Little Cobra

0 0 0
                                    

ভোরবেলা হঠাৎ চেঁচামেচিতে ঘুমটা বেশ বিরক্তিকরভাবেই ভেঙে গেল। এসাইনমেন্টের ঝামেলার অতলে ডুবে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। ভোরের দিকে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেওয়ার পর-ই চোখ দুটো ক্লান্তিতে নিভে গিয়েছিল। কিন্তু মিনিট কয়েক যেতে না যেতেই এমন চেঁচামেচি মেজাজটা আরো বিগড়ে দিল। বাবার উচ্চস্বর শুনে বুঝতে পারলাম সে আজও মাতাল অবস্থায় বাড়ি ফিরেছে। লোকটা খুব অদ্ভুত জাতের। তার তুলনায় একজন পিতা কুকুরও নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে বেশ অবগত। শুধু তাই নয়। কুকুর নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সততার সাথেই পালন করে।
“নিঃসন্দেহে তোমার এই সিদ্ধান্ত আমার সেরেনের জন্য অমঙ্গলকর এবং তোমার বিরাট স্বার্থ লুকায়িত। কেন আমার মেয়েটাকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইছ?”
মায়ের ভাঙা ও কম্পিত কণ্ঠ স্বরে আর বিছানায় থাকতে পারলাম না। তবে তর্কের মূল বিষয় যে আমি তা বুঝতে আমার বেশি একটা সময়ও অপচয় করতে হলো না। কুঁচিত কপালে ক্লান্ত ও দুর্বল শরীরটা ঠেলে নিজ রুম থেকে বেরোতেই বাবা ও মা-কে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। মায়ের চোখজোড়া ভেজা। অশ্রুজল মুছে ফেলা হয়েছে। তবুও অক্ষিপল্লবে ভেজাভাব রয়ে গেছে। আরেকটু এগিয়ে যেতেই মায়ের গলাটা কেমন অস্বাভাবিক লালচে মনে হলো। উৎসুক মস্তিষ্ক আমার মাথাকে ঘাড়ের দিকে কিঞ্চিৎ কাঁৎ করে দিল।
বাবাকে পাশ কাটিয়ে‚ উপেক্ষা করে আমি মায়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখামাত্র মায়ের মুখভঙ্গি কেমন পরিবর্তন হয়ে গেলো । রাতের পোশাক ও মুক্ত চুলগুলো দিয়ে গলার লালচে ভাবটা ঢাকবার বৃথা চেষ্টা করল। তাঁর একটি হাত নিজের গলাটি জড়িয়ে আছে। আমি মায়ের সন্নিকটে যাওয়া মাত্র সেই হাতটি একটানে সরিয়ে দিলাম।
একাধিক আঙুলের দাগ লালচে বর্ণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আমি মায়ের চোখের দিকে তাকালাম। যে পরিকল্পনা আমার মনের ভেতর ছুটোছুটি করছে তা তিনি উপলব্ধি করতে পেরে ইশারায় আমায় নিষেধ করলেন। বিরক্তিটা যেন মুহূর্তে আমার রাগে পরিণত হয়ে গেল। আমি বুঝতে পারলাম আমার চোখের চাহনি কঠোর হয়ে উঠেছে। নিজের ঠোঁটজোড়া খানিকটা নাড়িয়ে আমি বাবার দিকে তাকালাম। বুক ও পেটের মধ্যিখানে হাত দুটো বেঁধে আমি তার দিকে খানিকক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকলাম।
