অধ্যায়-১

188 18 2
                                    

       মেয়েটা কাঁদছে তো কেঁদেই চলেছে। সারারাত কেঁদে কেঁদে চোখদুটো একেবারেই  ফুলে গিয়েছে। আরও কত কাঁদতে পারে মেয়েরা! আমার তো এমন অনুভূতি কখনোই হয় নি। খেলতে গিয়ে কতই না চোট পেয়েছি। তবুও একবারের জন্যও তো কাঁদিনি। এসব ভাবতেই বিছানা থেকে উঠে পড়লাম। মাথায় কেমন যেন  একটা ঝিম ধরে আছে।
        “উঠেছো তাহলে‚” নাবিলা আমার অগোচরে চোখ মুছে বলতে লাগলো।
        আমি আর উত্তর না দিয়ে সোজা ফ্রেশ হতে গেলাম। অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে ছিলাম। কি আশ্চর্য! বাসায় তো ফিরি নি। তবে আমি বিছানায় ঘুমাচ্ছিলাম কিভাবে? ও আবার বলতে শুরু করে‚
        “খাবার রেডি করেছি। তাড়াতাড়ি চলে এসো।”
        “আমি খাবো না। তুমি খেয়ে নিও‚” বলে তাড়াহুড়ো করে কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে লাগলাম। সেই সঙ্গে নাবিলা চেয়ার থেকে উঠে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো।
        “খাবে না মানে! একশো বার খাবে‚ হাজার বার খাবে। এসো আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি। না খেয়ে তোমায় কোত্থাও যেতে দেব না।”
        একথা বলতেই নাবিলা আমার হাত ধরে টানতে টানতে টেবিলের কাছে নিয়ে গেল।
        “বললাম তো খাবো না। এক কথা কয়বার বলতে হবে তোমায়! হাতটা ছেড়ে দাও। আমার হাত ধরে আটকানোর তুমি কে শুনি! তোমার কোনো অধিকার নেই আমাকে হাত ধরে আটকানোর। দেখছো না আমি কলেজের জন্য লেট হয়ে যাচ্ছি। তোমার যা ইচ্ছে হয় করো শুধু হাতটা ছাড়ো আমার।”
        এক ধমকে কথাগুলো বলার পর নাবিলাকে আলতো ধাক্কা মেরে হাত ছাড়িয়ে সজোরে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লাম কলেজের উদ্দেশ্যে। নাবিলা ওভাবেই স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে থাকলো। ওর মুখ দিয়ে বিন্দুমাত্র কথাও বেরোলো না।
        রাস্তায় জ্যাম‚ তাই হেঁটে হেঁটেই কলেজে পৌঁছালাম। বাবা তো জগিং এ বেরিয়েছে। এই বুড়ো বয়সেও তার স্বাস্থ্য সচেতনতার কমতি নেই। জগিং শেষে অবশ্য কিছু কাঁচাবাজারও করে আনে। তাই আমার আর রেগুলার বাজারে যেতে হয় না। মা বাড়িতে নেই‚ খালার বাড়িতে বেড়াতে গেছে। মাকে একটা ফোন দিলাম‚ কিন্তু ধরলো না। বোনের বাড়িতে গেছে‚ গল্পগুজব করতেই হয়তোবা খেঁয়াল করে নি। কলেজে ঢোকার পর থেকেই এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করতে শুরু করে। ডিপ্রেশনের কারণে চাকরি করার ইচ্ছাটুকু হারিয়ে ফেলেছি। বেকার বসে থেকেও তো লাভ নেই। তাছাড়া এই কলেজের মাটিতেই তো জড়িয়ে আছে সেই সুদূর অতীত যা কখনোই ভুলিবার নয়।
        ক্লাসগুলো কোনোভাবে শেষ করে। বাড়িতে ফিরলাম। ফিরতে ফিরতে বিকেল চারটা বেজে গেলো। কলিং বেলে চাপ দিতেই বাবা দরজা খুলে দিল।
