#এক_টুকরো_মেঘ
#মেহেরুন_নেছা_হিতৈষীপর্ব ১
♣
' আজকে আসতে দেরি হলো যে তোমার। বাসায় কোনো সমস্যা হয়েছে এমজে? আর চোখমুখ অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেনো তোমার? কী হয়েছে?'
' না, তেমন কিছু না। ওই বাসায় বাবার সাথে মায়ের একটু ঝামেলা চলছে। দুজনেই বড় অদ্ভুত মানুষ। মা আবারও আগের মত বিহেভ শুরু করেছে। '
' ওহ আচ্ছা। কপালে আবার কী হয়েছে? ব্যান্ডেজ কেনো?'
' কেটে গেছে।'
' কেটে গেছে সেটা তো দেখতেই পারছি৷ কাটলো কিভাবে সেটাই জানতে চাইছি আমি।?'
' পা স্লিপ করে গেছিলো। পরে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছি। ওসব বাদ দাও। তুমি না বলেছিলে আমাকে তোমার বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে। কবে নিয়ে যাবে বললে না তো৷ আর এরকম ঠান্ডা শীতল দিনে তুমি চোখে সানগ্লাস পরে আছো কেনো? এই ছেলে সানগ্লাস খোলো তো। জানো না তোমার চোখ না দেখলে আমার শান্তি হয়না।'
' উফ এমজে তুমিও না! এই নাও সানগ্লাস খুললাম। খুশি?
' খুউউউউব!'
'বাসায় তো নিয়ে যাবোই। আসলে চাচাকে নিয়ে একটু ব্যাস্ত আছি কদিন ধরেই। একটু মিটে যাক, সবাটা একটু সামলে নেই, ঠিক নিয়ে যাবো।'
' আচ্ছা শোনো না! আমি কিন্তু ওইদিন শাড়ি পরব কেমন?'
' আবার শাড়ি কেনো? তুমি তো নিজেই হাটতে পারো না। শাড়ি পরে আছাড় খাওয়ার শখ হয়েছে নাকি?'
' ধুত বাজে বকবে না তো শারার। প্রথমবারের মত তোমার বাবার সামনে যাবো, এভাবে জিন্স টপ্স পরে যাওয়া যায় নাকি ধুত। শাড়িতে কোনো সমস্যা হবে না। একটা দিন ঠিক ম্যানেজ করে নেবো। আর আছাড় খেলে তোলার জন্য তো তুমি আছই। হাহাহা'
' কাহারও হাসি ছুরির মতো কাটে
কাহারও হাসি অশ্রুজলের মতো৷ ইশ! এই হাসিটা বাঁধিয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়।'
' শুরু হয়ে গেলো কাব্য রচনা.... '' আড়াল! '
আসাদুজ্জামান খন্দকার মেয়ের দরজায় দাঁড়িয়ে মেয়েকে ডাক দিলেন। বাবার ডাকে পুরনো স্মৃতি থেকে আচমকা বেড়িয়ে এলো আড়াল। আশেপাশে তাকিয়ে হঠাৎই নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করলো। হ্যাঁ, দিবা স্বপ্নই দেখছিলো সে। ঠিক দিবা স্বপ্ন বললে ভুল হবে, পুরোনো স্মৃতিগুলো যেন হঠাৎই উঁকি দিচ্ছিলো। নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে নিয়ে বাবাকে ভেতরে এসে বসতে বললো আড়াল।
' কী ব্যাপার! এখনো শাড়ি পরোনি যে তুমি? আবিরের বাড়ির লোকের সামনে অবশই তুমি এরকম ড্রেস-আপে যাবে না? আর তোমার মা কোথায়? তাকে তো বলেছিলাম তোমাকে যেন শাড়ি পরিয়ে রেডি করে রাখে। '
প্রচন্ড বাজখাই গলায় কথাগুলো বললেন আসাদুজ্জামান খন্দকার। আড়াল বাবার এই ব্যাবহারে পরিচিত। নিজের গলার স্বর যতটা সম্ভব নিচুতে রেখে উত্তর দিলো,
' আমি একাই শাড়ি পরতে পারি বাবা। আর আমি শাড়ি পরতেই যাচ্ছিলাম। এর মাঝেই তুমি এসে পরলে। চিন্তা নেই বাবা! আমি বেশ সুন্দর স্বাভাবিক ভাবেই ওনাদের সামনে যাবো। আর আবির ভাইয়া আমাকে বেশ ভালো ভাবেই চেনে। সমস্যা নেই।'
