#এক_টুকরো_মেঘ
#মেহেরুন_নেছা_হিতৈষীপর্ব ১৭
♣
বাড়ি ফেরার পর থেকে আড়াল পাগলের মত কেঁদেই চলেছে। খুরশিদা বেগম অনেক চেষ্টা করেও মেয়েকে কিছুই খাওয়াতে পারেননি। সকাল গড়িয়ে দুপুর প্রায় শেষ হতে থাকলো। আড়াল ধীরে ধীরে কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। খুরশিদা বেগম নাতনীর এমন অবস্থা দেখে প্রায় দিশেহারা হয়ে যাচ্ছেন।
এনজিওতে আড়াল কাঁদতে কাঁদতে একবার শুধু শারার নামের কারো কথা বলেছিলো। এরপর দৌড়ে গাড়িতে উঠে বসে। খুরশিদা বেগম দেরি না করে নাতনীকে বাড়িয়ে নিয়ে আসেন। গাড়িতে সারা রাস্তায় আড়াল একটি কথাও বলেনি। আর বাসায় আসা থেকে একাই কেঁদে যাচ্ছে।
খুরশিদা বেগম নাতনীর কাছে এসে আলতো হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই আড়াল তার কোলের ভেতরে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো৷ নিজে নিজেই হঠাৎ কথা বলতে শুরু করলো।
শারার কে, কিভাবে শারারের সাথে পরিচয়, একসাথে স্টেজে অনুষ্ঠান করা, ধীরেধীরে একে অপরকে ভালোলাগা, ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা, শারারের জন্য রান্নাবান্না করা, লুকিয়ে বইমেলায় যাওয়া, কবিতা শোনা.. একে একে সবটা বললো আড়াল।
খুরশিদা বেগম অবাক হয়ে শুনছেন, তার ছোট্ট নাতনীটা কবে এত বড় হয়ে গেলো।
আড়াল আপন মনে বলেই চলেছে।
" তারপর একদিন শারার আমাকে ওর বড় চাচ্চুর কথা জানালো। ওনার জীবনে ঘটে যাওয়া এক দুর্ঘটনার পর থেকেই উনি মানসিক ভাবে অসুস্থ। "
একটু থেমে দম নিলো আড়াল। তারপর আবার শুরু করলো,
" একদিন আমি ওর সাথে ওদের বাসায় গেলাম শারারের বাবার সাথে দেখা করবো বলে। জানো নানু! মায়ের একটা শাড়ি আছে আমার খুব পছন্দের। কিন্তু জানি না কেনো মা সেই শাড়িটা কখনো কাউকে ধরতে দিতো না। শুধু মাঝেমধ্যে বের করে নিজেই কি কি যেন বিড়বিড় করতো। যেদিন প্রথম শারারদের বাড়ি যাবো, মা কিভাবে কি যেন বুঝে গেলো। আমি শুধু কোনোরকমে জানিয়েছিলাম একটু বের হবো, একটু শাড়ি পরে যাবো। আর মা আমাকে ওমনি মায়ের সেই শাড়িটা বের করে নিজের হাতে আমাকে পরিয়ে দিলো। আমি তো ভীষণ অবাক। এখন একটু বুঝি, সেবার অবশ্য বাবা মানে মিস্টার আসাদুজ্জামান খন্দকার বাড়ি ছিলেন না কদিনের জন্য। সে যাকগে,
ওদের বাড়ি গিয়ে সব ঠিকঠাকই চলছিলো। শারারের বাবা মাহবুবুল আলম খান আমাকে বেশ পছন্দ করলেন। কথায় কথায় আমার বাবা মায়ের নাম শুনেই তিনি কেমন একটা আতকে উঠলেন। আমাকে দ্রুত বাড়ি চলে আসতে বললেন আর জানালেন এই বিয়ে নাকি সম্ভব না। আমি ভীষণ ভেঙে পড়লাম। শারারও ভীষণ অবাক। কোনো রকমে বাড়ি থেকে বের হবো ওমনি শারারের বড় চাচ্চুর সাথে দেখা। লাইফে প্রথমবার কোনো মানসিক রোগীর সামনে পরে গেছিলাম। খুব ভয় পেয়েছিলাম কিন্তু অবাক করার মত বিষয় উনি আমাকে ধরে মা মা বলে কাঁদতে শুরু করলেন। আমি কিছুই বুঝছিলাম না কি হচ্ছিলো। এরপর শারারের বাবা এসে ওর চাচ্চুকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলো।''
আড়াল থামতেই খুরশিদা বেগম একটু নড়েচড়ে বসলেন।
" কোন শাড়ির কথা বলছিলি বলতো! রেবেকা তো সেভাবে শাড়ি পররো না বেশি। তাহলে...!"