         “নির্লজ্জ‚ বেহায়া কোথাকার! কই ছিলি এতক্ষণ?”
         বাবার চিৎকার শুনে নাবিলা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে চলে এলো।
         “বাবা‚ কি হয়েছে। ওকে বকছেন কেন? শান্ত হোন‚ বাবা।”
         “শান্ত হবো কিভাবে‚ ওর আক্কেলজ্ঞান কোনদিন হবে!”
         “আমায়‚ বকছো কেন বাবা। আমি আবার কি দোষ করলাম‚” আমি বললাম।
         “এখন আবার নির্দোষ সাজা হচ্ছে! সারা রাত বাড়ি ফেরার নাম-গন্ধ নেই। একে তো শেষরাতে মাতাল হয়ে বাড়িতে ফিরেছিস‚ তারপর সকালে কিছু না খেয়ে বউমার সঙ্গে রাগারাগি করে চলে গিয়েছিস। মেয়েটা সেই সকাল থেকেই না খেয়ে বসে আছে। একটাবার ওর খোঁজ নিয়েছিস! এখনো অপেক্ষা করে বসে আছে মেয়েটা। মামণি, তুমি খেয়ে নাও। এই নির্লজ্জটার অপেক্ষায় বসে থাকলে তোমার শরীর খারাপ করবে মা‚” বলে বাবা ড্রইংরুমে গিয়ে কালো ফ্রেমের চশমাটা পড়ে পত্রিকা হাতে নিল। দেখে মনে হলো রাগের মাথায় পত্রিকাটা দুমড়ে মুচড়ে ছিড়ে ফেলবে। নাবিলা আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
         “এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? যাও গিয়ে আমার জন্য ভাত রেডি করো।”
         অতঃপর আমি ফ্রেশ হয়ে এসে টেবিলে বসে পড়লাম। নাবিলা খাবার পরিবেশন শুরু করেছে। বাবার পত্রিকা পড়া এখনো শেষই হয়নি। আর হবেই বা কিভাবে। বাবা প্রতিদিন দুটো করে পত্রিকা পড়ে‚ সময় তো লাগবেই। আবার বলে কিনা ১০ টাকার ১টা পত্রিকার বদলে ৫ টাকার দুটো পত্রিকা কিনলে নাকি লাভ বেশি। ১০ টাকায় ১৬ পৃষ্ঠা আর ৫ টাকার পত্রিকায় সাধারণত ১২ পৃষ্ঠা থাকে। আর ৫ টাকার দুটো পত্রিকা কিনলে দাঁড়ায় ২৪ পৃষ্ঠা। কি লজিক বাবার! এমন যুক্তি তো আমার কলেজের ফিজিক্সের স্টুডেন্টরাও দিতে পারে না। বাই দ্য ওয়ে‚ খাবার প্রস্তুত হওয়ার পর নাবিলা বলল‚
         “আজ তোমাকে একটু নিজে হাতে খাইয়ে দিই? যদি তোমার একান্তই কোনো আপত্তি না থাকে তবে।”
         আমি কিছুটা রূঢ়স্বরে বললাম‚
        “আপত্তি আছে বইকি। আমার হাত আছে‚ আমি নিজে হাতে খাবো। নয়তো চামচ দিয়ে খাবো। তবুও নিজে খাবো। বাবার তৈলাক্ত মাথায় তেল ঢালার পর এখান দরদ দেখাতে এসেছে! হুহ্।”
         আমার প্রতিটা শব্দ ওর কোমল হৃদয়ে বর্শার মতো আঘাত হেনেছে। কথাগুলো শোনার পর
ওর চোখ পানিতে ডোবার অবস্থা। কখন যে গড়িয়ে পড়বে তা বলার জো নেই। ও খাবার আনার বাহানা ধরে রান্নাঘরে গেল। ফিরে এসে বোঝা গেল নাবিলা চোখের মোছার জন্য রান্নাঘরে গিয়েছিল। বেচারা সজোরে কান্না করারও সুযোগ পায় না। আসলেই অনেক নিষ্ঠুর আমি! কোনো দয়ামায়া নেই আমার। পুরোটা দিন মেয়েটাকে কাঁদিয়েই চলেছি। কি করবো‚ ওর প্রতি যে আমার বিন্দুমাত্র অনুভূতিটুকু নেই।

নিস্তব্ধতাWhere stories live. Discover now