অধ্যায়-১২

40 10 0
                                    

বাসায় গিয়ে দেখি দরজাটা খোলা। সচারাচর এমন খোলা থাকে না। আজ তাহলে আর কলিং বেল চাপতে হলো না‚ দরজা দিয়ে সোজা ঢুকে পরলাম রুমে। নাবিলাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। ছাদে কাপড় তুলে আনতে গিয়েছে বলে মনে হলো। তাই বলে এভাবে দরজা খোলা রাখা ঠিক না। আমি হাত-পা ধুয়ে রুমে গেলাম। নাবিলার তো কোনো পাত্তাই নেই। সাধারণত উত্তর-পূর্ব কোণের রুমে কেউ থাকলে তা সহজে বোঝা যায় না। কারণ ঘরটার অবস্থান একেবারে পিছনের দিকে। ঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম‚ নাবিলা একটু ওয়েস্টার্ন ক্যাটাগরির স্কার্ট-টপস পড়ে ক্যানভাসে পোর্ট্রেট আঁকছে। স্কার্ট-টপসে ওকে একেবারে পনেরো বছরের যুবতী মেয়েদের মতো লাগছে। যদিও ওর বয়স আদৌ তেমন একটা হয়নি। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে হা করে ওইদিকে তাকিয়ে আছি। কতই না মন দিয়ে ছবি আঁকছে মেয়েটা। আমি যে এসেছি সেটা টেরই পেল না। দাড়িয়ে না থেকে এবার আলতো করে একটা কাশি দিলাম। কিন্তু কাজ হলো না। এবার কাশির ভলিউমটা আরেকটু বাড়িয়ে দিলাম।
"ওমা‚ তুমি কখন এসেছো। সরি‚ আমি আসলে খেঁয়াল করিনি। ফ্রেশ হয়েছো? চলো কিছু স্ন্যাকস বানিয়ে দিই।"
"না‚ থাক। বাইরে থেকে কফি খেয়ে এসেছি। আর কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না‚ তুমি খেয়ে নাও‚" বলে ড্রইং রুমে গিয়ে টিভিটা অন করলাম। নাবিলা দুকাপ চা আর কয়েকটা বিস্কুট নিয়ে আসল। আমার হাতে এককাপ চা ধরিয়ে দিয়ে পাশের সোফায় গিয়ে বসল। আসলে একই সোফায় আমার পাশে বসলে আমি যে তা ভালোভাবে নেব না সেটা মেয়েটা বুঝে গিয়েছে। আমি একটা হরর মুভি দেখতে লাগলাম। সন্ধ্যাবেলায় সাধারণত এমন মুভি দেয় না। নাবিলাও পাশ থেকে মুভিটা দেখছে আর আমার সাথে ভাব জমানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আমার মোবাইলটা বেজে উঠল। দেখি বাবা ফোন করেছে। আমি ফোনটা রিসিভ না করে কেটে দিয়ে কলব্যাক করলাম।
"হ্যালো বাবা‚ ঠিকমতো পৌঁছে গিয়েছো তো?"
"বাবা নয় তোর মা বলছি। বাবার ফোন থেকে কল দিয়েছি। আমারটার চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছে। চিন্তা করিস না‚ আমরা ঠিকমতো পৌঁছাতে পেরেছি। এখন কোথায় আছিস তুই?"
"এখন বাসায়‚ মা।"
"সন্ধ্যাবেলায় কিছু খেয়েছিস?"
"হ্যাঁ মা‚ খেয়েছি।"
"নাবিলা মামণি কিছু খেয়েছে?"
"তা তো জানি না।"
"সেটা জানবি কিভাবে। এতটা অবহেলা করিস ওকে যে মেয়েটা না খেতে পেয়ে মরে গেলেও তুই টের পাবি না। দে‚ ওকে ফোনটা দে।"
ফোনটা লাইনে রেখে নাবিলাকে বলতে লাগলাম‚
"নাবিলা‚ মা ফোন করেছে। তোমার সাথে ক...."
আমার কথা শেষ না হতেই নাবিলা আমার হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নিল। তারপর কোনদিকে যে ছুটল তার ঠিক নেই। মা-মেয়ে যে এবার আমার উপর কোন যুক্তি-বুদ্ধি খাঁটাবে! আমি হলাম সেই অমাবস্যা রাতের বলির পাঠাস্বরূপ। সে যা-ই হোক মুভিটা দেখা চালু রাখলাম। আধঘন্টা পর নাবিলা আমার হাতে ফোনটা ফেরত দিল। বোঝাই যাচ্ছে মোবাইলের ব্যালেন্সের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। এখন কিছু বলতে গেলে আবার তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে ছাড়বে।
মুভিটা দেখা শেষে নাবিলা বলল‚
"কি অসাধারণ ছিলো মুভিটা তাই না?"
আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম থ্রিলিং মুহূর্তগুলো চলার সময় তো নাবিলা অন্যত্র গিয়ে মায়ের সাথে কথা বলছিল। আসল মজা তো ওইখানেই ছিল যা নাবিলা দেখে নি। তাহলে ও কিভাবে বলল মুভিটা অসাধারণ! শুধুই কি মিথ্যে মিথ্যে আমাকে খুশি করার জন্য।