আড়াল নিচু স্বরে কথা বললেও কথাগুলো বেশ শক্ত ও জোড় দিয়ে বললো। কথাগুলো শুনে আড়ালের বাবা বিছানা ছেড়ে উঠে গেলেন। যাওয়ার আগে আবারও বেশ চিৎকার করে বলে উঠলেন,
' কপালে ব্যান্ডেজ লাগাওনি কেনো? আর ঔষধ লাগাও না নাকি? নাকি লোকজনকে দেখাতে চাও আমি আর তোমার মা তোমাকে সবসময় অত্যাচার করি? দ্রুত ব্যান্ডেজ লাগিয়ে রেডি হয়ে নাও।'
নিজের কথা শেষ করে চলে যেতেই দরজাটা লাগিয়ে বিছানার একপাশে রাখা শাড়িটা তুলে আবারও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরলো আড়াল। কচিপাতা রঙের সবুজ জামদানী শাড়ি। শাড়িটা ওর মায়ের খুব শখের শাড়ি৷ এই শাড়িটা আড়ালের খুব পছন্দের। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে আড়ালের মা মিসেস রেবেকা চৌধুরী এই শাড়িটা কাউকে ছুঁতে পর্যন্ত দিতেন না।
প্রথম যেদিন আড়াল শারারদের বাড়িতে গিয়েছিলো, সে অনেকগুলো বছর আগের কাহিনী। মাকে প্রচুর বুঝিয়ে সুঝিয়ে শাড়িটা প্রথমবারের মত পরেছিলো আড়াল। আর আজ দ্বিতীয় বারের মত শাড়িটি পরতে যাচ্ছে সে৷ আজ অবশ্য মা নিজে থেকেই বের করে দিয়েছে শাড়িটা
সেদিনের সাজ, সেদিনের তারিখ, এমনকি সেদিনের ঘটনার সাথেও আজকের ঘটনার কত বেশি মিল। শুধু মিল নেই হাত ধরে থাকা মানুষটির। আর মাঝখানে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর।
নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ফোনের রিংটোন শুনে ভাবনায় ছেদ ঘটলো আড়ালের।'
' হ্যালো, আড়াল?'
' হ্যাঁ সায়মাপু বলো! কেমন আছো?'
' আমি ভালোই আছি। শোন অনেক ব্যাস্ত আছি আজ। জরুরী কথাটা বলেই কেটে দেবো।'
' হ্যাঁ, বলো আপু। কি হয়েছে?'
' তোর বইগুলো সব এসে গেছে। আমি আজ বিকেলে তোর বাড়ি পাঠিয়ে দেই? অটোগ্রাফ দেওয়া শুরু করে দে? বইমেলার তো বেশি দেরী নেই৷ আর তুই যা ব্যাস্ত মানুষ। সামনে তোর এক্সামও আছে। '
' আচ্ছাহ আপু পাঠিয়ে দাও৷ আমি বাসাতেই আছি। '
' ওকে রাখছি এখন।'
ফোনের কথা শেষ করে চট করে ঘড়ি দেখে নিলো আড়াল৷ সময় প্রায় হয়ে এসেছে৷ আর একটু পরেই লক্ষ্মী মেয়ে সেজে আবিরের বাড়ির লোকের সামনে যেতে হবে তাকে৷ দেরি করলে আবারও বাসায় গ্যাঞ্জাম হবে যেটা তার একদমই পছন্দ না।
দেরি না করে ঝটপট শাড়িটা পরে চুলগুলো হালকা করে সেট করে মায়ের দেওয়া গয়নাগুলো পরে ফেললো আড়াল। এরপর খুব যত্ন করে কপালের কোনায় কাটা অংশে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে নিলো। এই কাটা অংশটা যেন তার চিরজীবনের সঙ্গী হয়ে গেছে। মাসের মধ্যে অন্তত একবার সে কোনো না কোন কারণে পা পিছলে পড়ে যাবেই। আর পড়তে পড়তেই বাড়ির কোনো না কোনো আসবাবপত্রের কোণার সাথে তার কপালে ঠোকাঠুকি হবেই। মনের অজান্তেই আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে হেসে ফেললো আড়াল। কে বলবে এই মেয়েটা প্রতিদিন একটু একটু করে ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে! পুরে পুরে ছাই হয়ে যাচ্ছে ভেতরটা!' মা! তোমরা আর দেরি করো না৷ এবার বেরিয়ে পরো। ওরা নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে৷ বাবা কই মা? দেখছি না যে। '
