#6

92 7 0
                                    

#এক_টুকরো_মেঘ
#মেহেরুন_নেছা_হিতৈষী

পর্ব ৬

আড়াল তখন ক্লাস টেনে পড়ে। বছর প্রায় শেষের দিকে। এমন সময় হঠাৎই খুরশিদা বেগম এবং মো. গোলাম মোস্তফাকে দেশ ছেড়ে বিজনেসের কাজে বিদেশে পাড়ি জমাতে হয়। খুরশিদা বেগমের প্রথম থেকেই আড়ালের বাবার ওপর যথেষ্ট সন্দেহ ছিলো। তাই বুদ্ধি করে আড়ালের দেখাশোনা করার জন্য খুশিকে আড়ালের সাথে রেখে যায়। কিন্তু আফসোস, খুশি কাছে থেকেও নিরুপায় ছিলো।

আড়াল তখন এসএসসি দিয়ে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করছে। খুব তুখোড় ছাত্রী না হলেও ছাত্রী হিসেবে ভালোই ছিলো আড়াল। দেখতে দেখতেই আড়ালের রেজাল্ট বেড়িয়ে গেলো। রেজাল্ট নিয়ে আড়াল খুব ভয় পাচ্ছিলো। কারণ বাবা বলেছে রেজাল্ট ভালো না হলে তার কপালে দুঃখ আছে। যদিও রেজাল্ট নিয়ে আসাদুজ্জামান খন্দকারের তেমন কোনো মাথাব্যথা ছিলো না। কিন্তু যেন ইচ্ছে করেই সে মেয়েকে একরকম শিক্ষা দিতে চাচ্ছিলেন মনে মনে।
দুর্ভাগ্য ক্রমে আড়াল এসএসসিতে ৪.৫০ পেয়ে গেলো। সারাদিন অফিস করে বাড়ি এসেও আসাদুজ্জামান খন্দকার মেয়েকে রেজাল্টের ব্যাপারে কিছুই জিজ্ঞাসা করেনি। রাতে খাবার পর টিভিতে রেজাল্ট বের হওয়ার খবর দেখতে দেখতেই বেশ স্বাভাবিক ভাবে মেয়েকে বসার ঘরে ডাকলেন।
" আড়াল! আড়াল বাইরে এসো।"
বাবার ডাক শুনেই আড়াল ভয়ে কাঠ হয়ে গেলো। তবুও সাহস যুগিয়ে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বিশ্বাস ছিলো বাবা তাকে একটু বকাঝকাই হয়ত করবে। এর বেশি আর কিই বা করবে। তবে মনে মনে প্রতিজ্ঞাও করে ফেলে সামনের বার থেকে আরো ভালো করে পড়াশোনা করবে। ধীর পায়ে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় আড়াল।
" তোমার নাকি আজ রেজাল্ট বেড়িয়েছে?"
আড়াল মাথা নিচু করে সম্মতি জানালো।
" তা রেজাল্ট কী? "
আড়ালকে মাথা নিচু করে চুপ থাকতে দেখে আসাদুজ্জামান খন্দকার টিভি বন্ধ করে মেয়ের দিকে তাকালেন।
" কি ব্যাপার কথা বলছো না কেন?"
বাবার গর্জে ওঠা গলার স্বর শুনেই আড়ালের চোখে পানি চলে এলো। বুঝেতে পারছিলো বাবা আরো রেগে যাচ্ছে।
মেয়েকে চুপ থাকতে দেখে আসাদুজ্জামান খন্দকার বেশ রেগে গেলেন। হাত দিয়ে মেয়েকে ধরে জোরে করে ঝাকি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, " কথা বলছিস না কেনো ফাজিল মেয়ে? বল কি রেজাল্ট করেছিস বল!"
আড়াল ভীষণ ভয়ে ভয়ে নিজের রেজাল্ট বললো এবং সাথে সাথেই তার বাবা কষে গালে একটা চড় বসিয়ে দিলো। তাল সামলাতে না পেরে আড়াল দেয়াল ঘেঁষে রাখা ফুলদানির সাথে লেগে পড়ে গেলো এবং ফুলদানিটাও ভেঙে ফ্লোরে ছড়িয়ে গেলো। আড়াল আগে কখনো বাবাকে এতটা ভয়ংকর হতে দেখেনি। আসাদুজ্জামান খন্দকার বেশ রাগান্বিত স্বরে বলতে থাকলেন,
" তোর পেছনে এত এত টাকা খরচ করছি এই কারণে? এই তোর রেজাল্ট! "
