#এক_টুকরো_মেঘ
#মেহেরুন_নেছা_হিতৈষীপর্ব ২৪
♣
ডা. জামিল! বয়স ৩৫ থেকে ৪০ এর মাঝামাঝি হবে। মাথায় কাচা পাকা চুল। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। পরনে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি। নিজের কেবিনের সামনে আড়ালকে উদ্ভ্রান্তের মত বসে থাকতে দেখে নিজেই হাত বাড়িয়ে তুলে কেবিনের ভেতরে সোফায় বসালেন। নিজের টেবিলের উপরে রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে আড়ালের দিকে ধরলেন।
" পানিটা খাও মা।"
আড়াল যেন হঠাৎই জামিল সাহেবের মা ডাকে একটু ভড়কে গেলো। কোনো রকমে চোখ জোড়া উপরে তুলে তার দিকে তাকালো।
" আমি ডা. জামিল মহসিন। "
আড়াল তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে এক চুমুকে সবটুকু পানি শেষ করে খালি গ্লাস ফিরিয়ে দিয়ে আবার মাথা নিচু করে বসে রইলো। জামিল সাহেব খালি গ্লাস টেবিলে রাখতে রাখতেই আগ্রহ নিয়ে আড়ালকে প্রশ্ন করলো,
" তুমি কি মুবাশ্বিরা জান্নাত? বই মেলায় তো তোমার বই বেরিয়েছে এবার তাই না? আমি আবার বইটই তেমন পরি না। আমার মেয়ে পরে বুঝলে মা।"
" আমার শারারের কী হয়েছিলো?"
আড়ালের যেন জামিল সাহেবের তাকে নিয়ে বলা কথাগুলো কানেই পৌঁছায় নি। আড়ালের প্রশ্ন শুনে জামিল সাহেব একটা চেয়ার টেনে আড়ালের সামনে বসতেই আড়াল চোখ মেলে তাকালো।
" প্লিজ বলবেন! আমার শারারের কী হয়েছিলো?"
জামিল সাহেব বেশ শান্ত স্বরে জবাব দিলেন,
" ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ।"
আড়াল একটু চমকে উঠলো।
" মানে?"
" এটা একটা হার্টের অসুখ। মাত্রাতিরিক্ত ড্রাগ নেওয়া, স্ট্রেস, প্রেশার নেওয়া, উচ্চ রক্তচাপ, ধুমপান এসবের কারণে হয়ে থাকে। এছাড়াও মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে গেলে এবং পাশাপাশি প্রচন্ড রকমের মানসিক চাপে থাকলে এরকমটা হয়। এটার কিছু ধরন আছে। ছেলেটার ভাগ্য খারাপ ছিলো। অসময়ে চলে গেলো...."
চলে যাওয়া শব্দটা যেন আড়াল মেনে নিতে পারলো না। চোখগুলো বড় করে ডাক্তারের দিকে তাকালো।
" শারার কখনো স্মোক করতো না। এসব কি বলছেন কি আপনি! আর ড্রাগ? এসব হতেই পারে না। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।"
আড়ালের উত্তেজিত অবস্থা জামিল সাহেব বুঝতে পারলেন। আড়ালের মাথায় হাত রেখে বললেন,
" শান্ত হও মা। তুমি আমার মেয়ের বয়সী। আমাকে সময় দাও। আমি সবটা বলছি তোমাকে।"
আড়াল ডাক্তারের কথাটা শুনে যেন একটু শান্ত হয়ে বসলো।
" ছেলেটার পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে আমি শুনেছি বছর চার পাঁচেক আগে ছেলেটাকে কোনো ভাবে ড্রাগ দেওয়ানো হয়েছিলো তাও খুব খারাপ মাত্রায়। মেন্টাল প্রেসার, শারিরীক ভাবেও নাকি খুব বাজে অবস্থা ছিলো। সেই সময় ও যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলো সেখানে ওর ট্রিটমেন্ট সেভাবে হয়নি কারণ তখন হাসপাতালে ভালো ডাক্তার ছিলো না। ওর