পর্ব-১৭

447 5 0
                                    

আগের পর্বের পর....

চন্দ্রালোকিত সমুদ্রতটে বসে আছে অরণ্য আর কথা। 
দূরের দিগন্তে যেখানে সমুদ্র আর আকাশ একসাথে মিশে গেছে সেইখানে চাঁদের আলো সমুদ্রের জলের ওপর পড়ে ছোটো ছোটো সোনার টুকরের মতো ঝিকমিক করছে। সেদিকেই তাকিয়ে আছে অরণ্য।
কথা এখনো  ওর বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে চলেছে। ওর চোখের জলের উষ্ণধারা অরণ্যর শার্ট ভেদ করে ওর উন্মুক্ত বুকে স্পর্শ করছে। অন্যদিন হলে অরণ্য বকে ধমকে কিংবা ভালোভাবে বুঝিয়ে কথার কান্না থামানোর চেষ্টা করতো কিন্তু আজ ও সেই চেষ্টা করছেনা। কারণ অরণ্য চায় আজ কথার চোখের জলের মধ্যে দিয়ে ওর মনে অরণ্যের প্রতি এই বারো বছর ধরে জমে থাকা সমস্ত অভিমান যেন বেরিয়ে আসে।
.
.
.
কতোটা সময় পেরিয়ে গেছে তা অরণ্যর জানা নেই। কথার কান্না বেশকিছুক্ষন আগে থেমে গেছে। ও এখন অরণ্যের বুকে মাথা রেখে ওকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে বসে আছে।
জনকোলাহল বিহীন আলোছায়া মাখা সমুদ্রতটের ওপর দিয়ে বয়ে চলা বাতাসের আওয়াজ আর সামনের তটের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া সমুদ্র স্রোতের গর্জন আর সাথে প্রিয় নারীটির নিবিড় সান্নিধ্য সবমিলিয়ে এতক্ষন ধরে মোহাবিষ্ট হয়েছিল অরণ্য এইসময় রূপকথার গলার মিহিসুর কানে আসায় ধ্যান ভাঙলো অরণ্যর।
.
.
.
"কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া
তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া
কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া
তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া

চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি
গোপনে তোমারে, সখা, কত ভালোবাসি...."

