#এক_টুকরো_মেঘ
#মেহেরুন_নেছা_হিতৈষীপর্ব ১৫
♣
জানুয়ারি মাস প্রায় শেষের দিকে।
চারিদিকে হালকা কুয়াশা আর ঠান্ডা বাতাস বইছে৷ মাঝেমধ্যে গুড়িগুড়ি বৃষ্টিও পরছে। বৃষ্টির জন্য শীতটা আরো যেন বেশিই লাগছে।
খুরশিদা বেগমের গাড়িটা একটা বেসরকারি এনজিওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িতে তার সাথে আছে আড়াল। শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে এই এনজিওটি।
কিছুটা সময় পেরোতেই খুরশিদা বেগম আড়ালকে হাতের ইশারায় গাড়ি থেকে নামতে বললেন। গাড়ির ড্রাইভারকে কিছু একটা বলেই আড়ালের হাত ধরে এনজিও এর ভেতরে প্রবেশ করলেন। খুব সুন্দর ছিমছাম এবং বেশ গোছানো এঞ্জিয়টি। আড়াল তার নানুর পেছনে পেছনে গুটিগুটি পায়ে হেটে যাচ্ছে মনে একরাশ প্রশ্ন এবং উদ্বেগ নিয়ে।
খুরশিদা বেগম নাতনীর হাত ধরে এনজিওর ভেতরে ঢুকে বেশ কিছুটা পথ পেরিয়ে এক কোণায় ছোট একটি ঘাট বাধানো পুকুরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বাধাই করা ঘাটের সিড়িতে আড়ালকে বসার নির্দেশ দিয়ে নিজেও বসলেন।
" তোর মনে আজ অনেক প্রশ্নের পাহার জমেছে তাই না রে?"
আড়াল মাথা নিচু করে রইলো। খুরশিদা বেগম নাতনীকে আরো কাছে টেনে নিলেন,
" তখন আমার আর তোর নানুর অহংকারের সীমা ছিলো না। মান সম্মান টাকা বিজনেস এগুলোই আমাদের কাছে মূল্যবান। তোর মা ছিলো আমাদের একমাত্র আর সবচেয়ে আদরের মেয়ে। কখনো কোনো কিছুর অভাব দেইনি ওকে। না করেছি কখনো শাসন। তোর মা কলেজে উঠে কেমন বখে যেতে শুরু করলো। উল্টোপাল্টা বন্ধু বান্ধব, উল্টোপাল্টা ভাবে চলাফেরা....
কেমন যেন উশৃংখল হয়ে যাচ্ছিলো রেবেকা। "
আড়াল যেন একটু নড়েচড়ে বসলো।
" তোমরা মাকে কিছু বলোনি?"
" ওইযে বললাম.. খুব আদর করতাম। অহংকারের নিচে মেয়ের সব ভুল চাপা দিয়ে ফেলতাম। কিন্তু এভাবেই মেয়েটা এক অন্ধকার জীবনে ঢুকে যাচ্ছিলো৷ ঠিক সেই মূহুর্তে এক মুঠো আলো নিয়ে তোর মায়ের জীবনে এলো এক অল্পবয়সী ছেলে। বয়সে ছেলেটা তখন তোর মায়ের থেকে তিন কি চার বছরের বড় হবে৷ খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলো। বাবা মা মারা যাবার পর ছোট ভাইকে নিয়ে খুব স্ট্রাগল করে নিজের পরিচিতি গড়ে তুলেছিলো। কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে তোর মায়ের রেজাল্ট যখন খুবই করুন, ছেলেটাকে বাসায় তোর মায়ের টিউটর হিসেবে দিলাম।"
খুরশিদা বেগম একটু থামতেই আড়াল অস্থির হয়ে প্রশ্ন করলো,
" তারপর? কি হলো নানু?"