সমস্যাটা ক্রনিক টাইপ ছিলো তাই ওইসব ডাক্তার সেটা বুঝতেও পারেনি। শুনেছি ওই ঘটনার পর থেকে ছেলেটা মেন্টালি খুব ডিপ্রেসড থাকত এবং ছেলেটা চেইন স্মোকার। প্রায়ই শারীরিক ভাবে ব্যাথা অনুভব করলেও ডাক্তারের কাছে যেতে চাইতো না। ফলাফল ধীরে ধীরে রোগটা বাড়তেই থাকে। আর শেষ পর্যন্ত এমন একটা সময়ে ওকে এখানে নিয়ে এলে যখন আর করার কিছুই নেই। ভেতর থেকে ওর অনেক ড্যামেজ হয়ে গিয়েছিলো। তাই সামান্য ধ্বাক্কাও আর নিতে পারেনি হয়ত। "
আড়াল যেন চোখে অন্ধকার দেখতে। চোখ উপচে পানি পড়ছে। কোনো রকমে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। নিঃশব্দে ডাক্তারকে কিছু না বলেই কেবিন থেকে বেড়িয়ে এলো। তার মাথায় এখন অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। টলতে টলতে একপা দু পা করে আবার কেবিনের সামনে এসে দাঁড়ালো আড়াল। কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াতেই সকলের কান্নার আওয়াজ কানে গেলো তার। আস্তে আস্তে কেবিনের ভেতরে ঢুকে পড়লো।
আড়ালকে দেখতে পেয়েই আবির আনাবিয়া একটু সড়ে দাঁড়ালো। আড়ালকে দেখে একে একে সকলে সড়ে দাঁড়াতেই আড়াল ধীর পায়ে কেবিনের ভেতরে শিহাবকে বেডে শুয়ে থাকতে দেখলো।
শিহাবের নিথর দেহটা পরে আছে। পাশে তার বিয়ে করা বউ রুকাইয়া ভীষণ জোরে জোরে কান্না করছে। আড়াল নিঃশব্দে গিয়ে শিহাবের মাথার কাছে বসে পড়লো।
আড়ালকে বসতে দেখেই রুকাইয়া যেন আড়ালকে একটু জায়গা করে দিয়ে নিজের চোখে জমে থাকা পানিটুকু মুছে ফেললো। আড়াল শিহাবের মাথার উপর ঝুকে জোরে জোরে বলতে লাগলো,
'' আমি তো চেয়েছিলাম তোমার তুমি হতে শারার। তুমিই তো আমাকে গল্প লিখতে শিখিয়েছো। আমি তো আমাদের গল্পটাই লিখতে চেয়েছিলাম আজীবন। আমাদের!
যে গল্পে তুমি এবং আমি মিলে হব আমরা। কিন্তু তুমি! তুমি তো এই আমিটাকে একদম একা করে দিয়ে নিজে অন্য কারো তুমি হয়ে ওপারে চলে গেলে৷ এখন আমি কি নিয়ে বাঁচবো বলতে পারো? আমি তো শুধু.... শুধুমাত্র তোমার তুমি হয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। তবে কেন তুমি যাওয়ার আগে আমাকে এভাবে অন্যের করে দিলে! কেনো?
আমার এত খেয়াল কেনো রাখো তুমি? যাওয়ার আগেও শুধু আমার ভালো থাকাটাই তোমার নজরে এলো? এভাবে আমাকে একা করে দিয়ে কেনো চলে গেলে শারার! একবার তো সবটা আমাকে জানাতে পারতে। একটা বার! কেনো শুধু আমার ভালোটাই দেখলে। কেনো আমার ভালো দেখতে গিয়ে সবটুকু কষ্ট বুকে নিয়ে চলে গেলে? কেনো এভাবে আমাকে একা করে দিলে শারার! ''
" ও আপনাকে একা করে দিয়ে যায়নি আড়াল। ও সবসময় আপনার সাথে, আপনার মাঝেই থাকবে। আর ও শুধুই আপনার তুমিই ছিলো। আমি তো ওর পাশে একজন বন্ধু হয়ে থাকার চেষ্টা করেছি মাত্র৷ পেরেছি কিনা জানি না। আর যাওয়ার আগে ও আপনাকে অন্যের করে দিয়ে যায়নি৷ শুধু আপনার পাশে আবির ভাইয়ার মত একজন শুদ্ধ বন্ধুকে দেখতে চেয়েছে। যে আপনাকে ওর মতই খেয়াল রাখবে....."
