নীলক্ষেতে বই বাজারের সামনে দাঁড়িয়ে। এক হাতে সিগারেট মুখ থেকে বের হচ্ছে দোয়া আবার ক্ষনিকের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। পকেট থেকে ফোনটা বের করে কল করলো আসিফকে।
মতিউর : এই ব্যাটা, এই রংপুর, তোরে নীলক্ষেত কইলাম কখন। এখনো আস নাই কেন? কই তুই?
আসিফ : মামা, এইতো আইয়া পড়ছি। ঢাকা কলেজের সামনে। আর মাত্র পাঁচ মিনিট লাগবো।
পৃষ্ঠা - ৭২
মতিউর : হ, তাড়াতাড়ি আয়। অনেক বই কিনা লাগবো।
কলটা কেটে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে আবার একটা টান দেয় সিগারেটে। যেহেতু আসিফের আসতে আরো পাঁচ মিনিট লাগবে। মতিউর ভাবল কয়েকটা ইংরেজি বই দেখি। মতিউরের আগে থেকেই ইংরেজির প্রতি দুর্বলতা ছিল। বাংলায় ভর্তি হওয়ার পর এবং স্বদেশীয় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা জানার পর ইংরেজির প্রতি দুর্বলতা অনেকটাই কেটে আসে। তারপরও ইংরেজি বই পড়তে তার ভালই লাগতো। কারণ মতিউর বিশ্বাস করত একটা ইংরেজি বই পড়ার মাধ্যমে আপনি অনেক নতুন শব্দ শিখতে পারছেন। আপনার ইংরেজি রিডিং পড়া ভালো হচ্ছে এবং ইংরেজি বলার ক্ষেত্রে যেই জরতাটা আমাদের কাজ করে সেটা কাটছে। নতুন একটি সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করছেন। মতিউর, Atomic habits, The psychology of money, 1984, A silent patient এইসব বই ধরে দুই এক পৃষ্ঠা দেখে দাম জানতে চাচ্ছিল। যদিও মতিউরের এই বইগুলো কিনার তখন আগ্রহ ছিল না। কোর্সের বই কিনতেই অনেক টাকা লাগবে। যদি এরপরে টাকা বাঁচে তাহলে নন একাডেমিক এই ইংরেজি বই দুই একটা কিনতে পারে।
পৃষ্ঠা - ৭৩
বইয়ের দাম জানতে চাচ্ছিল এবং আসিফের গোষ্ঠী উদ্ধার করতেছিল মনে মনে দেরি হওয়ার কারণে। ঠিক ওই মুহূর্তে আসিফ এসে হাজির হয় মতিউরের সামনে এবং বলে,
আসিফ : কিরে মামা, এগুলা কিনবি আগে?
মতিউর : তুই কোন কথা কইস না। শালা এই জায়গায় থাকোস তারপরও এইহানে থেকে এইহানে আসতে তোর এত দেরি লাগে।
আসিফ : হ, এখন সব দোষ তো আমার কইলাম তোরে জাহাঙ্গীর গেট পার হওয়ার সময় একটা কল দিবি। কিন্তু তুই কি কল দিছিলি আমারে। বাস থেকে নাইমমা তারপর কল দিছস। রেডি হইয়া আইতে একটু সময় লাগবো না আমার।
মতিউর বুঝতে পারে তার পরাজয় নিশ্চিত। তাই কোন তর্ক আগে না বাড়িয়ে কৌশলে কেটে পড়ে।
মতিউর : হ, হ বুঝছি বুঝছি এখন আয় আগে বই কিনি।
শুরু হয় নীলক্ষেত বইয়ের বাজারের ভ্রমণ। মামা এইটা কত?