খুরশিদা বেগম নাতনীর গালে হাত দিয়ে মুচকি হাসলেন।
" তারপর আর কি... যা হবার তাই হলো। তোর মা পড়াশোনায় ভালো করলো ঠিকই কিন্তু নিজের মনটা সেই ছেলেটাকে দিয়ে বসলো। আর সেই ছেলেটাও৷ ঠিক যেন বাংলা সিনেমার আর পাঁচটা সাধারণ প্রেমে পরার কাহিনী। সব বেশ ভালোই চলছিলো, এর মাঝেই তোর মা আমার আর তোর নানুর হাতে ধরা পরে গেলো। ধরা পরে গেলো বললদ ভুল হবে, আসাদই ওদের এই ব্যাপারটা আমাদের সামনে নিয়ে আসে।
কোটিপতি ঘরের মেয়ে একটা গরীব ছেলের প্রেমে পরে পাগল হয়ে যাচ্ছে এটা তোর নানু মেনে নিতে পারলেন না। চিৎকার চেচামেচি করলেন, মেয়েকে বাড়িতে বন্দী করলেন। আর অন্যদিকে সেই বেচারা ছেলেটার উপর নানাভাবে অত্যাচার করলেন। কিন্তু এতকিছুর পরেও ছেলেটা নাছোড়বান্দা। সে আমার মেয়েকে ভালোবেসেই যাবে। "
কথা বলতে বলতেই খুরশিদা বেগম হেসে ফেললেন। আড়ালের সারা শরীর শিউরে উঠলো। কোনো রকমে জিজ্ঞাসা করলো,
" এরপর কি হলো নানু? সেই লোকের কি হলো? তিনি এখন কোথায়?"
" তোর মা প্রথম দিকে খুব শক্ত ছিলো। পরে একদম নরম হয়ে গেলো। ভেবেছিলাম মেয়ের মাথায় হয়ত বুদ্ধি এসেছে। ইন্টার পরীক্ষা প্রায় শেষ শেষ। তোর নানু বললেন আসাদের সাথে তোর মায়ের বিয়ে দেবেন। আসাদের বাবা তখন আমাদের বিজনেস পার্টনার। ছোটখাটো ভাবে সাহায্য সহযোগীতা করতো তোর নানুকে। নানা ভাবে তোর নানুর মন জয় করে বিজনেসে ঢোকে। আসাদকে আমার কখনোই মন থেকে পছন্দ ছিলো না। বিয়েতেও আমি রাজী ছিলাম না।"
" তাহলে? "
" যেদিন তোর মায়ের শেষ পরীক্ষা! সেদিন তোর মা আর বাড়ি ফেরেনি। ড্রাইভারের চোখ ফাঁকি দিয়ে ওই ছেলের সাথে পালিয়ে যায় তোর মা। আমার আর তোর নানুর তখন পাগল প্রায় অবস্থা। একমাত্র মেয়ে একটা থার্ডক্লাস ছেলের সাথে পালিয়েছে। মেয়ের ভালোবাসার কথা তখন আমাদের কাছে তুচ্ছ। মান সম্মান ক্লাস স্ট্যাটাস এসবই আমাদের কাছে তখন মেইন প্রায়োরিটি। "
খুরশিদা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চারিদিকে মিষ্টি রোদ ঝলমল করছে। আগের চেয়ে একটু কম শীত লাগছে। একটু সময় নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন,
" অনেক অনেক খুঁজলাম তোর মাকে। প্রায় একবছর হবে হবে৷ এর ভেতরেই আসাদের বাবা রেবেকার খোঁজ নিয়ে এলেন। ময়মনসিংহের কোনো এক গ্রামে দুজনে বিয়ে করে সংসার করছে। তৎক্ষনাৎ তোর নানু লো পাঠিয়ে রেবেকাকে সেখান থেকে নিয়ে আসে। বাড়িতে ওকে খুব বকাঝকা করা হয়। এমনকি যে মেয়েকে কখনো ফুলের টোকা পর্যন্ত দিই নি সে মেয়ের গায়ে পর্যন্ত হাত তুললাম। রেবেকা তখন পাগলপ্রায়। খুব কাঁদতো। ঠিকমতো খেতো না৷ এরমধ্যে হঠাৎই মেয়েটা ভয়াবহ রকমের অসুস্থ হয়ে পড়লো। চিকিৎসা করাতে গিয়ে জানলাম আমার মেয়েটা চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমি তখন কি করবো কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না। তোর নানুকে আসাদের বাবা বুঝালো বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলতে হবে। না হলে লোকের সামনে মুখ দেখানো যাবে না। তখন ডাক্তার জানালেন রেবেকার বডিতে কিছু প্রবলেম আছে। আর এই বাচ্চাটাকে নষ্ট করে দিলে ওর বডিতে আরো বেশ কিছু কমপ্লিশন দেখা দেবে। যাতে ওর লাইফ রিস্ক রয়েছে।
