Mr. Mystery

0 0 0
                                    

কলুষিত ব্যক্তির রক্তের পোড়া গন্ধ এবং যন্ত্রণায় কাতরানোর মৃদু শব্দ। আমি এই দুইয়ের সাথে বেশ দারুণভাবে পরিচিত। এগুলো প্রিয় গান ও সুঘ্রাণ‚ এই দুইয়ের তুলনায় তীব্র নেশার কাজ করে। নিকোটিনের বিষাক্ত ধোঁয়া নিজের মাঝে টেনে নিয়ে চিরচেনা সোডিয়াম বাষ্পের আলোতে উন্মুক্ত করে সেই বিষাক্ত ধোঁয়ার নৃত্য‚ নর্তকীর নাচের থেকেও অধিক আনন্দ দেয়৷ আরেকবার বিষাক্ত ধোঁয়ায় নিজের শ্বাসনালী পুড়িয়ে আমি আমার সামনে যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা ঘর্মাক্ত লোকটির দিকে তাকালাম।
“তোমাকে এতটা যন্ত্রণা দেওয়ার কোন পরিকল্পনা আমার কোন কালে ছিল না। কারণ আমি তোমার জীবন বৃত্তান্ত সম্পর্কে অবগত নই‚” সিগারেটের অবশিষ্টাংশ দূরে ছুঁড়ে ফেলে বললাম‚ “কিন্তু বিশ্বাস করো। তুমি যেই চেয়ারটিতে বসে ছটফট করছ‚ এই চেয়ারটি লোকের নৃশংসতম মৃত্যুর সাক্ষী। আমি তো শুধুমাত্র সিগারেটের আগুনে তোমার গলার চামড়া পুড়েছি।”
লোকটি চোখ মেলে তাকাল। ওর দুচোখ ভরা ভয়। যেমন ভয় দশ বছরের একটা বাচ্চা তার দাদীর থেকে ভূতের গল্প শোনে গাছের ছায়ামূর্তিতে পেয়ে থাকে। ওর ঠোঁটজোড়া কাঁপছে। বড় শুকনো ওই ঠোঁট। ও যেন কোন মরুভূমির মরিচীকায় আটকে পড়া পথিক। করুণ চাহনি ওর। ওই চোখে ক্ষমার প্রার্থনা।
নিজ চিবুকে হাত বুলাতে থেকে আমি ওর শারিরীক অবস্থা পাঠ করতে ব্যস্ত হলাম। প্রশ্ন করলে ও তৃষ্ণা নিয়ে জবাব দিতে ব্যর্থ হবে। আমার মদ্য পূর্ণ গ্লাসটি হাতে নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। আমার হাতের গ্লাসের দিকে ওর দৃষ্টি স্থির। একগাল হেসে ওর সামনের টেবিলটাতে নিতম্ব ঠেকিয়ে ওর ঠিক সামনে গ্লাসটি রাখলাম। 
বাচ্চাদের ড্রপার হাতে এক ড্রপ পরিমাণ তরল ওর দিকে এগিয়ে দিলে ও লোভীর ন্যায় তা পান করার চেষ্টা করল। কিন্তু তৃষ্ণা মেটাতে পারল না। সামান্য পরিমাণ তরলও ওর চিবুক বেয়ে পড়ল।
আমি চুক্তি করার ইঙ্গিতে বললাম‚ “যতক্ষণ না তোমার তৃষ্ণা মিটবে‚ প্রতি প্রশ্নের জবাবে এক ড্রপার তরল ঠিকঠাক মতো পান করতে পারবে।”
“রাজি‚ রাজি‚” ও পাগলের মতো তাৎক্ষণিক মাথা নাড়াল।
এই পৃথিবীতে একই সাথে অতি ক্ষমতাবান ও দুর্বলতম জিনিস হলো তৃষ্ণা ও ক্ষুধা। এই দুইয়ের জন্যই তো এত ব্যস্ততা‚ এত চেষ্টা ও এত বিশৃঙ্খলা।
আরেক ড্রপ তরল নিয়ে ওকে প্রশ্ন করলাম‚ “কী নাম তোমার?”
ড্রপারের দিকে স্থির দৃষ্টিতে ও বলল‚ “কার্টার।”
আমি আমার কথা রাখলাম। তরল ওর গলা দিয়ে নামলে ওর মাঝে কিঞ্চিৎ পরিমাণ পরিবর্তন লক্ষণীয়।
“পরিবার আছে?”