" ওইযে... কচিপাতা রঙের সবুজ জামদানী একটা শাড়ি। আমার ভীষণ পছন্দের শাড়িটা। এত সুন্দর ইউনিয়ক ডিজাইনের শাড়ি আমি খুব কম দেখেছি। গাঢ় সবুজ আর কচিপাতা সবুজের কম্বিনেশনে... "
খুরশিদা বেগম যেন খানিকটা চমকে উঠলেন শাড়ির বিবরণ শুনে। আড়াল বোকাবোকা মুখ নিয়ে নানুর দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে খুরশিদা বেগম নিজে থেকেই মুখ খুললেন,
" ওটা তোর মায়ের বিয়ের শাড়ি ছিলো আড়াল।"
আড়াল যেন একের পর এক চমক পাচ্ছে। চোখ দিয়ে পানি টুপটুপ করে গড়িয়ে পড়ছে। খুরশিদা বেগমের চোখও পানিতে ছলছল করছে।
" তোর মাকে যখন বাড়ি নিয়ে আসি, তোর মা শুধু ওই একটা শাড়িই সাথে এনেছিলো। একদিন আমাকে ডেকে বলেছিলো, এই শাড়িটা যেন কখনো ওর থেকে আলাদা না করি। মাহেদের ওই একটা জিনিসই রেবেকার কাছে ছিলো। শুনেছি খুব খুঁজে খুঁজে যত্ন করে নিজের বৌয়ের জন্য শাড়িটা কিনেছিলো মাহেদ। "
" তবে কি.... তবে কি এতবছর পরেও বাবা সেই শাড়িটা চিনতে পেরেছিলো নানু?"
আড়াল আবারও ডুকরে কেঁদে উঠলো।
" আমার বাবা! আমার বাবা আমাকে চিনতে চেয়েছিলো। অথচ আমি.... "
আড়ালের কথা কেমন জড়িয়ে আসছে। আড়াল কেঁদেই চলেছে। খুরশিদা বেগম এর মাঝেই চট করে খুশিকে দিয়ে হালকা নাস্তা বানিয়ে এনে আড়ালকে কথার ছলে অল্প একটু খাইয়ে দিয়েছে।
কিছুক্ষণ সময় দিয়ে খুরশিদা বেগম আবার আড়ালের দিকে মুখ তুলে তাকালেন।
" সবই তো বুঝলাম। একটা কথা বল! তোদের বিয়ে নিয়ে ঠিক কি হয়েছিলো? তুই তো আমাকে কিছুই বলিস নি তখন।"
আড়াল আলতো হাতে নিজের চোখমুখ মুখে নিলো৷ আধশোয়া থেকে উঠে বসে নানুর মুখোমুখি হয়ে নিলো।
" আমিও ঠিক জানি না নানু। শারারকে খুব বুঝালাম আমি ওকে ছাড়া বাঁচবো না। শারারও সেটা জানতো। শারার ওর বাবাকে বুঝিয়ে সিদ্ধান্ত নিলো আমাদের বাসায় প্রস্তাব পাঠাবে। যদি সবাই মেনে নেয় বিয়ে হবে। আমি ইনিয়েবিনিয়ে মা কে খুব বুঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু মা তখন পাগল প্রায়। এর মাঝেই ওর বাবা আমাদের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলো। বাবা সবার সাথে বেশ ভদ্র আচরণ করলো। সব ঠিকঠাক ছিলো, আমি ভেবেছিলাম এবার হয়ত সব ভালো হতে চলেছে, কিন্তু.... "
" কিন্তু?"