দূরের সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে একমনে গুনগুন করে চলেছে কথা। চাঁদের আলোয় সিক্ত হচ্ছে ওর সমস্ত শরীর, দামাল হাওয়ার স্পর্শে খোলাচুলগুলো এলোমেলো হয়ে পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে পাশে বসে থাকা অরণ্যের মুখে। আজ মেয়েটাকে বড্ড মোহময়ী মনে হচ্ছে ওর।
.
.
.
সাত সুরের মায়াজালে কথা এতোটাই হারিয়ে গিয়েছিল যে অরণ্য ইসৎ নীল চোখেজোড়া সেই কখন থেকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তা খেয়ালই হয়নি।এখন গান বন্ধ করে অরণ্যের দিকে তাকাতেই শিহরিত হলো কথা। প্রেমিক পুরুষের এই দৃষ্টি যেমন তার মনে থাকা মুগ্ধতাকে প্রকাশ করে তেমনি অপ্রাকৃত সুখের হাতছানিও দিয়ে যায়। বেশিক্ষন অরণ্যের চোখের দিকে তাকাতে পারলোনা কথা। লজ্জায় গাল লাল হয়ে এলো ওর।
-আমার রূপ এতো ভালো গান করে অথচ আমিই জানিনা।
ধীর কণ্ঠে বললো অরণ্য।
-আপনি কখনো জানতে চেয়েছিলেন?
কথার গলার স্বরে অভিমানের আঁচ পাওয়া গেলো। সেটা বুঝে নিয়েই অরণ্য বললো
-হুম সেটা অবশ্য ঠীক। কিন্তু এখনো আপনি বলবে? আচ্ছা বুঝেছি আমার ওপর থাকা অভিমানটা তাহলে এখনো পুরোপুরি মুছে জায়নি।
অরণ্যের কথায় ঠোঁট ওল্টালো কথা। সেটা দেখে অরণ্য হাসতে হাসতে বললো
-না তুমিতো দেখছি সেই বারো বছর আগের ছোট্ট কথাটিই রয়ে গেছো। তার মতোই কোনো কথা পছন্দ না হলে ঠোঁট ওল্টাও, রাগ হলে গাল ফুলিয়ে বসে থাকো আর কেউ বকলেই ব্যাস ওমনি ভ্যাঁ ভ্যাঁ শুরু।
-উঁ আমি মোটেও ছোটো নেই মিস্টার বিশ্বাস। আমি এখন এ. বি ইন্ডাস্ট্রিসের সিইওর এক্সেকিউটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট কত দায়িত্ব জানেন আমার কাঁধে।
ঠোঁট ফুলিয়ে বললো কথা। ওর কথার মধ্যে থাকা বাচ্ছামিটার আভাস পেয়ে অরণ্য হো হো করে হাসতে হাসতে বললো
-ওলে বাবলে সরি সরি আমারই খেয়াল রাখা উচিত ছিল রূপ এখন অনেক বড়ো হয়ে গেছে নিজের বসের সাথে কতো দায়িত্ব সামলাচ্ছে। না না এই ব্যাপারে আমি আর একটাও কথা বলবোনা। হয়েছে তো শান্তি।
চলো এবার রিসর্টে ফিরে যাই।
কথাগুলো বলে অরণ্য উঠতে গেলে ওর হাত টেনে ধরলো কথা। তারপর জেদি স্বরে বললো
-আগে বলো কোম্পানি জয়েন করার আগের দশটা বছরে তুমি একবারও আমার খোঁজ নাওনি কেন তারপর আমি তোমাকে যেতে দেবো।
-সেটাতো রিসর্টে ফিরেও বলা যাবে। এখন উঠে পড়ো অনেকটাই রাত হয়ে গেছে।
-না যাবোনা আর তোমাকেও যেতে দেবোনা আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। কেন তুমি কথা দেওয়া সত্ত্বেও আমাকে খুঁজে নাওনি?
কথার এরকম শিশুসুলভ জেদি একগুঁয়ে ব্যবহার দেখে হাসি পেয়ে গেলো অরণ্যের। তাই আর বিনা বাক্যব্যায়ে কথার পাশে বসে পড়লো। তারপর একহাত দিয়ে কথাকে জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে এনে বললো
-এরকম নয় যে আমি তোমাকে খোঁজার চেষ্টা করিনি। কিন্তু সময় আমাদের সাথে তখন এমন খেলা খেলছিল যে আমি চেষ্টা করেও তোমাকে খুঁজে পাইনি।
-মানে?
-আসলে বারো বছর আগে যখন আমাদের দেখা হয়েছিল তখন ওই কয়েকটা দিনের সান্নিধ্যেই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম আমি। হ্যাঁ হয়তো অবিশ্বাস্য শোনাচ্ছে কথাটা কিন্তু এটাই সত্যি। যখন তোমার প্রতি নিজের ফিলিংসটা বুঝেছিলাম তখন আমিও অবাক হয়েছিলাম। যেই আমি অলওয়েজ ক্যারিয়ার ফোকাসড থেকেছি, স্কুল কলেজ জীবনে আসা সমস্ত প্রপোসালকে অম্লান বদনে ফিরিয়ে দিয়েছি, যার কাছে প্রেম ভালোবাসা নামক সেন্টিমেন্টগুলো সমস্ত জাস্ট টাইম ওয়েস্ট লাগতো সেই আমি কিনা শেষ পর্যন্ত একটা পুচকির প্রেমে পড়লাম!! বাট কথাতেই আছে প্যায়ার এক এসি বিমারী হে যো কাব কিসকো হোজায় পাতা নেহি চলতা। এন্ড রিয়েলি দ্যাট'স হ্যাপেনস উইথ মি। তাইতো ফিরে আসার আগে পুচকিটাকে প্রমিস করে এসেছিলাম যে সে বড়ো হয়ে গেলে আমি তাকে ঠীক খুঁজে নিয়ে নিজের করে নেবো।
