অধ্যায়-৪

61 12 1
                                    

নাবিলা রান্নাঘরে গেল চা বানাতে। আমি চুপ করে ড্রইং রুমে গিয়ে বসে পড়লাম। মেয়েটার ধৈর্য আছে বলতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে পড়েছে ও। আর চিত্রাঙ্কন কম ধৈর্যের কাজ নয়। একটা ছবি আঁকতে কমপক্ষে ২-৩ রাতও লেগে যেতে পারে। নাবিলা আমারও কয়েকটা তৈলচিত্রের পোর্ট্রেট এঁকেছিলো। আমার মতো অমানুষ সেটা কখনোই সাদরে গ্রহণ করবে না। কতই না মমতা দিয়ে পোর্ট্রেটগুলো এঁকেছিলো বেচারা। আমি তো শুধু ফিজিক্সের গ্রাফ আঁকানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারি না। নিজের কাছে নিজেই যেন একটা হাসির পাত্র হয়ে উঠলাম। রিমোটটা হাতে নিয়ে টেলিভিশন চালু করলাম। তৎক্ষণাৎ একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়লো‚ প্রতিদিনই দেখি তবে সেরকমভাবে না।
"আপনার কি প্রেমিকা চলে গেছে? টাকা-পয়সার চিন্তা? মামলা-মোকদ্দমায় হেরে গিয়েছেন? দাম্পত্য জীবনে সুখী হতে পারছেন না? আর ভয় নেই। এসে গেছে শাহী বাবা আল্লামা আমীর খান চিশতি। এখানে অভিজ্ঞ জ্বীন-পরীর দ্বারা সকল সমস্যার সমাধান করা হয়।"
পরী! আমার পরী‚ আমার ঘুমন্ত পরী‚ আমার সাত সাগরের পরী‚ কিন্তু সে তো আর ফিরে আসবে না। যার স্বর্ণাভ কণ্ঠে রোজ রবীন্দ্রসংগীত শুনে বধির হয়ে যেতাম সেই পরীটা যে আজ আমার পাশে নেই। ভাবলেই গা টা কেমন যেন শিউরে ওঠে। ধুর! কিসব ভুয়া বিজ্ঞাপন দেয়। সঙ্গে সঙ্গে চ্যানেল পাল্টালাম। পুরোনো কথা মনে পড়ায় চোখের কোটায় একফোঁটা অশ্রু এসে জন্মেছে বলে মনে হলো। আমার মতো নির্বোধ মানুষের আবার অশ্রু পড়তে শুরু করলো কবে থেকে? টিভির দিকে একটানা তাকিয়ে থাকায় বোধহয় এমন হয়েছে। মিনটাইম‚ নাবিলার পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম। যদিও সে নূপুর পড়ে না। সঙ্গে সঙ্গে বুড়ো আঙুলের তর্জনী দিয়ে অশ্রুটুকু অপসারণ করে ফেললাম। নাবিলা এসে আমার হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে বলল‚
"এই নাও। চা টুকু পান করে মনের সব ডিপ্রেশন দূর করে ফেল। আমি জানি তুমি এই মুহূর্তে তোমার প্রাক্তনের স্মৃতিচারণ করছো। ওর স্মৃতি কখনোই তুমি ভুলতে পারবে না সেটাও জানি। তাই বলে জীবন তো আর থেমে যায় নি। আরও লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে তোমায়।"
ওকে নিয়ে নাবিলার বক্তব্য কখনোই আশা করি নি। আমার মতে ওর মুখে এসব শোভা পায় না। আবারও প্রচন্ড রাগ হচ্ছে আমার। নাবিলা কেন আমার প্রাক্তনকে নিয়ে কথা তুলবে‚ আমার ভালোবাসাকে নিয়ে প্রশ্ন তুলবেই বা কেন। যা-ই হোক‚ মেয়েটাকে আজ বড্ড কষ্ট দিয়েছি। বকুনির একেবারে কড়া ডোজ পড়ে গেছে। থাক‚ মনটাকে অন্তত একটাদিনের জন্য শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম। এখনো চুপ করেই বসে আছি। নাবিলাও আর কিছু বলল না। চা পান শেষে রান্নাঘরে গিয়ে কাপটা পরিষ্কার করে রেখে দিলো। বেশ ভালোই চা বানায় ও‚ একেবারে খাপে খাপ!
