“উঁহু…” হাতের পারফিউমের বোতলটা যথাস্থানে রেখে আমি না সূচক মাথা নাড়লাম। হতাশাগ্রস্ত নিচু কণ্ঠস্বরে বললাম‚ “এটাও না।”
দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা। ছোট-বড়‚ বিখ্যাত একের পর এক সুগন্ধির দোকানে ঘুরঘুর করছি। সাথে আলেক্স ও নিওনিকে লেজ হিসেবে সাথে রেখেছি। একের পর এক সুগন্ধি শোঁকে মাথা কেমন ঝিমঝিম করছে। অসুস্থবোধ হচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে রাখা সুগন্ধির নমুনাগুলোর দিকে একনজর তাকালাম।
পাশ থেকে নিওনির বিরক্তিকর এক আওয়াজে কর্ণপাত করলে আমি তার দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালাম। কোমরে এক হাত গুঁজে সে আমার দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। “রেন‚ তুই কার পারফিউমের ঘ্রাণ নিয়েছিলি? সত্যি করে বল তো?” সন্দিহান ও বিরক্তির মিশ্রিত চাহনি ওর। খানিকটা ইতস্ততভাবে আমি তার থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। “নিঃসন্দেহে তুই কোন নির্দিষ্ট একটি ঘ্রাণ পেতে চাচ্ছিস।”
গালের উপর জড়ো হওয়া ছোট চুলগুলোকে আঙুলের মাঝে ঠেলে কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে আমি আবারও সুগন্ধির নমুনা উঠিয়ে তার ঘ্রাণ শোঁকার অভিনয় করতে লাগলাম। “না। নির্দিষ্ট কোন ঘ্রাণ নয়।” আমি অস্বীকার করলাম। কিন্তু তার দৃষ্টিতে দৃষ্টি স্থির রেখে তা করতে পারলাম না। “আমি বলেছি তো। স্যান্ড্রুর জন্মদিন উপলক্ষে তাকে উপহার দিতে ভিন্ন কোন ঘ্রাণের পারফিউম কিনতে চাচ্ছি। যেটা সে পছন্দ করবে।”
নিজের মিথ্যা বলার দক্ষতা দেখে নিজেকেই বাহবা দিতে ইচ্ছা করল। কিন্তু তা করলে নিওনি ও আলেক্সের ধারণা সত্য প্রমাণিত হবে। এবং এটা আমি কখনো মানতে পারব না। অযথাই একটি সুগন্ধি পছন্দ হয়েছে এমনটা বুঝাতে চোখ জোড়া বড়বড় করে নিওনির দিকে নমুনাটি এগিয়ে দিলাম। “এটা দেখ‚ নিও। এটা বেশ দারুণ। আমার মনে হয় এটা ওর পছন্দ হবে।”
ভিন্ন পাশে অবস্থান করা আলেক্স কেমন একটা শব্দ করে উঠল। আমি ঘাড় বাঁকিয়ে ওর দিকে তাকাতেই ও তার মুখমণ্ডলটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল। কিন্তু আমার মনে হলে ও তাচ্ছিল্য করে হাসল। যেন আমার বলা প্রতিটি শব্দ অবিশ্বাস্য। এবং তাই-ই। কিন্তু আমাকে আমার অভিনয় চালিয়ে যেতে হবে।
“হ্যাঁ। এটা ভালো।” নিওনি সম্মতি জানালো। কিন্তু সে ঘ্রাণটা ঠিক অনুমান করতে পারল না। বিচার করতে পারল না। কারণ ইতোমধ্যে আমার সাথে সে অসংখ্য সুগন্ধির ঘ্রাণ শুঁকেছে। তার সুগন্ধি বিচারের চেতনা আপাতত লোপ পেয়েছে। এবং এটা আমার জন্য সুবিধাজনক।
“আলেক্স‚ তুই কোন…” আমি আলেক্সের অভিমত জানতে তার দিকে সুগন্ধির নমুনা এগিয়ে জিজ্ঞাসা করবার আগেই সেই আমার কথা মাঝপথে কেটে দিল। ও না বোধক মাথা নাড়ল।
“প্রয়োজন নেই। যেটা ভালো লাগে সেটাই নিয়ে নে।” ও অনাগ্রহ প্রকাশ করল। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ও নিওনির মতো কোন তাড়া দিচ্ছে না। ও এতটা ধৈর্যসহকারে আমার সাথে এই দোকান থেকে ঐ দোকানে চলছে যেন এটা ওর একটি আবশ্যক কাজ। বেশ অদ্ভুত। কারণ ও আগে এরকম ছিল না।
“ঠিক আছে।” আমি দোকানীকে একই সুগন্ধি দেওয়ার জনা বললাম।
অতঃপর একটি ভুল পারফিউম ক্রয় করে আমরা সুগন্ধির দোকান ত্যাগ করলাম। এই পারফিউম মিস্টার মিস্ট্রির শরীরের সেই মোহনীয় জটিল সুঘ্রাণের সাথে বিন্দুও সাদৃশ্য নয়। অনুপায় আমাকে পুরুষদের ব্যবহারের জন্য তৈরি এই সুগন্ধিটি স্যান্ড্রুকে দিতে হবে। এবং সে নিঃসন্দেহে আনক্নদিত হবে। কারণ সে উপহার পছন্দ করে। সুতরাং একাংশে আমার মিথ্যা সত্য।
