বাস্তব ও অবাস্তব

10 3 0
                                    

প্রত্যাহিক জীবনের কাজ কখন আপনার কাছে বিরক্তিকর লাগবে। যখন আপনি ওই জিনিসটার উপর মনোযোগ দিতে পারছেন না। ভালোভাবে করতে পারছেন না অথবা আপনাকে দিয়ে জোরপূর্বক কাজটি করানো হচ্ছে। মতিউরের জীবনে এইরকম কোন কিছুই ছিল না। শুধু প্যারা ছিল কাজগুলো বার বার করা। মতিউরের দরকার ছিল হাওয়া পরিবর্তনের। আপনি তো ভুলেই গেছেন হাওয়া পরিবর্তনের জন্য টাকা প্রয়োজন। টাকা কোথায় হতে আসবে ? এত পড়াশুনা, এত সার্টিফিকেট, এত জ্ঞান অর্জন করার মূল লক্ষ্য কি? কোন সময় কি আপনি নিজেকে এই প্রশ্ন করেছেন। আপনি মতিউরের মত দিনরাত পড়াশোনা করে জ্ঞান আরোহন করছেন। একটা ভালো চাকুরির জন্য। আপনার জ্ঞান বৃদ্ধি পাচ্ছে তখন আপনি একের পর একটি ক্লাস উত্তীর্ণ হচ্ছেন এবং সার্টিফিকেট অর্জন করছেন। হয়তো অনেকেই মতিউরের এই মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করবেন
কিন্তু বর্তমান সমাজের পিছু আপনি কিভাবে ছাড়বেন? কাজী নজরুল ইসলামের 'মৃত্যুক্ষুধা' উপন্যাসে আনসার যখন মেজ বউকে জিজ্ঞেস করে, "আপনি খ্রিস্টান হয়েছেন কেন? তখন মেজ বউ উত্তর দেয় আমাকে এই সমাজ ও চারপাশের মানুষ খ্রিস্টান করেছেন"।

পৃষ্ঠা - ৮১

ঠিক একইভাবে আপনিও বলবেন আমি তো দিতে চাইনি বিসিএস। আমাকে এই সমাজ বাধ্য করেছে। এই টাকা উপার্জন করার নেশায় আমরা যেন দিন আর দিন একটা অসুস্থ সমাজের জন্ম দিচ্ছি। কারণ লক্ষ তো একটাই টাকা উপার্জন করা। আর এই উপার্জন করার নেশাটা সবচেয়ে বেশি থাকে নিম্ন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মানুষদের। এর আগেও বলেছিলাম সমাজে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা রাখে নিম্ন মধ্যবিত্তরা। কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রভাব বিস্তার করে শিক্ষিত নিম্ন মধ্যবিত্তরা। তারা জানেনা তাদের এই জ্ঞান সমাজের একটা বিচ্ছিন্ন অংশ। তারা মনে করে তাদের হাতে ক্ষমতা। কিন্তু তারা জানে না তাদের এই তৈরিকৃত অসুস্থ সমাজটি আস্তে আস্তে তাদেরকেই সমাজের বাইরে নিক্ষেপ করতে শুরু করে। তারা বাস্তব চিত্র দেখতে ভালোবাসে। তারা বাস্তবের মধ্যে থাকতে ভালোবাসে। কিন্তু তাদেরকে কেউ বলে না তারা যে বাস্তবের মাঝে রূপকথার জগতে বিচরণ করছে।

পৃষ্ঠা - ৮২

রূপকথা কে না ভালোবাসে। ছোটবেলা থেকে দাদীর মুখে শুনে আসা রূপকথার গল্পের মধ্যে ডুবে থাকতে সবার ভালো লাগে। কিন্তু মতিউরের মতে, আমরা তো রূপকথার মধ্যেই। বাস্তবের ধারে কাছেও নেই। চলুন সত্য, মিথ্যা ও ভবিষ্যতের মতই জেনে আসি বাস্তব নিয়ে মতিউরের চিন্তাভাবনা। আপনি জীবনের ৩০ বছর পার করে দিচ্ছেন এই লেখাপড়ার পিছনে। টার্গেট থাকে আপনার একটা সরকারি চাকুরি করার ( বিশেষ করে নিম্ন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত যুবকদের)। যাদের চাকুরিটা হয় তাদের কথায় পরে আসি। যাদের না হয় তাদের কি হয়? আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন? আপনি রাত দিন পড়ছেন। আপনার সরকারি চাকুরির পরীক্ষার বয়সও আছে এক বছর। কিন্তু পরিশেষে আপনি চাকুরিটা পেলেন না। তখন হয়তো আপনার এই বাস্তব দুনিয়ায় ভিতরে থাকতে ইচ্ছা করে না। দেখতে ইচ্ছা করে না আপনার বন্ধুদের। চায়ের স্বাদটা আগের মত লাগে না, সিগারেটের টানটা জমে না, সবকিছু মিলিয়ে তার কাছে বাস্তব অভিশাপ মনে হয়।