খুরশিদা বেগমের একটু ভয় ভয় করতে লাগলো। না জানি আবার কোন দুর্ঘটনার কথা জানতে পারবে। মেয়েটার জীবনে এত কষ্ট যে কেনো.।।
" ওরা চলে যেতেই বাবা মাকে নিয়ে ঘরে চলে গেলো। জানি না বাবা মাকে কি বললো, তারপর হঠাৎই মা খুব উদ্ভ্রান্তের মত আচরণ করতে থাকলো। হঠাৎই আমার রুমে এসে আমাকে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করলো। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। মা যেন কি সব উল্টোপাল্টা বলছিলো। খুশি এসে কোনো রকমে মাকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। এরপর বেশকিছুদিন আমি কেমন যেন হয়ে যাচ্ছিলাম। শারারও আমার সাথে কোনো যোগাযোগ করছিলো না। আমি প্রায় পাগলের মত হয়ে যাচ্ছিলাম। ওদিকে আবির ভাইয়াও তখন দেশে নেই। কোনোরকমে আবির ভাইয়ার মাকে সবটা জানালাম। এরপর কিছুদিন পরেই দেখলাম বাবা মানে আসাদুজ্জামান খন্দকার একদম স্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করলেন। শারার আমাকে একদিন হঠাৎ কল করে জানালো আমাদের বিয়ে হচ্ছে। কিভাবে কি কিছুই বললো না। শুনলাম একদম ঘরোয়া ভাবে আমাদের বিয়েটা হবে। খুব অল্প মানুষ জানবে। তুমি দেশে ফিরলে নাকি বড় অনুষ্ঠান হবে।"
আড়াল থামতেই খুরশিদা বেগম জিজ্ঞাসা করে বসলেন,
" তা-তারপর?"
" বিয়ের দিন শারার আসেনি নানু। আসেনি.... "
আড়াল আবারও হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। খুরশিদা বেগম আরো একবার নাতনীকে ভেঙে পরতে দেখলেন। মনে মনে নিজেও কুকড়ে গেলেন। ভাবতে গিয়ে নিজেও শিউরে উঠলেন, যে মেয়েটার আদরে মুরে থাকার কথা ছিলো সেই মেয়েটার এই অল্প জীবনে একের পর এক সমস্যা, বাধা, কষ্ট এসেই চলেছে।
কোনো রকমে নাতনীকে সান্ত্বনা দিলেন। খুশিকে ডেকে জগ ভর্তি পানি ঘরে আনিয়ে নিলেন। নাতনীকে এক গ্লাস পানি খাইয়ে একটু ধাতস্থ হওয়ার সময় দিলেন।
" বিয়ের দিন আমি খুব শখ করে সেজেছিলাম। আবির ভাইয়ার মা বিয়ের দিন সকাল থেকেই আমার সাথে ছিলো। আংকেল আর আনাবিয়া অবশ্য আসেনি। খুশি খুব আনন্দের সাথে রান্নাবান্নার তদারকি করে যাচ্ছিলো। সায়মাপুও অনেক খুশি ছিলো। মা যদিও আমার কাছে ছিলো না। নিজের মতই ছিলো নিজের ঘরে। বাবাকে দেখে মনে হচ্ছিলো বাবা সবটাই মেনে নিয়েছে খুব খুশি মনে। কিন্তু.....
দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে রাত...