কার্টার মাথা নাড়ল‚ “বৃদ্ধ মা এবং বারো বছর বয়সী ছেলে।”
আমার দৃষ্টি খানিকটা নরম হলো। আমি ফের জিজ্ঞাসা করলাম‚ “তোমার স্ত্রী?”
“আমার কাজের জন্য ছেড়ে গেছে। ছেলেটাকে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি ওকে হুমকি দিলে ছেলেটাকে রেখে যায়।”
“কী কাজ করো তুমি? অন্যকে অনুসরণ করা?”
কার্টার আবারও মাথা নাড়ল। ওর প্রতিটি জবাব আমার ভেতরে আগুন জ্বালাবার পূর্বপ্রস্তুতি।
“অপহরণ থেকে শুরু করে সকল অপকর্ম।”
“হুম…” উঠে দাঁড়িয়ে নিজ চেয়ারে ফিরে গেলাম। কার্টারের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে আবারও জিজ্ঞাসা করলাম‚
“সেরেনের পিছু নেওয়ার কারণ?”
যন্ত্রণা জড়িত বিভ্রান্তিকর চাহনিতে কার্টার আমার দিকে তাকিয়ে পালটা প্রশ্নে বলল‚ “সেরেন কে?”
বিরক্তিকর এক শব্দ আমার জিহবা পিছলে বেরিয়ে এলো‚ যা সম্পূর্ণ অর্থহীন। মোবাইল তুলে টেবিলের উপর গড়িয়ে কার্টারের দিকে প্রেরণ করলে তা মদের গ্লাসে বাধাপ্রাপ্ত হয়। মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে ইশারা করে বললাম‚
“এই মেয়েটা।”
ও মোবাইলের দিকে ঝুঁকে ছবিটা দেখার চেষ্টা করল। যখন ওর স্মরণ হলো তখন ওর অভিব্যক্তিতে কালো মেঘ জমা হলো। পুরনো ভয় ওর চোখে তৎক্ষনাৎ ফিরে এলো।
“আমাকে একজন ওর ছবি দিয়ে ওকে অপহরণ করতে বলেছিল।”
জ্বালানি বায়ুর সংস্পর্শে জ্বলন্ত দিয়াশলাই যেমন ধুপ শব্দে বিশাল অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি করে‚ ঠিক তেমনভাবে কার্টারের কথাটিও আমার ভেতরেও অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আমি আমার শান্ত অবস্থা বজার রাখতে সক্ষম। ঘাড় ঘুরিয়ে কিঞ্চিৎ উচ্চশব্দে ডেকে উঠলাম‚
“আন্দ্রেস?”
চঞ্চল ও ভারী পদধ্বনিতে উপস্থিত আন্দ্রেস জবাবে বলল‚ “জ্বি?”
কার্টারের দিকে ইশারা করে বললাম‚ “ওর নাম কার্টার। ছবি আছে নিশ্চয়ই? ওর বাসার ঠিকানা বের করো।”
“কেন? আমার বাসার ঠিকানা দিয়ে কি হবে?” কার্টার হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠল‚ “আপনার পা ধরে ক্ষমা চাই‚ আমার মা ও ছেলের কোন ক্ষতি করবেন না। আমি ওই মেয়ের কোন ক্ষতি করিনি।”
আন্দ্রেস সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে কক্ষ ত্যাগ করলে আমি চেয়ারের
হেলান ছেড়ে পিঠ সোজা করে বসলাম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রশ্ন করলাম‚
“ভয় হচ্ছে?” মাথা নাড়লাম‚ “হবে। হওয়াটা স্বাভাবিক। আমারও হয়েছে যখন তুমি সেরেনের পিছু নিয়েছিলে।”
সিগারেটের প্যাকেট থেকে আরেকটি সিগারেট জ্বালিয়ে তার ধোঁয়া জীবন আয়ুর মতো টেনে নিলাম।
“বলো‚ সে কে যে সেরেনকে অপহরণ করতে তোমার সাথে চুক্তি ও লেনদেন করেছিল? অবশ্যই অপহরণ পর্যন্ত কথার ইতি টানা হয়নি।”
কার্টারের অস্থিরতা থামছে না। বরং দ্বিগুণ হচ্ছে। ঈষৎ কম্পিত কণ্ঠে ও বলল‚
“আমার পরিবারের কোন ক্ষতি করবেন না তো?”