পৃষ্ঠা - ৮৩

জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে গালি দেয় এবং বলে ৩০ টা বছর আমি কি করলাম? আপনি সেই বাস্তবের সংজ্ঞা দশম শ্রেণীতে পড়েছেন। সেই বাস্তবের সাথে কি আপনার এখনকার বাস্তব মিলছে? পড়ার টেবিলে বসে দশম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় যখন কল্পনা করতেন বড় হয়ে ডাক্তার হবেন এবং সেবা করবেন একটা বাস্তব প্রতিচ্ছবি মস্তিষ্ক অংকন করতেন। আর যখন ডাক্তারি পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা করছেন। তখন আপনার বাস্তব চিত্র কেমন হবে? সারা জীবন গালি দেবেন ডাক্তারি পরীক্ষাকে এবং মনে মনে গালি দেবেন নিজেকে। সম্মুখে গালি দেবেন নিজের অস্তিত্বকে প্রমাণ করার জন্য এবং মনের গালি থাকবে নিজেকে সান্তনা দেবার জন্য। হয়তো আপনারা অনেকেই মনে করছেন বাস্তব চিত্রটা পাল্টায়। আপনি বাস্তব কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন দুটি উপায়। এক টাকার মাধ্যমে এবং দুই ফকিরের মাধ্যমে। এখানে বাস্তব খুবই অসহায় নিরুপায় হয়ে আসে।

পৃষ্ঠা - ৮৪

টাকা দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয় বাস্তবকে। সুখ আপনার কাছে মাথা নত করবে। দুঃখকে মনে হবে নিষ্ক্রিয় বস্তু এবং রূপকথা সেটা শুধু বইয়ের ভিতরে সীমাবদ্ধ থাকবে। মূল কথা হলো টাকা থাকলে পুরো দুনিয়াটাই বাস্তব মনে হয়। টাকা না থাকলে পুরো দুনিয়াটা অবাস্তব মনে হয়। সিনেমায়তো অনেক বার এই ডায়লগটা আপনারা শুনেছেন যে, "যার হারানোর কিছু নেই তার আবার ভয় কিসের" থামুন একবার নিজেকে প্রশ্ন করুন এবং চিন্তা করুন এ কথাটা কি সত্যিই গ্রহণযোগ্য না অগ্রহণযোগ্য? যদি দ্বিধা দ্বন্দ্বের ভিতরে যান তাহলে চলুন দেখে আসি মতিউর কি চিন্তা করে। ধরুন আপনি ২০ হাজার টাকার একটি চাকুরী করছেন। বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপট থেকে আপনাকে ফকিরই বলা যেতে পারে। কারণ ২০ হাজার টাকায় বর্তমান বাজারে ঢাকা শহরে পরিবার নিয়ে থাকা মানে ব্যাংক, সমিতি বা অন্যর লোনের টাকায় চলা। আপনি দিনরাত পরিশ্রম করে এক করে দিচ্ছেন। কিন্তু আপনার আয় বাড়ছে না। আপনার পরিবার থেকে চাপ আসছে।

পৃষ্ঠা - ৮৫

আপনার স্ত্রীর নতুন জামা লাগবে এই ঈদে। আপনার বাচ্চার জন্য দশ হাজার টাকা বরাদ্দ রাখছেন ( স্কুল, টিউশন ফি, আনুষাঙ্গিক খরচ )। মা-বাবাকে টাকা পাঠানো লাগছে। আত্মীয়-স্বজনকে দেখা লাগছে। সবকিছু নিয়ে অতিষ্ট আপনি। রাতে আপনার ঘুম আসে না। ফ্যানের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকেন আপনার অতীত এবং ভবিষ্যৎ। ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে ভাবেন নিজের জন্য কি করলাম সারা জীবন? চারপাশের মানুষের দিকে তাকিয়ে নিজেকে আরো অসহায় মনে হবে। না আছে পাশের বাসার ভাইয়ের মত iphone না আছে তার মতো ভালো চাকুরি। সবকিছু মিলিয়ে সমাজ আপনাকে একটা আশীর্বাদ দিবে তাহলে 'হিংসা'। যা অচিরেই রূপ নেবে 'অহংকারে'। প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি সেকেন্ড এই হিংসা আপনার মনকে চিবিয়ে চিবিয়ে ভক্ষণ করবে এবং নিজেকে সান্তনা দেওয়ার জন্য আপনি বাইরের মানুষকে বলবেন আমি তো তার থেকে শান্তিতেই আছি। যার কিছু নেই হারানোর কি ➡️ ভুল। যার কিছু নেই, কে বলছে আপনার কিছু নেই। আপনি তো আশীর্বাদ হিসেবে "হিংসা ও অহংকারকে" পাচ্ছেনই।