বাট দ্যাট ফাকিং টাইম প্লেস উইথ মি দেন।
তোমাকে যেদিন তোমার বাবা-মার কাছে পৌঁছে দিয়েছিলাম সেদিন আঙ্কেল মিন্স তোমার বাবা আমাকে তোমাদের বর্ধমানের বাড়ির এড্রেসটা দিয়েছিলেন, একদিন যেন তোমাদের বাড়ির আতিথেয়তা গ্রহণ করি সেই আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন।
জানো কলকাতা ফিরে অনেকবার ইচ্ছা হয়েছিল একবার ওই এড্রেসে যাই তোমার সাথে দেখা করে আসি। কিন্তু তাও নিজেকে কন্ট্রোল করেছিলাম কারণ তোমার সান্নিধ্যে গেলে আমি তোমার প্রতি নিজের ফিলিংসকে কিছুতেই লোকাতে পারবোনা। বাট তোমার কাছে ভালোবাসা প্রকাশের সঠিক সময় সেটা ছিলনা বিকস তুমি তখন অনেক ছোটো ছিলে তাই আমি যদি তোমাকে নিয়ে সেইসময় প্রেমের জোয়ারে ভাসতাম তাহলে ক্ষতিটা তোমারই হতো। এতে তোমার স্টুডেন্ট লাইফ এন্ড ফ্যামিলি লাইফ দুটোতেই ব্যাড এফেক্ট পরতো। যেটা কখনো আমার কাছে কাম্য ছিলনা।
তবে একেবারেই যোগাযোগ তুলে দেব সেরকম ইচ্ছা ছিলনা। তাই ঠীক করেছিলাম তোমার এইটটিন ইয়ার্স যতদিন না হচ্ছে তার আগের প্রতি বার্থডেতে  আমি কাউকে দিয়ে তোমাকে একটা প্রেসেন্ট পাঠাবো। আর আঠারোতমো জন্মদিনে আমি নিজে গিয়ে তোমাকে শুভেচ্ছা জানানোর সাথে সাথে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার কথা জানাবো। বাকি তুমি আমার হৃদয়কে স্বীকার করতে কী অস্বীকার সেটার ডিসিশন আমি অবশ্যই তোমাকে নিতে দিতাম। কিন্তু আমরা সবসময় যা চাই তাই কী হয়?
আমাদের দেখা হওয়ার আটমাস পরে আঠারো অক্টোবর ছিল তোমার ফোর্টিন্থ বার্থডে আমি অফিসেরই একজন স্টাফকে দিয়ে তোমার জন্য গিফ্ট আর একটা ছোট্ট নোট পাঠিয়েছিলাম কিন্তু জানা গেলো তোমরা দুমাস আগে মুম্বাইতে শিফ্ট করেছো। ওই কর্মচারীই তোমাদের এক প্রতিবেশীর থেকে আঙ্কেলের কোম্পানির নাম জেনেছিলো। আমি ঠীক করেছিলাম নিজে মুম্বাইতে গিয়ে তোমাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করবো কিন্তু সেই সময়ই আমার জীবনে ঝড় নেমে আসে।
একটা কার এক্সিডেন্টে হেভিলি ইঞ্জিওর হয়ে বাবা কোমায় চলে যায়। তখন বাবা কোম্পানির সিইও ছিল আর আমি ওনার অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে বাবার থেকে সমস্ত কাজ শিখছিলাম। সেইসময় ওতো বড়ো একটা এম্পায়ারের দায়িত্ব এসে পড়ে আমার মাথায়। অনেক ইনভেস্টর আমাকে ভরসা করতে না পেরে কোম্পানি থেকে নিজেদের শেয়ার সরিয়ে নেন। যার ফলে কোম্পানির মার্কেট ভ্যালু ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এ.বি ইন্ডাস্ট্রিস প্রায় ধ্বংসের মুখে ছিল তখন।
কতো সোকল্ড আপনজনের আসল চেহারা দেখেছিলাম তখন। যারা খুশির সময় আমাদের আশেপাশে ঘুরতো তারাই এই কঠিন সময়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো।
বাবার রক্তজল করে তৈরি করা কোম্পানি ধ্বংস হতে বসেছে অথচ আমি কিছু করতে পারছিনা। শুধু তাই নয় কোম্পানির হাজার হাজার স্টাফ আমার ওপর আশা করে বসে আছে, যদি কোম্পানিতে তালা পড়ে যায় তাদের কী হবে? নিজেকে সেইসময় বড্ড অযোগ্য মনে হচ্ছিলো। একবার তো ভেবেছিলাম সুইসাইড এটেম্প্ট করে এইসব থেকে নিজেকে মুক্ত করেনি।