মেয়ের জীবনের দিকে তাকিয়ে তোর নানুকে বুঝালাম। নিজেকে বুঝালাম। ঢাকা ছেড়ে মেয়েকে দিয়ে ছয় মাসের জন্য ইন্ডিয়া শিফট করলাম। সবাইকে জানালাম ঘুরতে যাচ্ছি। ওখানেই রেবেকার ডেলিভারি হলো। ফুটফুটে ছোট্ট একটি শিশু। মায়ায় ভরা তার চাহনি। তোর মায়ের অবস্থা তখন খুব খারাপ। বাচ্চা মেয়েটাকে আমিই প্রথম কোলে নিলাম। বাচ্চা মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত চাহনীতে তাকিয়েছিলো। যেন আমায় বলছে ' কি! আমাকে তো খুব পৃথিবীর আলো দেখতে না দেওয়ার প্ল্যান করেছিলে! এখন আবার আদর দেওয়া হচ্ছে?'
মুহূর্তেই বাচ্চাটা আমার মনে জায়গা করে নিলো। কিন্তু তোর নানু কিছুতেই বাচ্চার মুখ পর্যন্ত দেখবে না। সিদ্ধান্ত হলো দেশে ফিরে বাচ্চাকে একটা অনাথ আশ্রমে দিয়ে দেওয়া হবে। রেবেকা খুব কাঁদলো। কিন্তু কেউ ওর কথা শুনলাম না। দেশে ফিরতেই আসাদ জানালো ও রেবেকাকে বিয়ে করতে চায়। পরিস্থিতির চাপে পরে, লোক লজ্জার কথা ভেবে আমিও রাজী হয়ে গেলাম। রেবেকার শরীর ভেঙে যেতে শুরু করলো। নাওয়া খাওয়া সব ছেড়ে দিলো। আবার আগের মত উল্টোপাল্টা নেশায় ধরলো। হঠাৎই একদিন আবারও অসুস্থ হয়ে পরলো রেবেকা। ডাক্তার জানালো আমার মেয়েটা আর কখনো মা হতে পারবে না।
রেবেকার তখন সেসব বোঝার মত কোনো মানসীকতাই নেই। মেয়েটা আমার ভেতর থেকেই মরে গেছে। "
খুরশিদা বেগম থামতেই দেখলেন আড়ালের চোখদুটো ছলছল করছে। যেন কোনো রকমে কষ্ট করে চোখের পানি আটকে রেখেছে।
" নানু! তারপর কি হলো সেই বাচ্চা মেয়েটার? আর সেই লোকটা? তারই বা কি হলো বললে না তো! বলো না নানু!"
খুরশিদা বেগম নাতনীর গাল বেয়ে গড়িয়ে পরা পানি নিজের হাত দিয়ে মুছিয়ে দিলেন।
" তারপর তোর নানুকে দিন রাগ এক করে বুঝালাম যেন বাচ্চাটাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে৷ তোর নানুকে জোর করে সেই অনাথ আশ্রমে নিয়ে গেলাম। বাচ্চাটার তখন দুই কি তিন মাস বয়স৷ মায়ের কোলে খেলা করা ছেড়ে বাচ্চাটা তখন অনাথ আশ্রমে কষ্টের দিন গুনছিলো। তোর নানু বাচ্চাটাকে এক ঝলক দেখেই মায়ায় পরে গেলেন। যতই হোক নিজের রক্ত বলে কথা।
বাচ্চাটাকে বাড়ি আনলাম। আসাদ কিছুতেই অন্যের মেয়েকে মেনে নেবে না। রেবেকার তখন এসব ব্যাপারে কোনো হুশ নেই। রেবেকাও নিজের মেয়েকে অস্বীকার করে দিলো। বুঝালেও বুঝতো না যে এটা ওরই মেয়ে। আবার মাঝমাঝে নিজে থেকেই খুব যত্ন করতো নিজের মেয়ের। এমন দেখেই মেয়েটার নাম রেখেছিলাম ' আড়াল।'
হ্যাঁ সোনা। সেই বাচ্চা মেয়েটাই আজকের তুই!"
