Little Cobra

0 0 0
                                    

ঘড়ির কাঁটা যখন ঠিক এগারোটায় এসে স্থির হলো তখন হঠাৎ করে আমার ফোন ভাইব্রেট করে উঠল। বই হাতে আধশোয়া আমাকে বেশ রুক্ষভাবে নিজ চিন্তার রাজ্য থেকে টেনে বের করল এই ফোনকল। যথেচ্ছভাবে বিরক্তির অর্থহীন এক শব্দ আমার কণ্ঠনালি থেকে পালিয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস। বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটি হাতে তুলে কলার আইডি যাচাই না করে তা রিসিভ করে কানে ধরলাম।
আনুষ্ঠানিকতা ভুলে চোখজোড়া বন্ধ করে বেশ রুক্ষ কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম‚ “জ্বি?”
অপর প্রান্ত হতে এক মৃদু আওয়াজ ভেসে এলো। ব্যক্তিটি নিশ্চয় হেসেছেন। দীর্ঘশ্বাসের সাথে প্রত্যুত্তর এলো‚ “আশা করছি আমি তোমায় বিরক্ত করিনি‚ লিটল কোবরা।”
আমার বন্ধ চোখজোড়া আকষ্মিক বিস্ফোরিত হয়ে খুলে গেল। মনোযোগ আকর্ষণের মূলমন্ত্র শেষোক্ত সম্বোধন। দ্রুত নাম্বারটি যাচাই করলে উপলব্ধি করলাম ব্যক্তিটি সে—মিস্টার মিস্ট্রি। ঘুমের একটি হাত তুলে জানালাম‚ “হুম‚ আমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটেছে।” সবটা অভিনয় ব্যতীত অন্য কিছু নয়।
এবার সে শব্দ করে হেসে উঠল। আমোদিত কণ্ঠে বলল‚ “আমার লিটল কোবরা জঘন্য মিথ্যাবাদী।”
জবাব দিলাম না। সে আমার মিথ্যা খুব সহজে উপলব্ধি করতে পেরেছে। এবং আমি এই মিথ্যা অভিনয়ের জন্য প্রস্তুত না থাকায় এটি ত্রুটিযুক্ত হয়েছে। সে আবারও গভীর‚ মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে উঠল‚ “কোন বিষয়ে চিন্তিত কি?”
জবাব দেওয়ার আগে দুই দাঁতের মাঝে ঠোঁটজোড়া চেপে ধরলাম। বাক্যে আকাঙ্ক্ষার অভাব রেখে বললাম‚  “তুমি জানতে…।”
“অলিভার?”
প্রত্যুত্তরে আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম। যদিও সে তা দেখতে পারেনি। কিন্তু অনুমান করা যায় সে আমার কথার প্রসঙ্গ সঠিক অনুমান করেছে। এজন্যই সে আমার প্রাক্তনের নামটি উচ্চারণ করেছে৷
“বেঈমানি ছাড়া সে তোমার সাথে কোনরূপ অন্যায় করেনি এবং এই বিষয়টি আমাকে শান্তি দেয়।” সে শান্ত ও ছোট ছোট শব্দে উচ্চারণ করল।
নিজের মোবাইলটা কান ও গালে শক্তভাবে চেপে ধরলাম। আমি নিশ্চুপ হয়ে তার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ শুনতে লাগলাম। যেন কোন শ্রুতিমধুর ও প্রিয় গান শুনছি। লোকটা যেন ত্রুটিহীন। কিন্তু এটি আমার ভুল ধারণা। একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ত্রুটিহীন এবং তার সকল সৃষ্টি ত্রুটিযুক্ত।
আমি পরবর্তী প্রশ্নটি উচ্চারণ করলাম‚ “কিন্তু ডোভ? ওর কি অপরাধ ছিল?”
রসিকতার সুরে সে পালটা প্রশ্নে করল‚ “তুমি নিজে কেন খুঁজে বের করছ না?”
“ ততদিন অবধি ভুল ধারণায় বাঁচতে হবে।”
“ওহ‚ লিটল কোবরা। অলিভারের সত্য জানার পর তুমি ভাবছ আমি তোমার জীবনের সুপারহিরো?”
হঠাৎ তার বচন ভঙ্গির পরিবর্তন আমার শ্রবণাতীত হলো না। খানিকটা রুক্ষভাব ‚ নির্দয়তা  ও বিপদ তার কণ্ঠে প্রকাশ পাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এবং সে তা প্রকাশ প্রতিরোধের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই দুই মিলে এক দারুণ যুদ্ধের সৃষ্টি যেন।
সে মৃদু হাসির সাথে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল‚ “আমাকে সংশোধন করতে দাও। আমি তোমার জীবনের সুপারহিরো নই। আমাকে একজন ভাবতেও সাহস করো না।  কারণ আমি তোমার জীবনের এতটা নিকৃষ্টতম ভিলেন যা তুমি কখনও কল্পনা করতে পারবে।”
তার এই কথা শোনার পর আমার কি যেন হলো। ডোভ এবং অলিভারের বিভৎস মৃতদেহের ছবিটি চোখে ভেসে উঠল। এরকম অথবা এর চেয়ে অধিক নিকৃষ্টভাবে কতগুলো খুন করেছে সে? তা যে আমার অজানা। আমি যেন হঠাৎ নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেলাম। এক অজানা ভয় আবারও জেগে উঠল‚ যা আমি ভুলে ছিলাম। যেন কোন মানব মাংস খেকো সিংহের সম্মুখীন হয়েছি।