পৃষ্ঠা - ৭৪
না মামা ওইটা। পুরনো বই হবে মামা। পুরান বই বের করো দেখি। ওই মতিউর ওইটা নে ওইটার পৃষ্ঠা ভালো। এই বইয়ের সাথে আসিফার যুদ্ধ চলে প্রায় তিন ঘন্টার মত। শুকনো ব্যাগটা দেখতে দেখতে আস্তে আস্তে হয়ে যায় মোটা। কাধ ব্যাথা হতে থাকে। অর্ধেক সময় মতিউর এবং অর্ধেক সময় আসিফ। এই ভাগাভাগি শেষ হয় ঢাকা ইউনিভার্সিটির কলা ভবনের সামনে গিয়ে না হলে ঢাকা কলেজের পুকুর পাড়ে। মতিউর যখন প্রথম বর্ষ ও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির কলা ভবনের সামনের আড্ডাটা জমে উঠতো। কিন্তু এখন আড্ডা জমে উঠে ঢাকা কলেজের পুকুর পাড়ে। দুপুরের কড়া রোদ আস্তে আস্তে রূপ নেয় বিকালের মৃদু রোদে। গায়ে পড়লে আলাদা এক ধরনের শান্তি অনুভব হয়। পুকুর পাড়ের ঘাটে বসে আসিফ স্যান্ডেলটা খুলে এবং মতিউর জুতার ফিতা গুলো খুলে মুজা পরা পা দুটি বের করে। জুতার উপরে রাখে এবং নীরব ভাবে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পুকুরের দিকে। দুটি চোখ টলটল করতে থাকে। হঠাৎ করে মতির বলে ওঠে, আসিফ গ্রামের কথা মনে পড়ে যায় তোদের এই জায়গায় আসলে।
পৃষ্ঠা - ৭৫
আসিফ : আমারও দোস্ত। এখনতো কম মানুষ কারণ কলেজ বন্ধ। কলেজ খোলা থাকলে এই জায়গায় বসে মজা পাওয়া যায় না।
মতিউর : তুই গ্রামে যাবি কবে?
আসিফ : দেখি, এখনো তো পরীক্ষা শেষ হয় নাই। তারপর আবার প্রাকটিক্যাল আছে। যেতে দেরি হবে।
মতিউর : তোরাই ভালো ভাই ঘন ঘন গ্রামে যাইতে পারোস।
আসিফ : ক্যান, তোরা যাস না।
মতিউর : হ্যা, যাই। কিন্তু শুধু কোরবানিতে ৭-৮ দিন থেকে আবার চলে আসি।
আসিফ : তোর কি গ্রাম ভালো লাগে?
মতিউর : আবার জিগায় ব্যাটা প্রকৃতির মাঝখানে থাকার সুখ একটাই আলাদা। সন্ধ্যার দিকে বাজারে যাবা, আড্ডা দিবা, চলে আসবা। আর সকালে কাজ করবা। ওতো চাওয়া পাওয়া নাই মামা আমার।
আসিফ : আমারও একই চিন্তা মামা। এইবার আবার ঘর উঠাইছি তো আমাগো আবার সব সেট হইয়া গেছে।
পৃষ্ঠা - ৭৬
মতিউর : তুই থাকবিও বা কেমনে এই যান্ত্রিক শহরে। এই শহরে এসে মানুষ সব দানবে পরিণত হইছে। এই শহরে আসার প্রথম শর্ত হচ্ছে তোর মনুষত্ব বিক্রি করে এই শহরে আসতে হবে। মন দিবি কেমনে কাউকে? যদি মনে বিক্রি করে দেস। আর আর্থিক অবস্থার কথা বাদই দিলাম। আসিফ মন দিয়ে মতিউরের কথাগুলো শুনে এবং পুকুরের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ করে আসিফ বলে ওঠে, করবই বা কি এই যান্ত্রিক শহরে দানবে পরিণত হাওয়াই তো লাগবে না হওয়ার কোন উপায় আছে? মতিউর চুপ থাকে। হয়তো এটার উত্তর দেওয়ার জন্য মনেরও ভিতরে একটা উত্তর খুঁজতে থাকে। কিন্তু বাস্তব হল, উত্তরটা কারোই জানা নেই। দুই জনই তাদের পারিবারিক, সুখ, দুঃখ লেখাপড়া সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করে প্রায় সন্ধ্যা বাজিয়ে দেয়।
মতিউর : মামা চল যাই। বাসায় যাইতে হবো সন্ধ্যা হইয়া গেছে।
আসিফ : হ, মামা চল উঠি।
পৃষ্ঠা - ৭৭
মতিউর : ভালো চা পাওয়া যায় কই রে আসিফ?