আমি অলক্ষ্যে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে এক শব্দে উত্তর দিলাম‚ “না।”
“লোকটার নাম ড্রাসিয়ান ম্যাডিসন।”
বিস্মিত হলাম না। ম্যাডিসন পরিবার যে সেরেনের বিপদের কারণ হতে পারে এ সম্পর্কে আমি আগেই সতর্ক ছিলাম। হাতের ইশারায় কার্টারকে নিজ বক্তব্য অব্যাহত রাখতে বললাম।
ও বলল‚ “মি. ম্যাডিসন মেয়েটাকে অপহরণ করে একটি ঠিকানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেছিলেন। আমার ধারণা সেই স্থানে মেয়েটার সাথে গণ ধর্ষণের মতো কিছু করার পরিকল্পনা চলছে।”
আমার ভেতরকার আগুন মুহূর্তে দাবানলে পরিণত হলো। এই দাবানলে যেকোন প্রাণ পুড়ে ছাই হতে সময় নিবে এক সেকেন্ড। ধৈর্য ধারণের সর্বোচ্চ চেষ্টায় দু সারির দাঁত একত্রে চেপে বললাম‚
“ঠিকানা?”
কার্টারের দেওয়া ঠিকানা আমায় বিস্মিত করতে ব্যর্থ হলো না। একই ক্লাব‚ যেখান থেকে কার্টার সেরেনকে অপহরণ করার পরিকল্পনা করেছিল। এবং এই ক্লাবে অবস্থিত এক অন্ধকূপ‚ যা সম্পর্কে আমার কখনো কোন ধারণা ছিল না।
আমি আবারও উঠে দাঁড়ালাম। হাতের রিভলবারটি তর্জনী আঙুলে ঘুরাতে থেকে কার্টারের সামনে উপস্থিত হলাম। আমি যখন ওর চোখের দিকে তাকালাম তখন অনুভব করলাম শারিরীক উত্তাপের কারণে আমার চোখে এক অদ্ভুত জ্বালাতন সৃষ্টি হয়েছে। এই জ্বালাতনের অদৃশ্য এক অনুভূতি‚ যা চোখের আশেপাশের অঙ্গকে নিজের উত্তপ্ততার জানান দিচ্ছে।
বন্ধ চোখে রিভলবারের নল কপালে ঘষতে থেকে জিজ্ঞাসা করলাম‚
“আজ পর্যন্ত তোমার পশুত্বের স্বীকার হয়েছে কতজন?”
শুকনো ঢোকের স্পষ্ট শব্দ। কিন্তু কোন জবাব নেই। বন্ধ চোখে অনির্দিষ্ট দিকে রিভলবারের নল স্থির করে গুলি ছুড়লে কার্টারের আর্তনাদ কানে এলো। চোখ খুলে প্রশ্নের পুনরাবৃত্তিতে বললাম‚
“কতজন?”
“হি… হিসাব ক্-ক-র্-ই্নি।”
রিভলবার টেবিলের উপর রেখে একটি ধারাল ছুরি হাতে নিতেই কার্টার অস্থির ও কান্নারত কণ্ঠে বলল‚
“ঈশ্বরের দোহাই। আমায় মারবেন না। আমি আপনার হয়ে আজীবন কাজ করব। দয়া করুন।”
আমি তাচ্ছিল্যভরে হেসে উঠলাম। মাথা নাড়তে থেকে বললাম‚
“হ্যাঁ। কিন্তু তুমি কি তোমার কারণে ধ্বংস হওয়া প্রাণের অনুরোধ রেখেছিলে?”
কার্টার নিশ্চুপ। শুধুমাত্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে এবং থরথর করে কাঁপছে। ঠিক যেমন বজ্রপাতে কেঁপে উঠে ভূ-পৃষ্ঠে অবস্থানরত সকল জড় ও জীব।
“তোমার দুইটি ভুল। এক‚ নারী-শিশুর অপব্যবহার।”  স্বল্প বিরতির শেষে আমি হেসে উঠলাম। কার্টারের আগ্রহী মুখমণ্ডল যেন আমায় আরো সুড়সুড়ি দিচ্ছে।
“তুমি আমার মূল্যাতীত লিটল কোবরার দিকে শুধুমাত্র অসৎ নজরে তাকানো’ই নয় ‚ একই উদ্দেশ্যে তার নিকবর্তী হওয়ার দুঃসাহসে সফলও হয়েছ।” রাশভারি ও মৃদু কণ্ঠে স্বল্প বিরতিযুক্ত বাক্যে কথা অব্যাহত রাখলাম‚
“তুমি কী অনুমান করতে পারবে আমার শরীরে জীবিত প্রতিটি কোষ তোমার সাথে ঠিক কী করার পরিকল্পনার জাল বুনছে?