উভয় প্রান্তে নীরবতা। মাঝে মাঝে নিঃশ্বাসের শব্দ। যেন কোন শোক পালন হচ্ছে। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে আমি আৎকে উঠলাম। ঘাড় বাঁকিয়ে নিজ রুমের দরজার দিকে তাকানোর সময় তার কণ্ঠস্বর আবারও শুনতে পেলাম।
“তোমার পার্সেল‚ সেরেন। যাও‚ গ্রহণ করো।”
আমার পার্সেল? মিস্টার মিস্ট্রির পক্ষ থেকে? এবার সে কি পাঠিয়েছে? সংরক্ষণ তরলযুক্ত কাচের বোতলে কারো চোখ‚ কারণ সে আমার দিকে তাকিয়েছিল? নাকি আমার সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করার দুঃসাহসের শাস্তিস্বরূপ কারো হৃৎপিণ্ড? এসব ছাড়া অন কিছু মস্তিষ্কে উদয় হলো না। যতটুকু তাকে বুঝতে পেরেছি‚ তাকে চিনতে ও উপলব্ধি করপ্তে পেরেছি তার উপর ভিত্তি করে এসব ভাবা কি অস্বাভাবিক কিছু?
কিন্তু তার কণ্ঠে নিজের নামটা প্রথমবার শুনে এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করতে লাগল। মনে হলো সে বেশ যত্নসহকারে নামটি উচ্চারণ করেছে। পার্সেল হাতে পেয়ে খানিকটা অবাক হলাম। এটি একটি প্যাকেট। গতবারে মতো কোন বক্স নয়। কি হতে পারে এতে? কারো রক্তমাখা কোন পোশাক?
ভাবতে ভাবতে যখন প্যাকেটের ভেতর থেকে একটি শার্ট বের করলাম ঠিক তখন সেই অদ্ভুত মাতালো সুঘ্রাণ পেয়ে চোখজোড়া একাই বন্ধ হয়ে গেল। মিস্টার মিস্ট্রির পারফিউমের ঘ্রাণ‚ পোড়া তামাক ও তার দেহের নিজস্ব ঘ্রাণ।  সবগুলো একত্রে মিলে এক অদ্ভুত মোহনীয় সুঘ্রাণের সৃষ্টি করেছে।
“এতটা সময় সুগন্ধির দোকানগুলোতে ব্যয় না করে আমাকে একটিবার জানালেই হতো।” যখন আমি শার্টটি হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে সেই সুঘ্রাণ নিতে ব্যস্ত ‚ হঠাৎ একটি গম্ভীর পুরুষ কণ্ঠ আমায় নিজ কল্পনার জগত থেকে হেঁচকা টানে ফিরিয়ে আনল। বেশ অবাক হলাম আমি। সে কীভাবে জানতে পারল আমি কোথায় ছিলাম এবং কেন ছিলাম?
কিন্তু আলেক্স ও নিওনিকে যেমন মিথ্যা বলেছি তাকেও একই মিথ্যা বলার সিদ্ধান্তে বললাম‚ “এই বাজে ঘ্রাণ খোঁজার জন্য আমি সুগন্ধির দোকানে যাইনি। আমার ভাইয়কে উপহার দিতে…।”
আমাকে মিথ্যা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে কলের অপরপ্রান্ত থেকে সে বলে উঠল‚
“ বাজেও বলছ আবার ঘ্রাণও? ঘ্রাণ বাজে হয় নাকি গন্ধ? আলেস্যান্ডার ট্রয়‚ জন্ম ১৯ এপ্রিল‚ ১৯৯৫।”
স্যান্ড্রুর সম্পূর্ণ নাম ও জন্ম তারিখ বলবার পর সে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলার জন্য ক্ষণিকের বিরতি গ্রহণ করল। এবং আমি বুঝতে পারলাম মিথ্যা এগিয়ে আর কোন লাভ নেই। কিন্তু আমি সত্য স্বীকার করতেও প্রস্তুত এবং রাজি নই৷
সে নিজ কথা অবিরত রাখতে আবারও বলল‚
“ এবং এটি নভেম্বর মাস। একটি মাত্র ভাই তোমার। কতগুলো জন্মদিন পালন করবে? তাছাড়া‚ তোমার বাবার সাথেও তোমার সম্পর্ক স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর নয়।” সে মৃদু আওয়াজে হেসে উঠল। যেন কোন সে কোন রসিকতাপূর্ণ বাক্য শুনেছে। “আমি শুরুতেই বলেছি। আবারও পুনরাবৃত্তি করছি‚ আমার লিটল কোবরা জঘন্য মিথ্যাবাদী।”
আমি কথোপকথন চালিয়ে যেতে পারলাম না। কারণ আমি ধরা পড়েছি এবং মিথ্যা চালিয়ে যেতে পারব না। উপায়ন্তর না পেয়ে দ্রুত হাতে ফোন কেটে দিলাম। এখন পালাবার এই একটাই সুযোগ—কল কেটে দেওয়া। আমি নিশ্চিত সে আর কল করবে না।
হাতের শার্টটির দিকে আবারও তাকালাম। সবুজ রঙ। শার্টটা মুখ অবধি এগিয়ে এনে আবারও সুঘ্রাণ গ্রহণ করলাম। ইচ্ছে হলো সমস্ত শরীরে এই ঘ্রাণ মেখে নেই।
যদি মিস্টার মিস্ট্রির শরীরের চামড়া থেকে এই ঘ্রাণের পারফিউম তৈরি করা যায় তাহলে মন্দ হবে না।
যখন বুঝতে পারলাম আমি অমানবিক কিছু ভাবছি তখন শরীরের লোমকূপ গুলো দাঁড়িয়ে গেল। এটি কি তার সাথে কথা বলবার ফল? প্রবাদ বাক্যে যাকে বলে ‘সঙ্গদোষ’?

চলবে……

শ্বাপদসংকুলWhere stories live. Discover now