আসিফ : আমি সঠিক জানিনা। চল কলেজের পিছনে দিকে যাই। ওইদিকে সবাইকে আড্ডা দিতে দেখি।
মতিউর : TSC তে যাবি আসিফ।
আসিফ : না, পাগল নাকি উল্টা এতগুলো পথ। কোন জায়গায় একটা চা খাইয়া। বাসে, উঠি চল।
মতিউর : আচ্ছা, চল তাহলে।
শিশুদের মত গুটি গুটি পায়ে পথচলা শুরু হয় মতিউর এবং আসিফের। পথিমধ্য মতিউরের বেসুরা গলা থেকে বের হয় গান। আসিফ মাঝখানে মাঝখানে তাল দেয়। গান শেষ না করতে করতেই চায়ের দোকানে হাজির।
মতিউর : মামা একটা সিগারেট দাও। আর দুইটা রং চা। সিগারেটটা দুই আঙ্গুলের মাঝখানে নিয়ে ঘাটা একটু বাঁকা করে ঝোলানো ম্যাচটাকে ধরে বুড়ো আঙ্গুলটাকে দিয়ে একটা ঘষা দেয়। চোখের সামনে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে আগুনটা। আগুনটা দেখে মতিউরের মনে পৃথিবীর সমস্ত সুখ এসে জড়ো হয়।
পৃষ্ঠা - ৭৮
দুই ঠোঁটের মাঝখানে সিগারেটটা চেপে ধরে আগুনের মধ্য সিগারেটের মাথাটা নিয়ে টান দেয়। সিগারেট প্রেমিকদের কাছে প্রথম টানটা যেন স্বর্গীয় টান। স্বর্গীয় টানের নেশা না কাটার আগেই মামা আপনাদের চা।
মতিউর : হাত কি দিয়ে তৈরি মামা? এত তাড়াতাড়ি।
মামা : কাস্টমার আর নাই তো মামা তাই।
আসিফ : রাস্তার যেই জ্যাম মামা, তোর যাইতে যাইতে রাত হইয়া যাব আজকে।
মতিউর : করার কি আছে মামা?
এইভাবে কথা বলতে বলতে সময়ও কেটে যায়, সিগারেট ও শেষ হয়ে যায়, চা ও শেষ হয়ে যায় এবং আড্ডাও শেষ হয়ে যায়। আসিফকে বিদায় দিয়ে মতিউর বাসে উঠে সিটে বসে। কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনতে থাকে এবং মনে মনে আজকের দিনের সারাংশ করতে থাকে। সারাদিনের পরিশ্রমের ফলে ঘুম এসে জড়ো হয় মতিউরের দুই চোখে। মতিউর সাইন্স ল্যাবের জ্যাম, শাহবাগের জ্যাম, বাংলা মোটরের জ্যাম, মহাখালীর জ্যাম, গুলশান - ১ সিগনাল সব ঠেলে বাসায় যাবে। তাই একটা ঘুম দিয়েই নেয় মতিউর।
পৃষ্ঠা - ৭৯
কিন্তু ঘুমটা বেশি গভীর হয় না। ইচ্ছা করেই মতিউর ঘুমটা বেশি গভীর করে না। কারণ সাথে থাকে বই, মানিব্যাগ, মোবাইল ইত্যাদি। তাই চোখ বন্ধ করলেও হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে নেয় ব্যাগ। দিনশেষে ক্লান্ত একটি শরীর নিয়ে এবং কতখানি স্মৃতি নিয়ে হাজির হয় বাসায় মতিউর। তখন খাটকে মনে হয় সবচেয়ে প্রিয় বস্তু দুনিয়ার এবং ঘুমকে কি মনে হয়? তা হয়ত ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কিন্তু মতিউরের কি সেই সৌভাগ্য? যে বাহির থেকে এসেই ঘুমিয়ে পড়বে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে, খাবার খেয়ে, নামাজ পড়ে এবং কেনা বইগুলোকে গুছিয়ে ঘুমো ঘুমো চোখে ফোন দেখে। কারণ মতিউরের বাবা আসে রাত একটায়। যেহেতু নিচের গেট বন্ধ থাকে তাই মতিউরকে খুলে নিয়ে আসতে হয়।
পৃষ্ঠা - ৮০
![](https://img.wattpad.com/cover/366733621-288-k914856.jpg)
VOUS LISEZ
সত্য দিনের অপেক্ষায়
Non-Fictionসোমবার সকাল বেলা ঠিক ছয়টা বাজে। মোবাইলে দেওয়া এলার্ম এর শব্দে চারদিকের মানুষের ঘুম হারাম কিন্তু যার জন্য এলার্ম তার কোন খবর নেই। মা এসে বলল ওই মতিউর উঠবে না নামাজের সময় শেষের দিকে, তোর তো আজ কলেজ ও আছে যাবি না। মতিউর বলল মা আর মাত্র পাঁচটা মিনিট...