শেষ করে অনেকদিন পর আবার আড্ডায় যোগ দিলাম। 
আভা পারসোনালি কল দিয়ে খোঁজ  খবর নিলো আমার।  এবং নিদ্রকে ফেরানোর এক অদ্ভুত  আইডিয়া শেয়ার করলো আমার সাথে। 
আমাদের  যেহেতু  পরীক্ষার  আর বেশি সময় নেই এবং লাস্ট মোমেন্টে আমরা রেজাল্ট খারাপ করেছি তাই কয়েকটা সাবজেক্টের স্পেশাল প্রিপারেশন দরকার।  নিদ্র যেহেতু  ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করেছে তাই আমাদের  আইসিটি এবং ম্যাথ রিলেটেড সাবজেক্ট  সে ই পড়াতে পারে। 
তাকে এই দোহাই দিয়ে ডাকাই যায়। 
আভার কথায় আমি প্রশ্ন করলাম_"আমাদের  প্রাইভেট পড়াতে সে অতদূর  থেকে আসবে কেন?"
জবাবে আভা বললো_ নিদ্র তাকে ভীষণ  স্নেহ করে। পড়াশোনার ব্যপারেও সে স্ট্রিক্ট  আর তাই পড়ার কথা বললে না করতে পারবে না। 
আভার আইডিয়ায় আমি খুশি হয়ে গেলাম।  পরদিনই আন্টির মাধ্যমে কল করে নিদ্রকে আসতে বলবে এরকম কথায় আশ্বস্ত করলো ও আমাকে। 
এক্সাইটমেন্টে আমার ঘুম উবে গেল সে রাতে। 
পুরোটা রাত আমি ভবিষ্যতের চিন্তা করে কাটালাম। 
___
আভা অলওয়েজ  তার কথায় পাক্কা।  সে ঠিকই ভুজুংভাজুং দিয়ে নিদ্রকে মানিয়ে নিলো।  আমাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে এই উইকেন্ডে রংপুর ফেরার সংবাদ পাঠালো নিদ্র। 
বলে রাখা ভালো সে তার ফার্স্ট ক্লাস জব ইস্তফা দিয়েই ফিরছিলো ।  জব ছেড়ে দেয়ার কথা শুনে প্রথমে আমি ধাক্কা খেয়েছিলাম ছোটোখাটো ।  পরে অবশ্য  জানতে পেরেছি পারসোনাল কোনো কারণেই জবটা ছেড়ে দিয়েছে সে।
এবার রংপুরেই কোথাও একটা ট্রাই করবে। 
আমার মাথায় তখন ক্যারিয়ার নয় ভালোবাসার ব্যাপারটাই ঘুরপাক খাচ্ছিলো তাই ও কোথায় জব করছে, জব কেন ছেড়ে দিচ্ছে এসব নিয়ে মাথা ঘামালাম না আমি। 
___
অতি উৎসাহে নিদ্র আসার ডেইট কাউন্ট করতে শুরু করলাম।  আমার শখের ক্যালেন্ডারে লাল কালি দিয়ে দাগ কেটে কেটে দিন গুনতাম। 
মা রুমে আসলেই ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস  করতেন_ বাবু ক্যালেন্ডারে দাগাচ্ছিস কেন? কি বিচ্ছিরি  লাগে। 
আমি প্রতুত্তরে একগাল হেসে বলতাম_ তোমার মেয়ে জামাই আসতে চলেছে তারই অপেক্ষায় দিন গুনি।
মা মুখ বাঁকিয়ে চলে যেতেন।
এদিকে আমি ভাবলাম নিদ্রকে দু একটা করে মেসেজ দেয়া উচিৎ  ।  হোয়াটস আ্যাপে টুকটাক কথা শুরু হলো আমাদের । 
সে ট্রেনে ওঠার পূর্বে আমায় জানালো রংপুরে আসছে। আমি ঠোঁট  চেপে হাসি আর ভাবি, ডিয়ার আসছো তো তুমি আমার জন্যই। 
ও যখন রংপুরে নামলো তখন সময় সকাল সাতটা। রওয়ানা হওয়ার পূর্বে যেমন মেসেজ দিয়েছিল তেমনই গন্তব্যে পৌঁছে আরেকটা মেসেজ করে দিলো। 
ঠিকঠাক ভাবে পৌঁছুতে পেরেছে জেনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। 
তারপরই ঘুম এসে ভর করলো চোখের পাতায়। 
ঘুমের মধ্যে একটা অদ্ভুত  স্বপ্ন দেখলাম।  স্বপ্নটা অনেকটা এরকম_
কাঁচা হলুদ রঙের একটা শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে  ভেজা চুল সযত্নে  মুছতে মুছতে গুনগুনিয়ে গান গাইছি।
ঐ মুহুর্তে  কোথা থেকে নিদ্রর আগমন।  হাতে একটা চিকন কঞ্চির বেত নিয়ে সে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।  আয়নার ভেতরে তার রণমুর্তি দেখে ভয়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো আমার।  টাওয়াল ফেলে আমি ঘুরে তাকালাম। চিৎকার দেবার পূর্বে সে আমার মুখ চেপে ধরে রক্তাভ চোখে তাকিয়ে শাসানোর ভঙ্গিতে বললো_
-- এ্যাই ফেল্টুস আমাকে ভালোবাসার মত দুঃসাহস তোমার কি করে হয়! যেই মেয়ে পরীক্ষার  আগে চার সাবজেক্টে ফেল করে সে স্বপ্ন দেখে নিদ্রকে বিয়ে করার!
আর একবার যদি তোমার মুখে আমার নাম শুনেছি তাহলে এই বেত দেখছো। শুটিয়ে লাল করে দেবো বুঝতে পেরেছো?
আমি ভয়ে কাচুমাচু  হয়ে মাথা নাড়ালাম।  সে কঞ্চিটা ড্রেসিং টেবিলে বাড়ি মেরে আবারও ধমক দিলো _
-- চুল ভেজা কেন তোমার।  আর শাড়ি পরে রঙঢঙ  শুরু করেছো কেন? আমি আসছি বলে ভেবে নিয়েছো বিদেশ ফেরত জামাই আসছে? হলুদ ব্যাঙ কোথাকার। 
তুমি জানো এই কাঁচা হলুদ শাড়িতে তোমাকে চুপসে যাওয়া হলুদ ব্যাঙ মনে হচ্ছে । 
খবরদার  আর আমার সামনে শাড়ি পরে এসেছো তো। হলুদ ইট দিয়ে বাড়ি দিবো মাথায়।  ভর্তা হয়ে যাবা ফাজিল ব্যাঙকন্যা। 

শেষ ধমকে আমি ধড়ফড় করে উঠে বসলাম।  ভয়ে ঘেমে অস্থির হয়ে গিয়েছি।  বাপরে জল্লাদ একটা।  স্বপ্নে এসেও ভয় দেখায়। 
আমাকে হলুদ ব্যাঙ বলা না? এখন আমি সবসময় শাড়ি পরেই ঘুরঘুর করবো তোমার সামনে পেছনে।  দেখি তোমার রাক্ষসের মত রাগ কতদিন  বিদ্যমান থাকে। হুহ্!
চলবে?
sinin tasnim sara

এক মুঠো গোলাপWhere stories live. Discover now