রুকাইয়া আড়ালের কাঁধে হাত রেখে বলে যাচ্ছে,
" ও যে আপনাকে বড্ড বেশিই ভালোবাসে৷ আমি ওর স্ত্রী হতে পারি। কিন্তু কখনো ওর অর্ধাঙ্গিনী হতে পারিনি। অর্ধাঙ্গিনী তো সেই হয় যার সাথে মনের সবটুকু সুখ সবটুকু দুঃখ সবটুকু ভালোবাসা উজার করে দেওয়া যায়। এক ছাদের তলায়, এক বিছানায় থেকে সংসার করলেই কি মনের আপন মানুষ হওয়া যায়? হওয়া যায় না। আবার খুব দূরে থেকেও শুধুমাত্র ভালোবাসার জোরেই মনের খুব কাছে থাকা যায়৷ শিহাবকে ভুল বুঝবেন না আড়াল। ছেলেটা যে আপনাকে বড্ড বেশিই ভালোবাসতো। ওর আত্তাও হয়ত কখনো আপনাকে ভালোবাসা বন্ধ করতে পারবে না। "
রুকাইয়ার কথাগুলো যেন আড়ালের কানে নয়, একদম মনের ভেতরে গিয়ে বাজলো। দুইজন নার্সকে ভেতরে আসতে দেখে আড়াল নিঃশব্দে কেবিন ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে একটা সিটে গিয়ে বসলো। কেবিনের বাইরে বসতেই আড়াল লক্ষ করলো তার পাশের সিটে শিহাবের বাবা বসে আছেন। এতগুলো বছর পর দেখা, তবুও চিনতে আড়ালের এতটুকুও কষ্ট হলো না। ছেলের শোকে পাগল প্রায় অবস্থা লোকটার। মাহবুবুল আলম খান আড়ালকে দেখেই চমকে উঠলেন। ভাঙা গলায় বললেন,
" মা তুমি!"
আড়াল কাঠকাঠ গলায় জবাব দিলো,
" ও আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো আংকেল। শারার আমাকে মিথ্যে বলে চলে গেলো। "
মাহবুবুল আলম খান লক্ষ্য করলেন আড়ালের চোখ শুকনো। মেয়েটা কাঁদছে না। আড়ালকে এরকম অদ্ভুত রকম শক্ত দেখে মাহবুবুল আলম খান বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
" মা তুমি কাঁদছো না কেনো? কাঁদো মা। হালকা লাগবে। "
মাহবুবুল আলম খান ঝরঝর করে কেঁদে উঠলেন। কিন্তু আড়াল আগের মতই রইলো।
" ও আমাকে মিথ্যে বলে কথা আদায় করে নিয়ে চলে গেছে। আমি কাঁদবো না। আমি একটুও কাঁদবো না।"
দূর থেকে আবির এবং আনাবিয়া আড়ালের এমন ভেঙে পরা অবস্থা দেখে মনে মনে ভয় পেলো।
" ভাইয়া! আড়াল আপু ঠিক আছে তো? অমন করছে কেনো? আপু কাঁদছে না কেনো ভাইয়া?"
আবির নিজের বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। আনাবিয়া বাচ্চাদের মত করে কাঁদছে। আবিরও কাঁদছে।আড়াল বসা থেকে উঠে হাসপাতালের বাইরে চলে এলো। ভোর হয়ে আসছে। আকাশে আবারও মেঘ ডাকছে।
আকাশে পাখিরাও কেমন অদ্ভুত ভাবে কিচিরমিচির করছে। আড়ালের যেন মনে হলো পাখিরাও কাঁদছে। প্রকৃতিও কাঁদবে। আজ যেন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে। একটু পরেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। আড়াল আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবলো,
" কাঁদো। তোমরাও কাঁদো। আজ সবাই কাঁদবে। আজ শুধু আমি কাঁদবো না। একটুও না..."( চলবে...)
VOUS LISEZ
এক টুকরো মেঘ (Completed✔)
Roman d'amourকয়েকটি জীবনের চড়াই-উতরাই, হাসি কান্না, সুখ দুঃখের কাহিনী নিয়েই লেখা #এক_টুকরো_মেঘ