শারার আসেনি নানু! আমাকে একটা ফোন পর্যন্ত করেনি। আমার তখন পাগল প্রায় অবস্থা। হাউমাউ করে কাঁদছি। আশেপাশে চেনা পরিচিত অনেককে কল করেছিলা কিন্তু কেউ ওর কোনো খোঁজ খবর জানে না। সেদিন রাতটা আমি কিভাবে পার করেছি আমি জানি না। বাবা ধীরে ধীরে আবার আগের মত হয়ে উঠলো। আমাকে খুব বকলো এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তে। আবির ভাইয়ার মা আমাকে অনেক ভাবে সান্ত্বনা দিতে থাকলো কিন্তু আমার তখন সেসব দিকে কোনো খেয়াল নেই। আমি ভাবছিলাম ওর কোনো বিপদ হয়নি তো। এভাবে আমাকে না জানিয়ে কোথাও পালিয়ে যাওয়ার মত ছেলে শিহাব শারার খান নয়।"
আড়াল হঠাৎ থেমে যাওয়ায় খুরশিদা বেগম জিজ্ঞাসা করলেন,
" ছেলেটাকে খুঁজিস নি? এভাবে কেউ কিভাবে হারিয়ে যাবে? কিছু জানতে পারিস নি?"
" প্রথম দিকে খুব ভেঙে পরেছিলাম৷ দুই একদিন পরে মনে পড়লো আমি ওর বাড়ি চিনি। ওমনি সেখানে খোঁজ করতে চলে গেছিলাম কিন্তু সেখানে গিয়ে জানলাম আমাদের যেদিন বিয়ে হবার কথা ছিলো, তারও দুদিন আগে থেকে ওদের কেউ এখানে থাকে না। এরপর শারারের ফোনে অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওদের সব নাম্বার বন্ধ। "
" তারপর? "
" ওকে খুঁজতে আসার খবর কিভাবে যেন বাবা জেনে গেলো। আমাকে বাসায় নিজের রুমে বন্দী করে ফেললো। আমি তখন নিজের শোক দুঃখ আর ভয়ে একাকার। একটা রুমে বন্দী থাকতে থাকতে একটা সময় শারারকে কল্পনা করতে থাকলাম। এরপর প্রায় পাগলই হয়ে গেছিলাম, হঠাৎ কিভাবে যেন সায়মাপু এলো, ডাক্তার আংকেল এলো, আমার চিকিৎসা হলো আর আপাতত আমি মেন্টালি তখনকার চেয়ে অনেকটা সুস্থ। "নাতনীর মুখ থেকে ভয়াবহ সব কথা শুনে ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠলেন খুরশিদা বেগম। সব কথা শুনে মেয়েটাকে নিজের কোলে নিয়ে আলতো হাতে আদর দিতে থাকলেন। প্রচন্ড ক্লান্ত থাকায় আড়াল নানুর কোলেই ঘুমিয়ে পরে।
কিন্তু খুরশিদা বেগমের মাথায় তখন সম্পূর্ণ অন্য চিন্তা ঘুরছে।
" সব কিছু জেনেও আবির কেনো আড়ালকে বিয়ে করতে যায়? শারার ছেলেটা যদি আবিরের এত ভালোই বন্ধু হয়ে থাকে তাহলে কেন আড়ালকে কোনো ভাবে সাহায্য করেনি। কেনই বা আবিরের বাবা আএ বোন বিয়েতেও আসেনি? এসবই কি শুধুই কাকতালীয়! নাকি এর পেছনে অন্য কোনো রহস্য আছে?"
খুরশিদা বেগম মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন এবার আর কোনো ভুল তিনি করবেন না। নিজের মেয়ের সাথে যে ভুল একবার করেছেন, নাতনীর সাথে তেমন কিছুই হতে দেবেন না। সব রহস্যের সমাধান এবার তাকে করতেই হবে। নাতনীর সুখের জন্য হলেও তাকে সবটা গুছিয়ে তুলতে হবে.. হবেই!( চলবে...)
YOU ARE READING
এক টুকরো মেঘ (Completed✔)
Romanceকয়েকটি জীবনের চড়াই-উতরাই, হাসি কান্না, সুখ দুঃখের কাহিনী নিয়েই লেখা #এক_টুকরো_মেঘ