বাবাকে নিজের দিকে তেড়ে আসতে দেখে আড়াল দ্রুত অন্যদিকে সড়ে যেতে চাইলেই আরো ভয়ংকর হয়ে উঠলো আড়ালের বাবা। এক টানে কোমড়ে রাখা বেল্টটা খুলে খুব বাজে ভাবে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করলো আর আড়ালকে খারাপ রেজাল্টের জন্য জোরে জোরে বকাঝকা করতে থাকলো।
প্রতিবার আঘাতে আড়াল চিৎকার করে কাঁদতে থাকলো। আড়ালের কান্নার শব্দে খুশিসহ বাড়ির সব কাজের লোক জড়ো হয়ে গেলো। এমনকি আড়ালের মা রেবেকা চৌধুরীও ঘোর লাগা চোখে বসার ঘরে ছুটে এলেন। আড়াল ভাবলো এবার বুঝি মা ঠিক বাবাকে সড়িয়ে নিয়ে তাকে আদর দেবে। খুশি দৌড়ে রেবেকা চৌধুরীর কাছে গিয়ে কাঁদোকাঁদো হয়ে বললো,
" ম্যাডাম!  আপারে বাঁচান। স্যার আপারে মাইরাই ফেলবো। ম্যাডাম কিছু করেন।"
বেল্টের আঘাতে আড়ালের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কেটে গিয়ে রক্ত পড়ে ফ্লোর আর আড়ালের শরীর রক্তাক্ত হয়ে গেছে। এমন ভয়ানক ঘটনা দেখেও আড়ালের মা নির্বিকার ভঙ্গিতে কেমন ঘোর লাগা ভাব নিয়ে বললেন,
" ও আমার মেয়ে নাহ। না না ও আমার মেয়ে না। ও মরে যাক। আসাদ ভালো। হ্যাঁ আসাদ আসাদ। ওকে আমার চোখের সামনে থেকে সড়াও। ও আমার মেয়ে না। নিশ্চয়ই কিছু ভুল করেছে এই মেয়েটা। তাই আসাদ ওকে শাস্তি দিচ্ছে। ও আমার মেয়ে না, ও বাজে, ও অপয়া।"
কথাগুলো একদমে বলে খুশিকে হাত দিয়ে সড়িয়ে দিয়ে আড়ালের মা নিজের ঘরের দিকে চলে যায়।
প্রচন্ড ব্যাথায় আড়াল যেন কাঁদতেও ভুলে গেছে। আড়াল বুঝতে পারছিলো তার মা সেন্সে নেই, তবুও কোনো রকমে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে মাকে আটকাতে চায়। কারণ মা চলে গেলে আজ বাবা হয়ত তাকে মেরেই ফেলবে।
ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে কোনো রকমে দাঁড়াতে যাবে অমনি বাবা আবারও হাতের কাছে একটা লাঠি তুলে নিয়ে আঘাত করে। টাল সামলাতে না পেরে ফ্লোরে ছড়িয়ে যাওয়া নিজের রক্তেই নিজে স্লিপ করে পরে গিয়ে সেন্সলেস হয়ে একরকম সে যাত্রায় বেঁচে যায় আড়াল। যখন জ্ঞান ফেরে তখন নিজেকে ব্যান্ডেজে মোড়া অবস্থায় হাসপাতের বেডে দেখতে পায়।
খুশির কাছ থেকে শুনেছিলো পাশের বাড়ির এক আন্টি জোড়ে আওয়াজ শুনে দেখতে এসেছিলো কি হয়েছে, পরে আড়ালকে রক্তাক্ত অবস্থায় ফ্লোরে পরে থাকতে দেখে খুশিকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করায়।
পরে অবশ্য বাবাই সব ব্যাবস্থা করেছিলো। শুধু আড়ালকে শক্তভাবে বলে গেছিলো সে দোষ করেছে তাই শাস্তি পেয়েছে। এটা যেন নানুকে সে না জানায়।
এরপর শারীরিক ভাবে সুস্থ হলেও মানসিক ভাবে সুস্থ হতে বেশ সময় লেগে যায় আড়ালের।
ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে কলেজে ভর্তি হয়। জান লাগিয়ে লেখাপড়া করে। যতটা সম্ভব বাবাকে এড়িয়ে চলা শুরু করে। কিন্তু তবুও সুযোগ পেলেই বাবা আড়ালের গায়ে চড় থাপ্পড় এমনকি হাতের কাছে স্কেল কিংবা লাঠি দিয়েও মারতো।

এক টুকরো মেঘ (Completed✔)Where stories live. Discover now