তোমার ফুসফুস এক অণু অক্সিজেন গ্রহণের সুযোগ না পাওয়ার জন্য ছটফট করবে।
তোমার হৃৎপিণ্ড আগ্নেয়গিরি থেকে হঠাৎ উৎক্ষিপ্ত লাভার মতো ছিন্নভিন্ন হওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠবে।
তোমার শরীরে অবশিষ্ট প্রতি কণা রক্ত পানিতে পরিণত হওয়ার উপায়ন্তর খুঁজবে।
তুমি তোমার জন্ম এবং অস্তিত্বের জন্য অনুতপ্ত হবে।
প্রতিটি সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার সাথে তুমি ঈশ্বর ও আমার কাছে তোমার প্রাণের জন্য না বরং তোমার মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা করবে।
নরকে বসবাসরত অপদেবতাও তোমার প্রতিটি আর্তচিৎকারে ভয়ঙ্করভাবে শিহরিত হবেন। তোমার সাথে এমন কিছু ঘটবে।”
কার্টারের চোখজোড়া বিস্ফোরিত হওয়ার উপক্রম।  দু সারির দাঁত বের করে হেসে আমি হাতের ছুরিটি মৃদু শক্তিতে চালাতেই তা কার্টারের ডান কাঁধে বিঁধল। চোখ খিঁচে চিৎকার করে উঠল কার্টার। অসহ্য যন্ত্রণায় ও ওর মা-কে ডাকতে লাগল।
বৃদ্ধা মহিলার মন সম্ভবত ছেলের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। মায়ের মন নাকি সব বুঝতে পারে। কিন্তু এমন পৈশাচিক সন্তান পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অর্থ অক্সিজেনের অপব্যবহার ও এক মায়ের গর্ভের কলঙ্ক।
যন্ত্রণা যখন ওর শরীর একটু একটু করে মানিয়ে নিতে শুরু করল ঠিক তখন ওর বিপরীত কাঁধেও ছুরিটা আবার বিঁধিয়ে দিলাম। মুঠো ভর্তি মরিচগুঁড়া ওর রক্ত সহযোগে ডান কাঁধের ক্ষতটাতে লেপে দিলাম।
“এমন অত্যাচার করবে না। আমায় মৃত্যু দাও‚ আমি মৃত্যু চাই। ওহ ঈশ্বর‚ মৃত্যুদূতকে আমার দেহ থেকে আত্মার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে প্রেরণ করুন। আমি মৃত্যু চাই‚”  ও হাত পা ছুড়ে কাতরাচ্ছে‚ চিৎকার করছে‚ ঈশ্বরকে ডেকে চলেছে এবং আমার নিকট মৃত্যু প্রার্থনা করছে।
কার্টারের প্রতিটি চিৎকার আমার মস্তিষ্কে গিয়ে তীরের মতো বিঁধছে যেন। রক্ত ও মরিচে লাল হওয়া হাতে দ্রুত নিজ কানে ইয়ারফুন গুঁজে সম্পূর্ণ শব্দে গান বাজাতে লাগলাম। ভেতরের কোমলতা প্রকাশ করা যাবে না। অন্তত কার্টারের মতো লোকদের জন্য নয়।
এরপর ছুরিটি আবারও হাতে তুলে নিলাম। ওর বুকের খাঁজের মাঝে বিঁধিয়ে দিলাম। এবং আবারও ওর বাম কাঁধের ক্ষতে মরিচ লাগিয়ে দিলাম। এটা ক্রমান্বয়ে চলতে লাগল।
ওর সমস্ত শরীর যখন ক্ষত-বিক্ষত এবং রক্ত ও মরিচগুঁড়াতে রঞ্জিত‚ তখন ওর কণ্ঠনালী অকেজো। গলাকাটা প্রাণীর ন্যায় অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ। ওর চোখজোড়াও শীতল ও  জ্বালানি তেল নিঃশেষ হওয়া বাতির ন্যায় অনুজ্জ্বল ও নিভানো প্রায়। সম্ভবত ওর স্নায়ু ইতোমধ্যে অকেজো হয়ে গিয়েছে।
টিস্যু পেপারের সহায়তায় হাত মুছে মোবাইল হাতে নিয়ে আমি আমার গুপ্ত ঘরটি ত্যাগ করলাম। পেছনে ঘুরে তাকানোর দুঃসাহস করলাম না। কারণ আমি ওর রক্তাক্ত দেহটি দ্বিতীয়বার দেখতে অনিচ্ছুক। সত্য তো এই যে আমি নিজ নৃশংসতায় নিজে ভীত। 

চলবে……

শ্বাপদসংকুলWhere stories live. Discover now