রাত হয়ে যাওয়ায় আলেক্স আমাকে ওর বাইকে করে বাসার সম্মুখে ছেড়ে দিল। ওর বাইক থেকে নামার পর ল্যাম্পপোস্স্টের মৃদু আলোতে ওর বাইকের পেছনাংশ ও নেমপ্লেটের দিকে আমার চোখ অদ্ভুতভাবে আকর্ষিত হলো। অদ্ভুতভাবে পরিচিত মনে হচ্ছে। মনের একাংশ জানান দিচ্ছে যে বন্ধুর বাইক তো প্রতিদিন দেখা হয়। পরিচিত তো হবেই৷ কিন্তু মনের অপর অংশ সন্দিহান।
“হেই?” হঠাৎ কাঁধে আলেক্সের আলতো ছোঁয়াতে আমার সম্বিত ফিরে এলো। আমি খানিকটা চকিত হয়ে তার দিকে তাকালাম। “ঠিক আছিস তুই?” ও উদ্বেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
আমি কয়েকবার মাথা দুলালাম। “হ্যাঁ। ঠিক আছি। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম।”
আমার জবাবে আলেক্সের কালো চোখজোড়া সরু হয়ে এলো। ওর চোখজোড়াও কেমন যেন অদ্ভুত লাগল। আমি আবারও দুদিকে মাথা নাড়লাম। না। অলিভারের ওই কুৎসিত সত্য আমাকে সবার উপর সন্দিহান করে তুলছে।
হেলমেট খুলে আলেক্স আমার দিকে তার সকল মনোনিবেশ করল। “তোকে কয়েকদিন যাবত অন্যমনস্ক লাগছে। কি সমস্যা?” ও এমনভাবে অবস্থান করল যেন ও বিনা জবাবে এখান থেকে এক পাও নড়বে না আর না আমাকে নড়তে দিবে।
“আলেক্স…” আমি দ্বিধান্বিত। ঠিক কোন বিষয়টি ওকে জানিয়ে আমি এখনকার জন্য ছাড় পেতে পারি‚ তা ঠিক করতে একটু বেশিই সময় প্রয়োজন হলো। এর-ই মধ্যে ও আবারও সতর্কবাণীতে বলে উঠল‚
“মিথ্যা বলার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করবি না।”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। “অলিভার… সে র্যাপিস্ট।” অতঃপর এই সত্য প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়ে তাই কাজে রূপান্তর করলাম।
মাথা দুলাল ও। “আমি জানি।” ও নিজেও দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমার চোখজোড়া বিস্ফোরিত হওয়ার উপক্রম। আলেক্স জানে? অথচ আমি এতদিন অন্ধকারে ছিলাম!
“কি?” আমার আওয়াক আশ্চর্যজনক শোনাল। “ওয়াও!” অতঃপর আমি রাগান্বিত ভাবে রসিকতা শুরু করার চেষ্টা করলাম। “আর কে জানে? নিওনি? তোরা সবাই মিলে আমাকে অন্ধকারে রেখেছিলি? অথচ ওর মৃত্যুর শোক পালন করছি আমি!”
বেশ খানিকক্ষণ নিশ্চুপ ও বিবেচক চাহনিতে ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। সম্ভবত আমার মনোভাব বোঝবার চেষ্টা। “না। শুধুমাত্র আমিই জানি। নিওনি এসব কিছু জানে না।”
অকারণে মাথা দুলালাম আমি৷ রাগ যেন খানিকটা কমে গেল। “ওহ।” এটুকু ছাড়া আমি আর কিছু উচ্চারণ করতে পারলাম না।
“ওসব নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই৷ অলিভারও অতীত‚ ওর করা জঘন্য কাজগুলোও।” ও আমাকে স্বাভাবিক করবার চেষ্টায় বলল। এরপর গেটের ভেতরের দিকে ইশারা করল। “যা‚ ভেতরে যা। ভালো একটা ঘুম তোর ভেতরকার সকল অশান্তি নিরাময়ে সাহায্য করবে।”
হাজার কথা মন-মস্তিষ্কে তৈরি হলেও আমি মুখে কিছু ব্যক্ত করার শক্তি পেলাম না। অলিভারের সত্য আমায় বড্ড বেশি দুর্বল করে দিয়েছে৷ সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। মূল ভবনের সম্মুখে আসলে আমি বাইকের চলে যাওয়ার শব্দ শুনে পিছু ঘুরে তাকালাম। আলেক্স ও ওর বাইকটা চোখের পলকে স্থান ত্যাগ করল।চলবে……
YOU ARE READING
শ্বাপদসংকুল
Mystery / Thrillerঅপরিচিত নাম্বার থেকে একের পর এক ম্যাসেজ পেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে সেরেন। ম্যাসেজে অজ্ঞাত ব্যক্তি অদ্ভুত তাকে সম্বোধন করতে একটি নাম ব্যবহার করে। এরপর পরিচিতদের সাথে একের পর এক অপ্রত্যাশিত দূর্ঘটনা ঘটলে সেরেন দুশ্চিন্তায় জর্জরিত হয়ে উঠে। কিন্তু ভয়ার্ত নয়।...