দিনকে দিন কেমন যেন ডিপ্রেশনটা আরও বেড়ে যাচ্ছে। অক্ষির অগোচরে ঘটে যাচ্ছে অনেক কিছু। হতাশার মধ্য দিয়েই আরও কয়েকটা দিন পার করার পর আজ দুপুরে নাবিলাকে আমার পাশে বসতে দেখলাম। আজকে ও নীলাভ সবুজ রঙের শাড়ি পরেছে। প্রতিনিয়ত সালওয়ার-কামিজ পড়ে থাকে তবে মাঝেমধ্যে শাড়ি পড়ে। তাই আজকে একটু অন্যরকম লাগছে। সেই সঙ্গে চুলগুলো খোঁপা বাঁধানো। খোপায় একটা জিনিয়া ফুল লাগানো। জিনিয়া ফুল কই পেলো জানি না। আজকে ওর স্পেশাল কিছু নাকি! আমার তো নিজের জন্মদিনই ঠিকমতো মনে থাকে না। ওরটা কিভাবে জানব। জিজ্ঞেস করার আগ্রহটুকুও নেই আমার। আর আগ্রহ থাকবে কিভাবে‚ এই সাড়ে তিন বছরে একটা রাতেও মেয়েটাকে স্পর্শ করে দেখি নি। দয়া-মায়া হারিয়ে ফেলেছি। রাস্তায় কোনো অসহায় মানুষ দেখলে যেখানে আমি খুশি করে পাঁচশ টাকা পর্যন্ত ধরে দিতাম সেই আমি এখন একটা ফকিরকে দেখলে ২ টাকাও বের করি না। আমি দীর্ঘক্ষণ ধরে চুপ থাকায় মেয়েটা হয়তো এবার সংকোচবোধ করেছে। নিজের মোবাইলটা হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। মনে হয় বারান্দার টবে সদ্য ফোটা ফুলগুলোর সাথে সেলফি তুলে ইন্সটাগ্রামে আপলোড দিবে। মানুষও আমি একটা! মেয়েটাকে যে একটা নতুন মডেলের মোবাইল কিনে দেব সেদিকে কোনো হুঁশ নেই। বিয়ের আগে ওর বাবার দেওয়া সেই ওল্ড মডেলের আইফোনটাই চালায় এখনো। অনেক দামি বোধহয়। তাছাড়া ওর সেলফিগুলোও তো হাই রেজুলেশনের। আমি তড়িঘড়ি করে ইন্সটাগ্রামে ঢুকে চেক করলাম‚ যা আন্দাজ করেছিলাম সেটাই। মাল্টিপল পাঁচটা নতুন পিকচার আপলোড দিয়েছে। ইন্সটাগ্রামে ওর ফলোয়ার সংখ্যা সাড়ে নয় হাজারেরও বেশি। প্রায় দশ হাজার ছুঁই ছুঁই। তবে ও ফলো করেছে শুধু একজনকেই আর সেটা হলাম আমি। আমি এক্ষেত্রেও অমানুষের মতো পাষাণ হৃদয়ের পরিচয় দিতে ভুলি নি। এখনো পর্যন্ত সেই ফলো ব্যাক অপশনে ক্লিক করি নি। এত ফলোয়ার থাকতে কেন আমার মতো এমন অপয়ার ঘরে তিনটে বছর ধরে পড়ে আছে! কত ছেলে এখনো ওর জন্য উন্মাদ হয়ে বসে আছে। মেয়ে মানুষের মন বোঝা বোধহয় সত্যিই অনেক কষ্টকর। শত কষ্টের মাঝেও যে এক ঝলক হাসি দিয়ে সকলকে আপন করে নেয়, সে-ই নারী। নাবিলাও হয়তো ঠিক তেমনই। মনে মনে শত কষ্টের বোঝা বইতে হচ্ছে ওকে তবুও কাউকে বুঝতে দেয় না। আজ পর্যন্ত কোনো দিন জামা-কাপড় কেনার টাকা চায়নি আমার কাছ থেকে। মায়ের অনুরোধে ওকে জোর করে অ্যামেরিকান এক্সপ্রেস কার্ড ধরিয়ে দেই। তাও মেয়েটা প্রয়োজন ছাড়া তেমন একটা খরচাপাতি করে না। ওরা বোধহয় এমনই হয়।
