Little Cobra

0 0 0
                                    

বিরক্তিকর মনোভাবে ওয়াশরুমের মধ্যে দাঁড়িয়ে সবুযে রাঙা টপটা পরিষ্কার করবার চেষ্টা করে চলেছি। সিঙ্কের পাশে আমার জ্যাকেটটা রাখা। বিরক্তি যেন রাগে পরিণত হচ্ছে। ওকে ম্যাসেজ পাঠানোর পর-পরই এমন একটি অসহ্যকর ঘটনার সম্মুখীন হতে হলো। মাতালটাকেও গ্লাসের সম্পূর্ণ রামটা আমার শরীরেই ঢালতে হলো।
‘ভদ্রতার খাতিরে তখন রাগটা নিয়ন্ত্রণ করেছি। নয়তো…’ নিজ মস্তিষ্কে এমন হাজারও কথা উচ্চারণ করতে লাগলাম। যার সবটাই রাগের বশে।
পরনের টপটা যখন প্রায় পরিষ্কার হয়ে এসেছে ঠিক তখন আকষ্মিক ওয়াশরুমের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হলো। খানিকটা ঘাবড়ে উঠলাম আমি। আমার নিক্টোফোবিয়া নামক সমস্যাটি রয়েছে। বাহিরে যেই চেঁচামেচি হচ্ছে তা থেকে বুঝতে পারলাম সম্পূর্ণ ক্লাবে-ই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ঘটেছে। ওয়াশরুমে প্রবেশের দরজার দিকে তাকালে সেদিকটাও অন্ধকার। একদম ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে আমি বিশাল আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছি। অথচ আমি নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে ব্যর্থ।
আমার শরীর জোরে ভয়ের একটি তীব্র স্রোত শরীরকে কাঁপিয়ে বয়ে গেলো। কম্পিত হাতটি বাড়িয়ে জ্যাকেট ধরবার চেষ্টা করলাম। ব্যর্থ হলেও আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। এবং এই চেষ্টা ও ভয় আমায় অস্থির করে তুলেছে। আমার হৃৎস্পন্দনের গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। হঠাৎ করেই যেন ওয়াশরুমের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। আমার নিঃশ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হতে লাগল।
যখন আমি কিছু ভাবতে পারছিলাম না এবং আমার সারা দেহ ও মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে উঠছিল ঠিক সে সময় একটি শক্ত‚ উষ্ণ এবং তুলনামূলক বড় হাত আমার হাতটি খুব সাবধানে চেপে ধরল। যেই হাতটি আমার জ্যাকেট খুঁজে বের করতে অস্থির হয়ে উঠেছিল তা এখন অজ্ঞাত ব্যক্তির মুষ্টির মাঝে আবদ্ধ। ব্যক্তিটি আলতোভাবে আমাকে নিজের দিকে টেনে নিল।
সে একজন পুরুষ। একটি পুরুষ দেহের সুঘ্রাণ আমার মস্তিষ্ককে শিথিল করতে লাগল। অদ্ভুত সে ঘ্রাণ। এক ঝাঁঝালো-মিষ্টি ঘ্রাণ। এবং… এবং শুকনো তামাক পোড়ার ঘ্রাণ। অদ্ভুত মোহনীয় এক জটিল ঘ্রাণ।
সে তার বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে আমার গালে আলতো করে আদর করতে থেকে গভীর নিচু তবু স্নেহময় মৃদু কণ্ঠে বলল‚ “হুশ‚ শান্ত হও। সব ঠিক আছে। তুমি একা নও। ধীরে শ্বাস গ্রহণ করো। শান্ত হও। সব ঠিক আছে।”
অদ্ভুত কাণ্ড। আমি ধীরে ধীরে শান্ত হতে লাগলাম। আমার অসাড়তা কাটতে আরম্ভ করল। লোকটা অপরিচিত। অথচ তার স্পর্শ ও গলার স্বর—সবটা কেমন নিরাপদ মনে হতে লাগল। এমনটি ঘটা সম্ভব? হয়তো হ্যাঁ। কারণ এই মুহূর্তে আমার এই নিরাপদ সঙ্গটিই ভীষণভাবে প্রয়োজন। যা আমি এই লোকটির উপস্থিতিতে অনুভব করতে পারছি। ধীরে ধীরে আমার হৃৎস্পন্দনও স্বাভাবিক হতে লাগল। যখন আমি শান্ত হয়ে উঠলাম তখন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম‚ “ক-কে তুমি?” আমার গলায় আমার কণ্ঠস্বর খানিকটা কেঁপে উঠল।
আমি একটি মৃদু হাসির শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেলাম। আমি অনুভব করলাম লোকটা আমার তুলনায় অনেক লম্বা। আমি অন্ধকারে উপরের দিকে অনির্দিষ্ট একটি দিকে তাকিয়ে আছি। কিন্তু আমার অবচেতন মন জানান দিচ্ছে যে‚ ওই তো তার চোখজোড়া। আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। ঈষৎ চোখজোড়া। উপলব্ধি করলাম আমার অবচেতন মন চাইছে লোকটি যেন মিস্টার মিস্ট্রি হয়।
অতঃপর সেই একই নিচু অথচ স্নেহময় কণ্ঠস্বরে জবাব আমার কানে ভেসে এলো‚ “তোমার মিস্টার মিস্ট্রি।” দিয়াশলাইয়ের বারুদে ঘর্ষণ লাগলে যেমন হঠাৎ করে আগুন জ্বেলে উঠে‚ ঠিক তেমনভাবে আমার হৃৎস্পন্দন আকষ্মিক বেড়ে গেল। ভয়ের কারণে নয়। কিন্তু কেন সে বিষয়ে আমিও অজানা। তবে সে আমার দেওয়া ডাকনাম এতটা আনন্দের সহিত গ্রহণ করবে তা ছিল অপ্রত্যাশিত।