' তোর বাবার যা কাজ তাই! শেষ মুহূর্তে ভেজাল করা৷ কাল বারবার বলেছিলাম মিষ্টি এনে রাখতে। কে শোনে কার কথা? এখন গেছে মিষ্টি আনতে। তোর বাবা এলেই বেরিয়ে পরব। তুই কিন্তু গেলেই পারতিস বাবা৷ '
' না মা আমি চাই আড়ালের সাথে দেখা করে একা কথা বলতে। দেশে ফিরে ওর সাথে তো সেভাবে কথা বলার সুযোগই হয়নি। '
' আচ্ছা বুঝলাম। যা ভালো বুঝিস। আর শোন আবির! তুই আড়ালকে আংটি পরিয়ে আসতে মানা করেছিস ঠিক আছে। কিন্তু আমার হবু বউমার মুখ তো আমি খালি হাতে দেখব না৷ '
মায়ের কথায় একটু অবাক হলো আবির৷ হঠাৎই গলায় একটু চাপ অনুভব করতেই বোনের উপস্থিতি টের পেলো আবির।
' মা ভাবী আর আমার জন্য হাতের খুব সুন্দর একটা করে বালা বানিয়ে ফেলেছে এরই মধ্যে ভাইয়া। বালাটা কী যে সুন্দর! '
পেছন থেকে ভাইয়ের গলা জরিয়ে ধরে আনাবিয়া কথাটা বলে ফেললো।
আবির আনাবিয়ার হাত ছাড়িয়ে ওর কানটা ধরে বলতে শুরু করলো, ' কি রে পেচু? এরই মধ্যে আমার বউয়ের জিনিসে ভাগ বসানো শুরু করে ফেলেছিস? নাকি তোরও একটু বিয়ের পীড়িতে বসার শখ হয়েছে রে পেচু? আর এত সেজেছিস কেনো? আড়ালের কিন্তু কোনো ভাই নেই। তবে ওদের বাড়ির দারোয়ানের সাথে তোকে বেশ মানাবে।'
' মা দেখোনা ভাইয়া কেমন করছে!''
আহ্লাদী কন্ঠে মায়ের কাছে নালিশ জানালো আনাবিয়া৷ '
নুসায়বা খানম ছেলেমেয়েদের এই ধরনের ছেলেমানুষী দেখে একটু রাগী চোখে তাকালেন। কিছু একটা বলবেন অমনি ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। ঝটপট কথা সেড়ে আনাবিয়ার দিকে তাকালেন তিনি।
' তোর বাবা গাড়ি নিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে আছে৷ চল এক্ষুনি।'
নিজের শাড়িটা হালকা হাতে ঠিকঠাক করে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ' আসছি আব্বু। দরজা লাগিয়ে দাও। '
স্বভাবমতোই গেট পর্যন্ত মাকে এগিয়ে দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বিদায় দিয়ে দরজা লক করে রুমে চলে এলো আবির। আর নুসায়বা খানম মেয়েকে নিয়ে গাড়িতে বসে পড়তেই তার স্বামী ইশারায় ড্রাইভারকে গাড়ি চালানোর নির্দেশ দিলেন।
আবির নিজের রুমে এসে জানালা দিয়ে গাড়িটাকে বেড়িয়ে যেতে দেখলো আবির। গাড়িটা চলে যেতেই বিছানা থেকে নিজের ফোনটা হাতে তুলে নিতেই দেখলো একটা নাম্বার থেকে বেশ কয়েকটি মিসডকল এসেছে। ঝটপট নাম্বারটিতে ছোট্ট করে মেসেজ লিখে ফেললো,
' Everything is fine... Don’t worry.'
মেসেজটি সেন্ড করেই বিছানায় গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো আবির।(চলবে..)
YOU ARE READING
এক টুকরো মেঘ (Completed✔)
Romanceকয়েকটি জীবনের চড়াই-উতরাই, হাসি কান্না, সুখ দুঃখের কাহিনী নিয়েই লেখা #এক_টুকরো_মেঘ