আড়াল যেন শেষ লাইনেরই অপেক্ষা করছিলো। নানুর মুখ থেকে শেষ কথাটা শুনেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো আড়াল।
" আর আমার বাবা? বাবা কোথায় নানু!"
খুরশিদা বেগম নিজের ঘড়িতে সময় দেখে নিলেন। আড়ালের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কাউকে একটা কল করে টুকটাক কিছু কথা বলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। আড়ালের হাত ধরে বেশকিছুটা রাস্তা পেরিয়ে একটি ভবনের সিড়ি দিয়ে উঠে গেলেন। একটি রুমের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আড়ালকে আঙুল দিয়ে ইশারায় কাউকে একটা দেখালেন।
" ওইযে! দেখতে পাচ্ছিস লোকটাকে? কি সুন্দর ছিমছাম একটা মানুষ! তোর মাকে যখন আমাদের কাছে নিয়ে আসা হয় আসাদের বাবা তোর নানুকে খুব বুঝালো উল্টোপাল্টা। আমারও তখন সেই ছেলের উপর খুব রাগ৷ লোকজন দিয়ে ছেলেটাকে খুব মারা হলো। ছেলেটা তবুও রেবেকার আর নিজের সন্তানের খুব খোঁজ নিতে চাইতো। আসাদ ওকে একদমই পছন্দ করতো না। বেশ কয়েকবার ওকে লোকজন দিয়ে মার খাওয়ানো হলো, রেবেকার বিয়ের খবর দেওয়া হলো৷
ধীরে ধীরে ছেলেটা বেশ অসুস্থ হয়ে পরে। এরপর তোর নানু ওকে নিজের সন্তানের মৃত্যুর মিথ্যে সংবাদ দেয়, যা ছেলেটা মেনে নিতে পারেনি। ওর ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে পরে জানতে পেরেছিলাম সেই ঘটনার পর থেকেই ছেলেটা মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরেছে। "
আড়াল বেশ কিছুক্ষণ জানালার গ্রিল ধরে এক নজরে লোকটাকে দেখলো৷ আড়ালের চোখের পানি আজ যেন আর বাধ মানছেই না। নিজের বাবাকে এমন পরিস্থিতিতে দেখে, নিজের জন্মের পেছনের ভয়ংকর সব কথা জেনে দ্রুত দৌড়ে বিল্ডিংটা ছেড়ে মাঠে নেমে এলো আড়াল। খুরশিদা বেগম নাতনীর পেছনে পেছনে এসে দাঁড়ালেন। নাতনীকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা তার জানা নেই।
" ওই লোকটাই তাহলে...."
আড়াল মাটিতে হাটু গেড়ে বসে ঝরঝর করে কাঁদছে। আশেপাশের বেশকিছু মানুষ দূর থেকে দেখছে কিন্তু সেসবের দিকে এদের কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। খুরশিদা বেগম নাতনীর মাথায় হাত রেখে বললেন,
" হ্যা সোনা। ওই লোকটাই তোর জন্মদাতা পিতা মাহেদুল আলম খান। ''
হঠাৎই আচমকা আড়াল উঠে দাঁড়ালো। হাত দিয়ে এলোপাথাড়ি নিজের চোখের পানি মুছে নানুর হাতদুটো শক্ত করে ধরলো।
" কিন্তু.... নানু...এনাকে তো আমি চিনি.....
হ্যাঁ চিনি আমি এনাকে। ইনিই তো শারারের সেই বড় চাচ্চু!..."( চলবে...)
YOU ARE READING
এক টুকরো মেঘ (Completed✔)
Romanceকয়েকটি জীবনের চড়াই-উতরাই, হাসি কান্না, সুখ দুঃখের কাহিনী নিয়েই লেখা #এক_টুকরো_মেঘ