অরণ্যর মুখে সুইসাইডের কথা শুনে রূপকথার বুকটা কেঁপে উঠলো। ও জাপ্টে ধরলো অরণ্যকে। অরণ্য হালকা হেসে রূপকথাকে নিজের আরও কাছে টেনে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো।

-সেইসময় চেনাপরিচিত সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলেও স্টাফেরা আমার থেকে মুখ ফেরায়নি তিনমাস ওদের স্যালারি দিতে পারিনি কিন্তু তাও ওরা কোনো ডিমান্ড না করেই কাজ করেছিল। এদের এতসুন্দর সহযোগিতাপূর্ণ ব্যবহার আমাকে মানসিকভাবে শক্ত হতে সাহায্য করেছিল সেদিন। রোশনি, রক্তিম আঙ্কেল, আমার মাসি-মেসো মানে সুমিতের বাবা মা এরা তো আমার পাশে সবসময়ই ছিলেন এছাড়াও বাবার শুভাকাঙ্খী কিছু ইনভেস্টর তখনও আমার ওপর ভরসা করে কোম্পানিতে নিজেদের শেয়ার রেখেছিলেন। এদের সকলের সহযোগিতায় আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম আমি যদিও তাতে দুবছর সময় লেগে গিয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাকসেস আমার কাছে ধরা দিয়েছিলো। বাবাও এইসময়ের মধ্যে কোমা থেকে রিকোভার করেছিল।
ওই দুবছরে নিজের জন্য কিছু ভাবার সময় ছিলনা আমার কাছ তাই তোমার কথা ভাবারও সময় পাইনি। সবকিছু যখন ঠীক হলো তখন মনে পড়লো আমার জন্য তো কেউ অপেক্ষা করছে তাই নিজে মুম্বাইতে গিয়ে তোমার বাবার অফিসে যোগাযোগ করলাম কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছিল। ওখান থেকে আঙ্কেলের ডেথের কথা জানলাম কিন্তু তোমাদের খবর কেউ দিতে পারলোনা। তারপরেও নিজের যতটুকু পাওয়ার ছিল তা ইউস করে তোমাদের খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু ফলাফল শূন্যই আসলো।
তারপরে সময়ের হাতেই ছেড়ে দিয়েছিলাম সব।
অরণ্যর কথাটাকে ধরে রূপকথা বললো
-তাই যে সময়ই আমাদেরকে আলাদা করে দিয়েছিলো সেই আবার মিলিয়ে দিলো আমাদের। দশ বছর পরে আবার মুখোমুখি হলাম আমরা দুজনে।
.
.
.
❤️ক্রমশ❤️

লাভ মি লাইক ইউ ডু 🔞Tempat cerita menjadi hidup. Temukan sekarang