"ভাবছো‚ অরিজিনাল পয়েন্ট না দেখেও কিভাবে বলছি যে মুভিটা অসাধারণ! চিন্তা কর না‚ আমি কোনো ভিনগ্রহী ভূত কিংবা আগন্তুক নই। এর আগে ওয়েব প্লাটফর্মে মুভিটা দেখেছিলাম। বেশ ভালোই লেগেছিল।"
আমি হা করে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। অমন মনের কথা পড়ে ফেলার সক্ষমতা আমার কেন হয়নি।
আজ রাতে বিছানায় শুয়ে তিল্লে ব্যাগশোর 'মিস্ট্রেস অব দ্য গেম' নামক থ্রিলার বইটা হাতে নিলাম। বইটা সিডনি শেলডনের 'মাস্টার অব দ্য গেম'র সিক্যুয়েলে লিখা। এর আগেও 'নাথিং লাস্ট ফরেভার' নামক মেডিক্যালি থ্রিলার বইটা পড়েছি। থ্রিলার কি জিনিস‚ তা উনার কাছ থেকেই শিখেছি। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালানো রয়েছে। নাবিলাকে বলে দিলাম ল্যাম্প জ্বালানো থাকলে যদি ওর ঘুমের কোনো সমস্যা হয় তবে আমি ড্রইং রুমে গিয়ে পড়ব। নাবিলা সোজা বলে দিল‚ ওর কোনো আপত্তি নেই। প্রতিদিনের মতো আজও সেই পাশের জানালা দিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে অধীর দৃষ্টিতে তারা গুনছে মেয়েটা।
বইটা নিজের পকেটের টাকা দিয়ে কিনি নি‚ মারিয়া নামের এক স্টুডেন্টের কাছে পেয়েছি। মারিয়া আর ওর এক বান্ধবী আমার লেকচারে মনোযোগ না দিয়ে বইটা সামনে রেখে কি যেন আলোচনা করছিল। তাই আমি ধমক দিয়ে কেড়ে নিয়ে বলেছি সপ্তাহখানেক পর ফেরত দেব। দেখি কি আছে বইটায়। তরুণ প্রজন্মের কাছে ইহা কি কারণে এতটাই আকর্ষণীয়।
পড়তে তো ভালোই লাগছিলো তবে কিছু অনুপযোগী কন্টেন্টে ভরা। আজকালকার ছেলেপুলেরা অল্প বয়সেই অধিক জ্ঞানী হয়ে যাচ্ছে দেখছি! নাহ এসব বই ওদের পড়া ঠিক হবে না। তবে পড়া শেষে যার বই তাকেই ফিরিয়ে দেব। নয়তো বলবে যে স্যার বই লুটে নিয়েছে। এবার বইটা রেখে টেবিল ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিলাম।
প্রতিদিনের মতোই বিছানার দুইপাশে দুইটা দেহ আর মাঝখানে সেই সনোরা লাইন। একত্রিত হতে চাইলেও পারছি না। মিনিট পাঁচেক পর ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল। সেই সঙ্গে সিলিং ফ্যানটাও ঘোরা বন্ধ করে দিল। মা বলেছিল এসি দিয়ে না ঘুমাতে‚ কারণ এসির হাওয়া ক্ষতিকর। এই গরমে শুয়ে থাকার কি আর মানে হয়। নাবিলা আপনমনে জানালার দিকে তাকিয়ে তারা গুনছে। মেয়েটা হঠাৎ বলে উঠল‚
"দিগন্তটা কি আসীম তাই না।"
আমি চুপ করে উঠে বসলাম।
"একি‚ তুমি উঠে পড়েছ কেন। ঘুমাও‚ আমি হাতপাখা দিয়ে বাতাস করে দিচ্ছি।"
"না‚ আমি ঠিক আছি। অযথা কষ্ট করতে হবে না।"
"কষ্ট কেন হবে‚ জলদি শুয়ে পড়।"
"বলছি না‚ বাতাস করতে হবে না। বাংলা কথা বোঝো না? আমার কারও অনুগ্রহের প্রয়োজন নেই।" বলে আমি সোজা বারান্দায় চলে গেলাম। চারিদিকটা পুরো অন্ধকার হয়ে আছে। একেবারে নিস্তব্ধ পুরো শহর। রাত একটা বাজে। বইটা পড়তে পড়তে কিভাবে সময় পার হল বুঝতেই পারলাম না। একটা জেনারেটর কিনে রাখলে ভালো হতো। যদিও এই এলাকায় তেমন একটা লোডশেডিং হয় না। খিদেও পেয়েছে খানিকটা। রাতে বেশি একটা পেটভরে খাই নি। মা তো বাসায় নেই‚ কাকে গিয়ে বলব। তাছাড়া নাবিলা অনেকবার জোরাজুরি করছিলো যেন একটু বেশি করে খেয়ে নিই। নাবিলা বলল‚
"আমি ছাদে যাচ্ছি‚ তুমি আসবে?"
"না‚ এত রাতে আমার ছাদে যাওয়ার শখ নেই।"
"চল না‚ একটুখানি ঠান্ডা বাতাস উপভোগ করে আসি‚ প্লিজ‚ প্লিজ‚ প্লিজ।"
"না‚ যাব না। যার ঠান্ডা হাওয়া খাওয়ার শখ আছে সে নিজে গিয়ে খাবে।"
"হরর মুভিটা দেখে ভয় পেয়ে আছো নাকি?"
"কিসের ভয়। আমি কাউকে ভয় পাই না। তাছাড়া এসব ভূত-প্রেত বলে কিছু আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না‚" বড্ড জোর গলা দিয়ে বললাম কথাগুলো।
"খুব সাহস হয়েছে দেখছি। তো বেশ‚ আমি ছাদে গেলাম। মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে থাকো তুমি এই অন্ধকার কুঠরীতে।"

নিস্তব্ধতাWhere stories live. Discover now