আমার গালে তার বৃদ্ধাঙ্গুলির চলাচল এখনো থামেনি। “তোমার ফোনের টর্চটা জ্বালাবে?” আমি তার ঈষৎ চোখজোড়া আরেকবার দেখার লোভকে সামাল দিতে না পেরে এক প্রকার আকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম। অন্ধকারে মনে হলো সে না বোধক মাথা নাড়ল।
আমার প্রশ্নের জবাবের পরিবর্তে সে আমার কানের পেছন থেকে কয়েকটি চুল খুব সাবধানে নিজের দিকে নিয়ে গেল। “তোমার চুলের সুঘ্রাণ…উম্ম!” সে এমনভাবে ব্যক্ত করল যেন এই ঘ্রাণ পৃথিবীর সব সুঘ্রাণকে হার মানাচ্ছে। অথচ এটি শুধুমাত্র আমার শ্যাম্পুর ঘ্রাণ। “উঁহু! এটা শুধুমাত্র শ্যাম্পুর ঘ্রাণ নয়‚ লিটল কোবরা। তোমার চুলের ব্যক্তিগত ঘ্রাণও এর সাথে মিশে আছে।”
অপ্রস্তুত হলাম আমি। সে কি ট্যালিপ্যাথিক শক্তি সম্পন্ন কোন অতিপ্রাকৃত মানব? নয়তো আমার চিন্তা সে কীভাবে বুঝতে পারল? সে আবারও হাসল। অদ্ভুত ঘোর লাগা সে হাসির শব্দ। নাকি কেবলমাত্র আমার-ই তা মনে হচ্ছে?
“তোমায় খুব সাবধানে থাকতে হবে‚ লিটল কোবরা। আমি ছাড়াও তোমার শত্রু রয়েছে। যে শত্রু তোমার ক্ষতি চায়।” আবারও সেই সতর্কবাণী। কিন্তু সে কি সত্যিই আমার শত্রু? শত্রু কি এটা জেনেও অন্ধকারে শান্ত করতে আসবে যে আমার নিক্টোফোবিয়া আছে?
হ্যাঁ। সে আমার শত্রু। কারণ সে আমার মস্তিষ্ক ও মনকে পরস্পরের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমার নির্ঘুম রাতের কারণ সে। হোক তা মন্দ কিংবা ভালো কারণে। শত্রু তো এমনটাই করে। এসব ভাবনা শুধুমাত্র আমার মস্তিষ্কেই উচ্চারিত হচ্ছে। মুখ ফুটে একটি শব্দও আমি উচ্চারণ করলাম না। কেবলমাত্র তার দেহের অদ্ভুত মোহনীয় জটিল ঘ্রাণটি শুকতে লাগলাম।
আমার ধ্যান ভগ্ন করে সে নিজের কোমল ঠোঁটজোড়া আমার কপালে ছুইঁয়ে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থাকল। দেহত্বকে তার ঠোঁটের স্পর্শে মনে হলো বড্ড শুষ্ক তারা। সঠিক পরিচর্যার অভাব। আমার মুক্ত হাতে একটি শীতল কাঠি বিশেষ কিছু দিয়ে অতঃপর সে সরে গেলো।
যেমন হুট করে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়েছিল‚ তেমন হুট করেই তা ফিরে এলো। আমার চোখজোড়া সামনেই স্থির ছিল। আমি তার চওড়া ও শক্ত পেছনাংশটি দেখতে পেলাম। কালো রঙের শার্টটা তার শরীরের সাথে আঁকড়ে আছে।
“ওয়েট।” হঠাৎ যেন আমার কি হলো। আমি খানিকটা অস্থির হয়েই তাকে পিছু ডেকে উঠলাম। ওই মুখশ্রী দেখবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগল। সিঙ্কের দিকে তাকিয়ে একহাতে জ্যাকেট নিয়ে ওয়াশরুম থেকে এক প্রকার ছুটে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু ততক্ষণে লোকটা ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গিয়েছে। কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলাম।
হাতে কিছুর উপস্থিতি উপলব্ধি করে নিচে তাকালে একটি লাল গোলাপ দেখতে পেলাম। এতক্ষণ যাবিত সে এটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল? এতদিন দিয়েছে কালো গোলাপ অথচ আজ লাল। কেন? ভিন্ন কেন? এর কারণ কী? এই পরিবর্তন কেন যেন মানতে পারলাম না। কালো গোলাপে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি আমি৷ কি করে হুট করে লালকে গ্রহণ করি?
আমার মস্তিষ্ক আমায় বারংবার আদেশ করে যাচ্ছে যা কিছু ভাবছি তার যেন ইতি এখানেই টানি। এবং গোলাপটি পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দেই। কিন্তু গোলাপটি তবুও যতনে হাতে রেখেছি। কেন করছি তা আমারও অজানা। কিন্তু আমার মন ‚ মস্তিষ্ক ও আমার দেহের মাঝে বেশ ভয়ঙ্কর এক যুদ্ধ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে।
সে তার নামটি আমায় জানিয়ে যায়নি৷ আমিই তো তাকে জিজ্ঞাসা করিনি। তিনি দারুণভাবে আমার চিত্তিবিক্ষেপে পরিণত হচ্ছেন। কেবল একটি দীর্ঘশ্বাস আমার দেহাভ্যন্তর থেকে পালিয়ে গেলো।

চলবে………

শ্বাপদসংকুলWhere stories live. Discover now