মাতাল চোখজোড়া টেনে খোলে রাখার চেষ্টা করলেন তিনি। আমার দিকে তাকিয়ে হেচকি তুললেন। বিশ্রী মদের গন্ধ আমার নাকে এসে বারি খেল। কিন্তু আমার চাহনি ও অবস্থানের পরিবর্তন হলো না। অতঃপর তিনি মাতাল কণ্ঠে বললেন‚ “এইতো আ-আ-আমাদের শ্-শে-রেন। আমার এট্-ইএম কার্-ডহ।”
আমার বিরক্তিটা যেন সীমা লঙ্গন করল। একে তো মাতালটা আমার নামের ভুল উচ্চারণ করেছে। আবার আমাকে নিজের এটিএম কার্ড বলে দাবি করছে! “অথবা আপনার যমদূত—আপনার মৃত্যুর কারণ— আপনার খুনী।” কথাগুলো আমার মুখ থেকে এমনভাবে বের হলো যেন কোন ড্রাগন তার ভেতরকার সুপ্ত আগুনকে বাহিরে মুক্ত করে সম্মুখের সবকিছু পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আমার কাঁধে মায়ের হাতের স্পর্শকে আমি অগ্রাহ্য করলাম। “রেন‚ চুপ করো। ওই লোকটার সাথে তর্কে জড়িও না। তোমার গায়ে—।”
মায়ের কথা মাঝ থেকে কেটে নিয়ে তাকে থামিয়ে আমি প্রশ্ন করলাম‚ “হাত তুলবে?” তাচ্ছিল্য করলাম আমি। “এই একটি কাজ ছাড়া আর কি করতে পারে এই লোকটা? মাতালদের ঠিকানা রাস্তায়।” রাগটা ঠিকভাবে কণ্ঠে প্রকাশ পেতে আরম্ভ করল। “কি বলছিলেন? এটিএম কার্ড? আমি আপনার এটিএম কার্ড?”
তিনি নিজ ভুরু যুগল কপালের দিকে উঁচু করে বন্ধ চোখে সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। অতঃপর সেই একই মাতালের কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন‚ “ঠিক। ব্লাক-ইশ্টোন তোমায় খুব তাড়-আ-তাড়ি নিতে আশ্-শ্-শবেন।” খিলখিল করে হেসে উঠলেন তিনি। যেন কন একটা বোকা লোক  ভুলভাল এক ঠাট্টা শুনেছে।
“কেন? ব্লাকস্টোন-ই কেন? মূল ঘটনাটা কি?” আমি নিজ দাঁতে দাঁত চেপে রাগকে নিয়ন্ত্রণের বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছি। “আপনি কি উনার নিকট ঋণগ্রস্ত?”
আবারও উনার সম্মতিসূচক মাথা নাড়াতে দেখে আমার চোখজোড়া আপনা-আপনি বিস্ফোরিত হয়ে গেল। এর অর্থ একটাই দাঁড়ায়। তিনি আমাকে টাকার জন্য… বিক্রি করে দিয়েছেন। আমার অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল; কান্না করছে তা। কিন্তু আমার বাহ্যিকরূপ স্বাভাবিক। শুধুমাত্র বিস্ময়-বিহ্বল এক অভিব্যক্তি। পেছন থেকে মায়ের হাঁপানোর শব্দ স্পষ্ট আমার কানে ভেসে এলো।
আমি নিজ হাতে একটা টান অনুভব করলাম। মা আমাকে নিজের পেছনে দাঁড় করিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে এলেন। ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর মা জিজ্ঞাসা করলেন‚ “কি বললে? তুমি আমার সেরেনকে ওই ব্লাকস্টোনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছ? সামান্য কয়েকটা টাকার ঋণের জন্য?”