দিন দশেক থাকার পর মা অবশেষে বাসায় ফিরলেন। ব্যাস‚ বাসায় ফিরেই আদরের বউমার সাথে জমিয়ে গল্প করতে শুরু করলেন। আমি যে বাড়িতে আছি সেটা কেউ পাত্তাই দিলো না। এমনিতেই অবসাদগ্রস্ততায় ভুগছি। কারও সাথে কথা খোলামেলা জায়গায় কথা বললে ভালো লাগতো। শালার মন্টু তো বিয়ে করে বউপাগল হয়ে গিয়েছে। নামই মন্টু‚ ডাবল মন ওর। ওর সাথেই তো দীর্ঘদিন ব্যাচেলর বাসায় কাটিয়েছি। ফোন করলাম শালাকে.....ধুর ছাই! ফোন বাজছে তো বেজেই চলেছে। ধরার কোনো নামই নেই। মনেহয় বউয়ের সাথে লান্স করতে বেরিয়েছে। যাতে কেউ ডিস্টার্ব করতে না পারে সেজন্য হয়তো ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছে।
আজ শুক্রবার‚ কলেজ ছুটি থাকায় একটু রিল্যাক্সেশন মুডে ড্রইং রুমের ডিভানে শুয়ে আছি। গত এক সপ্তাহ ধরে পেটে আর অ্যালকোহল ঢালি নি। স্বাস্থ্যটা ফিট আছে বলে মনে হলো। অযথা কিডনি পচিয়ে ফেলার কি কোনো মানে হয়! কয়েকটা কাগজপত্রের ফাইল বের করার জন্য বেডরুমে গিয়ে আলমারিটা খুললাম। আলমারির একপাশের ড্রয়ার খোলা থাকলেও আরেকপাশের ড্রয়ারটা তালাবদ্ধ। চাবিটা যে কোথায় রেখেছি তা মনে করতে পারছি না। পাশের ড্রয়ার থেকে কাগজপত্র বের করার পর মনে পড়লো‚ চাবি তো ড্রেসিং টেবিলের দ্বিতীয় ড্রয়ারটায় রেখেছিলাম। বাড়ির উত্তর-পূর্ব কোণার রুমটায় ড্রেসিং টেবিলটা রাখা। সচারাচর সেখানে আমার তেমন একটা যাওয়া হয় না। একটা সময় ছিলো যখন খুব আসতাম রুমটায়। আসলেই সময়টা বড্ড বেপরোয়া। শরৎ এর কাশফুলের মতো ভেসে বেড়ায় প্রতিটা মুহূর্ত। মুহূর্তগুলোও কখনো জীবিত আবার কখনো মৃত বলে মনে হয় ঠিক যেমনটা অনুভূতির ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। সেই স্বর্ণাভ দিনের স্মৃতিচারণ করলে আজও মনটা ফুলে ফেঁপে কেঁদে ওঠে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারি না।

নিস্তব্ধতাWhere stories live. Discover now