পৃষ্ঠা - ৮৬

তাহলে কেনই বা নিজেকে এই মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছেন। কারণ আপনি ইতিমধ্য 'অহংকারের' ভিতরেই আছেন। তাই ফকির হয়ে বাস্তবে ভ্রমণ করা পুরাই অবাস্তব। ফকিররা হয়তো রূপকথার পরিবর্তে বলেন 'হিংসা' ও 'অহংকার'। চলুন একটু ঘুরে আসি যারা চাকুরিটা পেয়েই গেছে তাদের কাছ থেকে। আপনাদের মতে তাদের জীবনটাই বাস্তব। চাকরি পেয়ে গেছে, পরিবারের সম্মান বেড়ে গেছে, কষ্ট সফল হয়ে গেছে, সমাজের কাছে মাথা উঁচু হয়ে গেছে। তাহলে এগুলোই বুঝি বাস্তব। মূলত সেও জানে না সে যে কবে ইদুর খেলায় মেতে উঠেছে। হয়তো তার জীবনের একটা দরজা খুলেছে। কিন্তু আপনি কিভাবে জানেন যে নয়টা দরজা বন্ধ কি খোলা? প্রতিদিনের চাপ, টাকার নেশা, সমাজে আরো বড় হওয়া লাগবে, বাড়ি লাগবে, গাড়ি লাগবে, আরো টাকা লাগবে, কি চান আপনি? সেটাই হয়তো এক সময় হারিয়ে ফেলবেন।

পৃষ্ঠা - ৮৭

রহস্যময় জীবনকে আরো রহস্যময় করে তুলবেন। দরজার কাছে ঘুরপাক খেতে থাকবেন হয়তো খুলেও ফেলবেন। জীবনের কোন এক সময়। কিন্তু প্রশ্ন দাঁড়াবে টাকাটা কি 'সৎ' না কি 'অসৎ'? জীবনের শেষ সময় কি নিতে পারবেন এত চাপ? তখন মনে হবে আমি তো ছিলাম অবাস্তব দুনিয়ায়। যেখানে টাকা আমাকে করেছে মুগ্ধ। সম্পদের পাহাড় গড়তে হবে ছিল একটাই লক্ষ্য। সবকিছুই ঠিক থাকবে সময়, দিন ও পরিশ্রম। কিন্তু প্রশ্ন থাকবে নৈতিকতার। সেই পরিশ্রম করেই অর্জন করলাম অসৎ টাকার ভান্ডার। আপনি যদি মনে করেন আপনি সৎ তাহলে আপনি ভুল। কারণ এই অবাস্তব দুনিয়ায় আমরা টাকার নেশায় অনেক আগেই আমাদের সৎ গুণটাকে বিসর্জন দিয়েছি। এখন শুধু আমরা চেষ্টা করি অসৎকে দমানোর জন্য। যা নির্ভর করে আমাদের উপর এবং আমাদের কাজের উপর।

পৃষ্ঠা - ৮৮

হয়তো কোন একদিন অবাস্তব কে বিদায় দিয়ে বাস্তব দুনিয়ার জন্য অপেক্ষা করবো। যেখানে রূপকথা, হিংসা, অহংকার, বাস্তব ও অবাস্তব কিছুই থাকবে না। কিন্তু আপনি তো ভুলেই গেছেন এটাও একটা অবাস্তব চিন্তা। মতিউরের চিন্তা ভাবনাতো চলতেই থাকবে, সত্য মিথ্যার বিচার হতেই থাকবে, ভবিষ্যৎ বর্তমান ও অতীত নিয়ে খেলা করতেই থাকবেন এবং বাস্তব ও অবাস্তবকে বুঝে নিবেন আপনি। জীবন কখনো থেমে থাকবে না। তার গতিতে সে চলতে থাকবে। গতিটা সময় এবং নদীর স্রোত দিয়ে কখনো মাপতে পারবেন না। আপনাকেও অপেক্ষা করতে হবে শেষটা দেখার জন্য। হোক সেটা সুন্দর আর অসুন্দর। মাথা পেতে নিতে হবে জীবনের দেওয়া শাস্তি গুলোকে। কারণ উপহার তো দুর্লভ বস্তু। হয়তো সেটা নিম্ন মধ্যবিত্তরা জানেই না। প্রশ্ন রয়েই যাবে শেষ পর্যন্ত। আসল প্রশ্ন হল আপনি কতগুলো প্রশ্নের উত্তর বের করতে সক্ষম হয়েছেন।

পৃষ্ঠা - ৮৯

প্রতিটি অধ্যায় কি শেষ করতে পেরেছেন? না অসমাপ্ত রেখে চলে গেছেন?। মাঝখানে বলেছিলাম, "জীবনের সাথে মানুষের যুদ্ধটা অনেক পুরানো"। যা এক মতিউরের জীবন দ্বারা তুলে ধরা সম্ভব নয়। সমাজের আনাচে - কানাচে ছড়িয়ে আছে হাজারো মতিউর নতুন কোন জীবনের কথা লেখার জন্য? মতিউর তো ছুটছে অজানা গন্তব্যের দিকে। তবে আপনিও কি ছুটবেন? না সমাজের প্রবাহমান স্রোতের সাথে জীবনকে ভাসিয়ে দিবেন?

পৃষ্ঠা - ৯০

সত্য দিনের অপেক্ষায়Nơi câu chuyện tồn tại. Hãy khám phá bây giờ