“শ্-শ্-শ্-শামান্-ন্য? ভদ্রলোকটার কাছে আমি…” কথার মাঝপথে থেমে বাবা নিজের আঙুল গুনতে আরম্ভ করলেন। নয় অবধি গণনা করে তিনি থামলেন। দুই হাতের নয়টি আঙুল মা-কে দেখিয়ে বললেন‚ “নয় কোটি।” তিনি এমনভাবে হাসলেন যেন তিনি বেশ মহৎ কাজ করেছেন।
মা দুই কদম পিছিয়ে গেলেন। তিনি নিজ শরীরের উপর ভারসাম্য রক্ষার্থে হিমশিম খাচ্ছেন৷ তবুও আমি তাকে সামলানোর চেষ্টায় ধরলাম না। তিনি আবারও বাবার দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি রাগান্বিত। বাবার পরনের ময়লা শার্টটার কলার চেপে ধরে তিনি চিৎকার করলেন‚ “আর এতদিন তুমি বলেছ তুমি মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছ। কিন্তু তুমি তো মেয়েকে অন্যের ভোগের বস্তু হিসেবে বিক্রি করে দিয়ে এসেছ৷ এত টাকা দিয়ে কি করেছ তুমি? বলো।”
বাবার সাথে মা এই প্রথমবার উচ্চস্বরে কথা বলছেন। তিনি তার স্বামীর থেকে যে আজ কতটা আঘাত পেয়েছেন তা তার কর্মে স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে। আমার সমস্ত শরীর যেন ইতোমধ্যে পাথরে পরিণত হয়েছে। চোখের কোণা বেয়ে কখন টুপটুপ করে পানি ঝরতে আরম্ভ করেছে তা আমি একদম অনুভব করতে পারিনি৷ লোকটা হাজার খারাপ হলেও‚ কোন প্রকার দায়িত্ব পালন না করলেও অন্তত এতটুকু বিশ্বাস ছিল যে তিনি আমাদের দুই ভাই-বোনকে কোন বিপদের মুখে ঠেলে দিবেন না। কিন্তু তিনি তো আমায়…।
“টাকা তো নেই।” বাবা দাঁত বের করে হেসে উঠলেন। এতটা হিংস্র কখনো কোন বাবা হতে পারে?! “আমি শব মিলিয়ে নয় কোটি টাকার র্-র্-ঋণ করেছিলাম। তাদেরটা শোধ করেছেন ব্-ব্লাকশ্টোন।” মায়ের কাঁধের উপর দিয়ে বাবা পেছনে আমার দিকে তাকালেন। আবারও হাসলেন তিনি।
এতটুকু সময়ের মধ্যে লোকটার প্রতি এমন সীমাহীন ঘৃণার সৃষ্টি হলো যে আমার তার মুখটা দেখার ইচ্ছা হচ্ছে না। অনেকটা জোরপূর্বক তাকে দেখতে লাগলাম।  তিনি তার কথা চালাতে থেকে বললেন‚ “বিনিময়ে তিনি শে-রেনকে চেয়েছেন আর আমিও শ্-শ্-শ্বাক্ষর্-র করে দিয়েছি।”
“কক্ষনো না। আমার মেয়ে কারো ভোগের বস্তু কখনো হবে না। আমি বেঁচে থাকতে না। আপনার ঋণ আপনি শোধ করুন।” মায়ের বজ্রধ্বনি শোনে খানিকটা আৎকে উঠলাম আমি। শরীর জুরে এক শীতল স্রোত বয়ে গেল। এটা কি মায়ের বজ্রধ্বনির কারণ নাকি সম্পূর্ণ সত্য?
“তাহলে তোমার বেঁচে থেকেও লাভ নেই।” আমি বাবার হাতটা নড়তে দেখলাম। তিনি তার হাতটি দিয়ে মায়ের গলা চেপে ধরেছেন। আবারও।
এই মুহূর্তে আমি নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না। মুহূর্তে আমার সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ উত্তপ্ত হয়ে উঠল। নিঃসন্দেহে সীমাহীন ক্রোধ ও অ্যাড্রেনালিন রাশ। দু কদম এগিয়ে বাবার বুকে আকষ্মিক ধাক্কা দিলাম। তিনি নিজেকে সামলাতে পারলেন না। ছিটকে দূরে সরে গেলেন। টেবিলের উপর রাখা শীতল পানিভর্তি জগটি দেখতে পেয়ে তার সমস্ত পানি বাবার দিকে ছুড়ে মারলাম। তিনি চোখজোড়া বন্ধ করে নিলেন। তিনি ভিজে গেলেন। অতঃপর হাঁ করে শ্বাস নিলেন। মাত্রাতিরিক্ত ক্রোধান্বিত হলেও তিনি আমার জন্মদাতা তা আমি ভুলিনি। ভুললে সম্ভবত পানি নয়‚ আমার হাত উঠত উনার শরীরে। স্বাভাবিক হয়ে তিনি রাগান্বিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। কিন্তু আমি তাকে বিন্দুমাত্র পরোয়া করি না। আর নয়।

চলবে……

শ্বাপদসংকুলWhere stories live. Discover now